শফিউল আলম : চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দরকে ভারতের পণ্যসামগ্রী পরিবহনে ট্রানজিট সুবিধায় উন্মুক্ত করে দেয়ার লক্ষ্যে উদ্যোগ-আয়োজন এবং তোড়জোড় এখন চলছে। দুই বন্দরে ভারতের আমদানি ও রফতানিমুখী পণ্য অভ্যন্তরীণ নৌ, রেল ও সড়কপথে পরিবহনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আবার ট্রানজিট পণ্যের জন্য উভয় বন্দরে বিশেষ ইয়ার্ড ও শেড নির্দিষ্ট করে রাখা হতে পারে। ভারতও তা চেয়েছে। আগামী ২০১৭ সাল নতুন বছরের প্রথম দিকে, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্ভাব্য নয়াদিল্লী সফরের সময়েই ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দরে ট্রানজিট ব্যবস্থার সুবিধা প্রদান সম্পর্কিত শীর্ষ পর্যায়ে চূড়ান্ত চুক্তি সম্পাদনেরও প্রস্তুতি-প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে।
এদিকে দেশের আমদানি ও রফতানিমুখী পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিং করতে গিয়েই প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামের এবং অপর দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মংলার বেহাল ও বেসামাল অবস্থা। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিবছর গড়ে ১২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে পণ্য হ্যান্ডলিং। কন্টেইনার ওঠানামা ২১ লাখ টিইইউএস অতিক্রম করতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বছরের বেশিরভাগ সময়ই উভয় বন্দর কন্টেইনারসহ কার্গোজটে স্থবির হয়ে পড়ে। কেননা দেশের আমদানি-রফতানির ক্রমবর্ধমান চাপ ও চাহিদা সামাল দিতে গিয়ে এর বিপরীতে ভৌত অবকাঠামো, সংকুলানের স্থান, যান্ত্রিক ও কারিগরি সুবিধার ক্ষেত্রে হিমসিম অবস্থা বিরাজ করছে। উভয় সমুদ্র বন্দরেরই প্রয়োজনীয় সক্ষমতার অনেকাংশেই অভাব রয়েছে। ভারতের পণ্য হ্যান্ডলিং করার জন্য আদৌ প্রস্তুত নয় দুটি বন্দর। ট্রানজিটের তা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে ভারতের জন্য ট্রানজিট সুবিধা উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য চলছে আয়োজন।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতমুখী পণ্যের ট্রানজিট চালুর লক্ষ্যে পরীক্ষামূলক ব্যবস্থায় সর্বপ্রথম পণ্য আনা-নেয়া শুরু হয় ২০১৫ সালে। ২ জুন ’১৫ইং ‘এমভি ইরাবতী স্টার’ জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩ নম্বর জেটিতে ভিড়ে এবং ভারতের তিনটি বন্দরগামী পণ্যভর্তি ৯২টি কন্টেইনার নামায়। এরপর ভারতের জন্য আনীত ৮৫টি কন্টেইনার নিয়ে ১৩ জুন ’১৫ইং চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করে ‘এমভি ওশান প্রুব’ জাহাজটি। এসব কন্টেইনার ভারতের চেন্নাই ও নভোসেবা বন্দরে পৌঁছে। ভারতের চেন্নাই, কোচিন ও নভোসেবা বন্দরে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশে কন্টেইনারগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হয়েছিল।
চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার করে ভারতের পণ্য পরিবহনের এই ‘ট্রানজিট’ অথবা ‘করিডোর’ ব্যবস্থাকে তখন দু’দেশের সরকারি তরফ থেকে অভিহিত করা হয় ‘ট্রান্সশিপমেন্ট’ কিংবা ‘কানেকটিভিটি’র নামে। বিগত ৬ ও ৭ জুন ’১৫ইং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে ভারত কর্তৃক চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক এবং উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর দিয়ে ভারতকে এ ধরনের ‘ট্রানজিট’, ‘করিডোর’ কিংবা ‘ট্রান্সশিপমেন্ট’, ‘কানেকটিভিটি’ সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে কোন নিয়মিত চুক্তি ইতোপূর্বে হয়নি। এ ব্যাপারে কোন নীতিমালাও নেই। যা নতুন বছর ২০১৭ সালে হতে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে সমুদ্রগামী মার্চেন্ট জাহাজ আসা-যাওয়া করে বছরে সোয়া ২ হাজারেরও বেশি। অন্তত সাড়ে ৬ কোটি মেট্রিক টন আমদানি ও রফতানি পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিং (খালাস, মজুদ ও শিপমেন্ট) হয়ে থাকে। এই বাবদ বছরে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ রাজস্ব আয় এবং ট্যারিফ, ফি বা মাসুল আহরিত হচ্ছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর সমগ্র দেশের বিশাল অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি।
চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধায় জাহাজযোগে পণ্যসামগ্রী পরিবহনের সুযোগ-সুবিধা চেয়ে দীর্ঘদিন যাবত পীড়াপীড়ি করে আসছে ভারত। বিষয়টি এতোকাল আলোচনা-পর্যালোচনার টেবিলে সীমাবদ্ধ থাকলেও ট্রানজিটের বিষয়টি শিগগিরই বাস্তব রূপ দেয়া হচ্ছে। তবে দেশের বন্দর ও কাস্টমস ভারতের ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট বাবদ ফি, চার্জ, মাশুল, শুল্ক-কর প্রাপ্তির বিষয়টিও এখন পর্যন্ত অসম্পূর্ণ রয়েছে। সরকারিভাবে তা চূড়ান্ত হয়নি। যদিও ট্রানজিট বাবদ ভারত থেকে বড় ধরনের কোন মাসুল পাওয়ার প্রত্যাশা ক্ষীণ হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই।
বন্দর ব্যবহারকারী তথা স্টেকহোল্ডাররা জানান, চট্টগ্রাম দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর। ভারতের ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের জাহাজ ও পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিংয়ের বাড়তি চাপ নেয়ার মতো সক্ষমতা চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের নেই। এ ক্ষেত্রে বন্দরের সবধরনের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দেশের সড়ক-মহাসড়ক, রেলওয়ে ব্যবস্থাও ট্রানজিটের জন্য অত্যন্ত অপর্যাপ্ত। দেশের পণ্য পরিবহনের ভার সামাল দেয়ার জন্য আগে চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধাসমূহ সম্প্রসারণের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। তাছাড়া ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্টের প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে কি পড়বে, অর্থাৎ ট্রানজিটের লাভালাভ আগেই গভীরভাবে খতিয়ে দেখা ও সময়মতো সুবিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। এরজন্য প্রয়োজনীয় গাইডলাইন ও সুষ্ঠু নীতিমালাও তৈরি করতে হবে। উপরন্তু ভারতকে ট্রানজিট দেয়া না দেয়ার প্রশ্নে চট্টগ্রাম বন্দরের ভূ-কৌশলগত অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতকে উপযুক্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিৎ।
আশুগঞ্জ নৌ-বন্দর ব্যবহারের পর থেকেই চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দরকে কানেকটিভিটি কিংবা ট্রান্সশিপমেন্টের নামে ট্রানজিট সুবিধায় পেতে জোরালোভাবে পীড়াপীড়ি করে আসছে ভারত। বিগত ৬-৭ জুন ’১৫ইং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় এ বিষয়টি ভারত সরাসরি আলোচনার টেবিলে তুলে আনে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। যদিও এখন এ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ চুক্তির তোড়জোড় চলছে। বন্দর ট্রানজিটের পেছনে ভারতের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভূমি পরিবেষ্টিত (ল্যান্ড লকড) ‘দি সেভেন সিস্টার্স’ হিসেবে পরিচিত উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭টি রাজ্যে (ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, অরুনাচল, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড ও মনিপুর) পণ্য পরিবহন নিশ্চিত করা। ভারত চাইছে তার দীর্ঘ ঘুরপথের পরিবর্তে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর দিয়ে পণ্যসামগ্রী সহজপথে স্বল্প সময়ে উপরোক্ত ৭টি রাজ্যে নিয়ে যাওয়া। এরজন্য ভারতের বাসনা, চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর এবং বাংলাদেশের সড়ক ও রেলপথকে ট্রানজিটের উন্মুক্ত সুবিধায় ব্যবহার করা। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম প্রধান রেল ও সড়ক রুটসহ দেশের সড়ক, মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়কগুলোও ট্রানজিটের ভার বহনের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। সীমিত সড়কগুলো ট্রানজিটে ব্যবহৃত হলে সমগ্র দেশের পরিবহন ব্যবস্থা আরও ভেঙে পড়বে।
দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর হিসেবে চট্টগ্রাম সমগ্র দেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ আমদানি-রফতানি কার্যক্রম সম্পন্ন করে থাকে। এরজন্য চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি-বার্থ, ইয়ার্ড-শেড, গুদাম, অফডক, সড়কসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা মোটেই পর্যাপ্ত বা যথেষ্ট নয়। অপ্রতুলতা ও হরেক সীমাবদ্ধতার মধ্যদিয়ে এগিয়ে চলেছে চট্টগ্রাম বন্দর। বঙ্গোপসাগর কোলে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় নিরাপদ পোতাশ্রয়কে ঘিরে হাজার বছর আগে গড়ে উঠে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর। বর্তমানে এটি একটি আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দর হলেও চট্টগ্রাম হচ্ছে ‘ফিডার পোর্ট’। অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করে পরিচালিত হয় বন্দরে জাহাজ আসা ও যাওয়ার সিডিউল। দেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দর বর্তমানে অনেকাংশেই কন্টেইনার-শিপিং বাণিজ্য নির্ভর হয়ে উঠেছে। বর্তমান সময়ে বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানিমুখী কন্টেইনার ওঠানামা, পরিবহন করা হচ্ছে বছরে ২১ লাখ ৮৯ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার (২০ ফুট সাইজের ইউনিট হিসাবে)। বছর বছর কন্টেইনার ওঠানামার প্রবৃদ্ধিও ব্যাপক। বর্তমানে ৪০ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার রাখা সম্ভব হচ্ছে বন্দরের ইয়ার্ডসমূহে। সামগ্রিকভাবে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরটি সমগ্র দেশের আমদানি-রফতানিমুখী পণ্য হ্যান্ডলিং ও পরিবহনের প্রয়োজন সামাল দিতে গিয়েই প্রতিনিয়ত চাপে রয়েছে। এ অবস্থায় প্রতিবেশী তাও ভারতের মতো বৃহৎ দেশের জন্য ট্রানজিট সুবিধা উন্মুক্ত করে দেয়ার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর এবং তার সাথে সংযুক্ত অবকাঠামো বাস্তবিক অবস্থাতেই অক্ষম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন