রফিকুল ইসলাম সেলিম : বড় দুই দলে একের পর এক চমক আর মাঠের বিরোধী দলের ধমকেই পার হয়েছে চট্টগ্রামের রাজনীতির আরও একবছর। উভয় শিবিরেই দলীয় কোন্দলে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। আওয়ামী লীগ বিএনপির কেন্দ্রে চট্টগ্রামের নেতাদের পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে চমক দেখা গেছে। তবে মাঠের রাজনীতিতে তা উত্তাপ ছড়াতে পারেনি।
সরকারি দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রে চট্টগ্রামে ৯ নেতার ঠাঁই হয়েছে। এতে সবচেয়ে বড় চমক হলো মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র ব্যারিষ্টার মুহিবুল হাসান নওফেলের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পাওয়া। এতে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে মহিউদ্দিন গ্রুপ হিসেবে পরিচিতরা উজ্জীবিত হয়েছেন। বছরজুড়ে সরকারি দলের গৃহবিবাদ ছিল আলোচনায়। বিশেষ করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘাত সহিংসতা চলেছে থেমে থেমে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কলেজ, হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজসহ বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি নিয়ে খুনোখুনি, বন্দুকযুদ্ধসহ সহিংসতায় মেতেছে তারা। মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রুপ ও আ জ ম নাছির গ্রুপের কর্মীরাই দফায় দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। আবার কোন এলাকায় আ জ ম নাছিরের সমর্থক দুই গ্রুপের মধ্যে ঘটেছে সংঘাত-সহিংসতা। বহিস্কার পাল্টা বহিস্কারেও তাদের বেপরোয়া লাগাম টেনে ধরা যায়নি। হাটহাজারীর একটি ভোটকেন্দ্র দখল করতে গিয়ে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রণির অস্ত্রসহ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে ধরা পড়া এবং কারাগার থেকে কম সময়ে মুক্তি পাওয়ার বিষয়ও ছিল আলোচিত ঘটনা।
ছাত্রসংগঠনের মতো মূল দলের নেতারাও গৃহবিবাদ থেকে দূরে থাকতে পারেননি। দফায় দফায় কথার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। চট্টগ্রাম বন্দর, নগরবাসীর গৃহকর নিয়ে দুই জনের পাল্টা-পাল্টি বক্তব্যে মাঠের রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়েছে কয়েক দফা। আবার দুপুরে ডাকাত ডেকে রাতে মেয়রের বাসায় গিয়ে হাজির হয়ে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।
গেল বছরের রাজনীতির মাঠে আলোচনায় ছিলেন সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দীনের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এনে বিএনপির রাজনীতি থেকেও সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। এরপর নীরবতা ভেঙে বঙ্গবন্ধু ও বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের জন্ম-মৃত্যু দিন পালন করে ফের আলোচনায় আসেন তিনি। যে কোন সময় সদলবলে আগের ঠিকানা আওয়ামী লীগে ফিরে যেতে পারেন এম মনজুর আলম।
মাঠের বিরোধী দল বিএনপি সরকারকে কিছু ধমক দেয়া ছাড়া রাজপথে কোন শক্তি দেখাতে পারেনি। দল গোছানোর কথা বলেও তা শেষ করতে পারেনি তারা। তবে বিএনপির রাজনীতিতে বড় ঘটনা ছিল তরুণ চিকিৎসক শাহাদাত হোসেনের নগর বিএনপির সভাপতি ও যুবদল নেতা আবুল হাশেম বক্করের সাধারণ সম্পাদক হওয়া। ঢাকা থেকে তিন সদস্যের চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি দেয়া হয়। ওই কমিটির অপর সদস্য সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু সুফিয়ান সভাপতির পদ না পেয়ে গোস্বা। দলের রাজনীতি থেকে তিনি এখন দূরে।
চট্টগ্রাম থেকে কয়েক ডজন নেতার ঠাঁই হয়েছে বিএনপির কেন্দ্রে। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। অন্যদিকে স্থায়ী কমিটিতে স্থান না পেয়ে অভিমানে রাজনীতি ছাড়াও হুমকি দেন দলের ভাইস চেয়াম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান। সে থেকে তার নামের আগে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান লিখছেন না তিনি। তার বিভিন্ন কর্মকা-ের যে সংবাদ মিডিয়ায় পাঠানো হয় তাতে তাকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এক ধাপ এগিয়ে দলের ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন ও গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরীকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব করার কিছুদিন পর মোসাদের সাথে কথিত বৈঠকের অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় কারাবন্দি হন তিনি। জেলায় এখনও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। দক্ষিণ জেলাও চলছে পুরনো কমিটি নিয়ে। পৌরসবা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েও ভোটের দিন পর্যন্ত মাঠে থাকতে পারেনি বিএনপি। ফলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা এ দলটির তৎপরতা এখন সীমিত হয়ে পড়েছে।
বাবুল আক্তারের চাকরি হারাবার ঘটনাই আলোচনার শীর্ষে
স্ত্রীহারা হওয়ার পর পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের চাকরিহারা হওয়ার ঘটনাই ছিল ২০১৬ সালে চট্টগ্রামে আলোচিত সব ঘটনার শীর্ষে। কেন মাহমুদা খানম মিতুকে শিশু পুত্রের সামনে প্রকাশ্যে রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা হলো তা এখনও অজানা। আবার সততা ও পেশাদারিত্বের নজির স্থাপন করে দুইবার পুলিশের সর্বোচ্চ পদকপ্রাপ্ত (পিপিএম) কর্মকর্তা বাবুল আক্তার কেন পুলিশে নেই- সে রহস্যও এখনও অজানা।
গেল বছরের এগার মাসে মহানগরীতে ৮৬টি খুনের ঘটনা রের্কড হয়েছে। শতাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে জেলায়। গত কয়েক বছরের মতো আলোচ্য বছরটিতে স্বজনের হাতে স্বজন খুন অব্যাহত ছিল। স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতের স্বামী, সন্তানের হাতে পিতা-মাতা, ভাইয়ের হাতে খুন হয়েছেন ভাই। আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে শাসক দলের একাধিক কর্মী খুন হয়েছেন নিজ দলীয় কর্মীর হাতে।
এসব খুনের ঘটনাকে ছাড়িয়ে এখনও আলোচনায় মিতু হত্যা মামলা। দেশব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এই ঘটনা তদন্তে পুলিশের একের পর এক নাটকীয় ভূমিকা জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। গত ৫ জুন নগরীর জিইসি মোড়ের অদূরে ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে গিয়ে নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হন মিতু। খুনিরা প্রথমে গুলি করে এবং পরে কুপিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। এ ঘটনায় বাবুল আক্তার অজ্ঞাত পরিচয় তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
পুলিশ বলছে, ‘হত্যার পরিকল্পনাকারী’ কামরুল শিকদার ওরফে মুছাকে গ্রেফতার করা গেলে প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করা যাবে, মিলবে এসব প্রশ্নের উত্তরও। মুছাকে ধরিয়ে দিতে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। মোটা অংকের এই পুরস্কার ঘোষণার পরও মুছার সন্ধান মিলেনি। তবে মুছার স্ত্রীর দাবি, অনেক আগেই তার স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সে পুলিশ হেফাজতে এমন দাবিও করেছেন মুছার স্বজনেরা।
স্ত্রী খুনের পর বাবুল আক্তার দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ঢাকার বনশ্রীতে শ্বশুড়ের বাড়িতে উঠেন। ওই বাড়ি থেকে বাবুলকে গত ২৪ জুন ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর নানা গুঞ্জন ছড়ায়। তখন তার কাছ থেকে জোর করে পদত্যাগপত্র নেয়ার খবর ছড়ালেও সে বিষয়ে কেউই মুখ খুলছিলেন না। তার ২০ দিন পর গত ১৪ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানান, বাবুলের অব্যাহতির আবেদন তার কাছে রয়েছে। তার ২২ দিন পর ৬ সেপ্টেম্বর বাবুলকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
মিতু হত্যা মিশনে অংশ নেয়া নবী ও রাশেদ কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার পর আলোচিত এই হত্যা মামলার তদন্ত ঝিমিয়ে পড়ে। পুরস্কার ঘোষণার পরও মুছাকে পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ বলছে তার খোঁজে অভিযান থেমে নেই, তবে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। মুছার স্ত্রী তামান্না আক্তার জুলাই মাসের শুরুতে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, সাদা পোশাকে আসা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ২২ জুন সকালে বন্দর এলাকায় তাদের বাসা থেকে মুছাকে ধরে নিয়ে যায়। তামান্নার দাবি ২২ জুন মুছাকে ধরার পর তাকে ঢাকায় নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে ২৪ জুন তাকে বাবুল আক্তারের মুখোমুখি করা হয় বলেও দাবি করেন তিনি। তবে চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তারা এ দাবি বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন। তারা বলছেন, মুছাকে ধরা হয়নি, তাকে ধরতে অভিযান চলছে।
বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল ইয়াবাসহ হরেক রকমের মাদক উদ্ধারের ঘটনা। র্যাব-পুলিশের পাশাপাশি নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের হাতেও ধরা পড়ে বড় বড় ইয়াবার চালান। শুধু র্যাবের অভিযানে ধরা পড়ে অর্ধকোটি ইয়াবা ট্যাবলেট। মিয়ানমার থেকে সড়ক, সাগর ও পাহাড়ী পথে ইয়াবার চালান আসছে দেশে। ভারত থেকে আসছে ফেনসিডিলসহ হরেক মাদকদ্রব্য। মাদক ব্যবসায় শক্তিশালী নেটওয়ার্কের কারণে ঠেকানো যাচ্ছে না মাদকের ভয়াল আগ্রাসন।
মাদকের মতো আগ্নেয়াস্ত্রের চোরাচালানও ঠেকানো যাচ্ছে না। সীমান্ত পথে আসছে ভারী অস্ত্র। চট্টগ্রাম হয়ে আসা এসব যুদ্ধাস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে জঙ্গি আস্তানায়। র্যাব পুলিশের অভিযানে দেশি-বিদেশি অস্ত্রের চালান ধরা পড়ছে। তবে অক্ষত থেকে যাচ্ছে কালো অস্ত্রের সওদাগরি সিন্ডিকেটের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। হাত বাড়ালেই মিলছে অস্ত্র। অপরাধীদের ভা-ার এখন অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় সমৃদ্ধ। অস্ত্রের ঝনঝনানতিতে বাড়ছে নিরাপত্তা হীনতা।
পুলিশের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও ছিলো বছর জুড়ে আলোচনায়। স্বর্ণ ছিনতাই, ইয়াবা ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা করতে গিয়ে র্যাবের হাতে পুলিশ সদস্যের ধরা পড়ার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপার হয়। উদ্ধারকৃত ইয়াবা জমা না দিয়ে বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়েন এক এএসআই। এসব অপরাধে কয়েকজন পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। কতিপয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অনৈতিক কর্মকা- বিশেষ করে সাধারণ লোকজনকে ধরে এনে টাকা আদায়েরও অভিযোগ উঠে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন