শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

সর্বযুগের নেতা হযরত মোহাম্মদ (সা.)

বিশ্বময় ইসলামের জাগরণ

| প্রকাশের সময় : ৫ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নাজির আহমদ জীবন
(পূর্ব প্রকাশের পর)
জীবন ধারায় পরিবর্তন এবং পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর বিকৃতি ও পরিবর্তন এ দুই কারণে বিভিন্ন নবী-রাসূল এসেছেন নির্দিষ্ট যুগে নির্দিষ্ট স্থানের জন্য। একমাত্র মোহাম্মদ (সা.) সর্বযুগের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ জীবন ব্যবস্থা এনেছিলেন এবং পথ রেখে গেছেন আগামী দুনিয়ার মানুষের জন্য তাঁর শরীয়তকে যুগোপযোগী করে নেবার। তাই, রাসূলের শরীয়তের মূলনীতির মধ্যে ইজতেহাদ বা বিচার বুদ্ধির প্রয়োগ অনুমোদিত হয়ে আছে। তাই, ইজমা ও কিয়াস্ তথা ইজ্তেহাদকে আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করার নীতি ও কোরআন ও সুন্নাহ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- “হে জ্ঞানীগণ! তোমরা এসব ঘটনা থেকে চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর।’’ রাসূল, যখন হযরত মায়াজকে ইয়েমেনের শাসক হিসেবে প্রেরণের সময় জিজ্ঞাসা করেন,- “হে মায়াজ, কোন আইনের দ্বারা তুমি সেখানে বিচার ফয়সালা করবে? তিনি বললেন- আল্লহ্র কিতাব।’’ রাসূল বললেন, যদি তাতে না পাও? মায়াজ বললেন, তাহলে “রাসূলের হাদীস।” রাসূল, বললেন যদি তাতেও না পাও? তিনি বললেন, “আমি কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে নিজ বিবেক-বুদ্ধি মত গবেষণা করে সিদ্ধান্ত নিব।’’ রাসূল (সা.) জবাব শুনে বললেন, “আমি সে আল্লাহর প্রশংসা করছি যিনি তার রাসূলের প্রতিনিধিকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছার তওফিক দিয়েছেন যাতে আল্লাহর রাসূল সন্তুষ্ট হতে পারে।’’
তাই, এই ইজতেহাদের মাধ্যমে নতুন পরিস্থিতিতে পুরাতন জীবনকে আবার নতুন জ্ঞানের আলোকে পথ চলার জন্য ইসলাম সচেষ্ট। রাসূলের আদর্শ অনুসরণে ইজতেহাদের মাধ্যমে যুগ সমস্যার সমাধানে ইসলামের কার্যকারিতা লক্ষ্য করে যুগ শ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ দার্শনিক জর্জ বার্নাড়’শ বলেছেন- “ওঃ রং ঃযব ড়হষু ৎবষরমরড়হ যিরপয ধঢ়ঢ়বধৎং ঃড় ঢ়ড়ংংবং ঃযব ধংংরসরষধঃরহম পধঢ়ধনরষরঃু ঃড় ঃযব পযধহমরহম ঢ়যধংবং ড়ভ বীরংঃবহপব যিরপয পধহ সধশব রঃ ংবষভ ঃড় বাবৎু ধমব” ইসলাম একটি গতিশীল ধর্ম, যুগে যুগে কালে কালে এ ধর্ম মানুষের চলার পথে দেবে সকল প্রশ্নের জবাব। এজন্য মুজতাহিদের (গবেষণাকারী) জন্য দু’টি পুরস্কার। গবেষণার জন্য একটি, এবং অনুসন্ধান ও গবেষণা কাজের জন্য অন্যটি। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা, পারস্পরিক সমঝোতা রাসূলের চরিত্রে এটাও ছিল এক বড় বৈশিষ্ট্য। সামাজিক বিবর্তন সম্বন্ধে তিনি আশ্চর্যভাবে সচেতন ছিলেন। তাঁর একটা বিখ্যাত হাদিস : “বস্তুত তোমরা এমন এক যুগে আছ যখন তোমাদের কেউ যদি যা নির্দেশ করা হয়েছে তার এক-দশমাংশও ছেড়ে দেয় তার ধ্বংস অনিবার্য। কিন্তু এরপর এমন এক যুগ আসবে তখন তোমাদের কেউ যদি যা নির্দেশ করা হয়েছে তার এক-দশমাংশও পালন করে সে নিশ্চয়ই মুক্তি পাবে।’’ জিজ্ঞাসা করি সে যুগ কি আসেনি? দেড় হাজার বছর পূর্বের এ যুগ নেতা তাঁর অন্তদৃষ্টি দিয়ে মানব সমাজের এ ভবিষ্যৎ অবস্থা দেখতে পেয়েছিলেন তাই ধর্মীয় বিষয়েও তিনি গোড়ামির পরিচয় দেননি। জ্ঞান ও বিচার বুদ্ধির প্রয়োগ করতে বলেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, “রাসূল (সা.); নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, ওমরাহ এবং আরও সব নেকীর কথা উল্লেখ করে বলেন, মানুষ এসব কিছু করে ঠিকই কিন্তু কেয়ামতের দিন নিজের বুদ্ধি, জ্ঞান অনুযায়ী সে এসবের বদলা পাবে।’’ (মিশকাত শরীফ) পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- “রহমানের বান্দা হচ্ছে তারা যাদেরকে তাদের প্রতিপালকের আয়াত স্মরণ করে দিলে তারা অন্ধ ও কানার মতো তার উপর লুটিয়ে পড়ে না।’’ অর্থাৎ তারা জ্ঞান-বুদ্ধি ব্যবহার করে। তাঁর একটা বিখ্যাত হাদিস “নগরবাসীর বিরুদ্ধে পল্লীবাসীর সাক্ষ্য গ্রহণীয় নয়।’’ এখানেও তিনি অসাধারণ সমাজ সচেতনারই পরিচয় দিয়েছেন। এভাবে তাঁর পবিত্র জীবন আলোচনা করলে দেখা যাবে তিনি কেবল তাঁর যুগ ও জাতির কথা ভাবেননি। সমস্ত যুগের মানুষের কথা ভেবেছেন। স্থান-সময়-পরিবেশকে ভেবেছেন। মতাদর্শ রেখে গেছেন মানুষের সর্বযুগের সকল সমস্যা সমাধানের। তাই তিনি সর্বযুগের নেতা। মানুষের দৃষ্টি ও চিন্তাশক্তি যতোই উন্নত ও যুগোপযোগী হবে কোরআন-হাদিস উপলব্ধি ও মোহাম্মদী, মতাদর্শ গ্রহণ ততই সহজ হবে। ‘মোহাম্মদী’ গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে চিন্তার ক্ষেত্রে জড়ত্ব এবং একটি বিশেষ যুগ ও নির্দিষ্ট স্তরের জ্ঞানের মধ্যে সবকিছু সীমাবদ্ধ করে দেখা। কোরআন শরীফ যেমন একটা বিশেষ যুগ বা বিশেষ জাতির জন্য অবতীর্ণ হয়নি, তেমনি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র হাদিসগুলো পরবর্তী যুগে এর মর্মার্থ উপলব্ধির জন্য পূর্ববর্তী জ্ঞানের চেয়ে অধিক জ্ঞানের প্রয়োজন।
অর্থাৎ রাসূলের হাদিসগুলো বিভিন্ন যুগের জন্য। রাসূল (সা.) তাঁর অন্তদৃষ্টি দিয়ে মানবজাতিকে, মানব জগতকে সুন্দরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। কারণ, জন্মগতভাবেই তাঁর দৃষ্টিতে ছিল ‘বিশ্বজনীনতা।’ তিনি যে ছিলেন আল্লাহকর্তৃক প্রেরিত-বিশ্বনবী। আল্লামা ডক্টর ইকবাল সুন্দর বলেছেন, ‘‘বিশ্বনবী (সা.) প্রাচীন ও আধুনিক যুগের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে আছেন। ইল্হামের উৎসের সাথে যখন তাঁর সম্পর্ক জুড়ে দেয়া হয় তখন প্রাচীন জগতের সাথে তাঁর সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তাঁর ইলহামের স্পিরিট তথা ইলহাম লব্ধ চেতনাবোধকে যখন কাজে লাগানো হয় তখন এই আধুনিক জগতের সাথে তার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে যায়।’’
বর্তমানে বিশ্বে “গণতন্ত্র শব্দটি ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। তবে পশ্চিমা গণতন্ত্রের যে দ্বিমুখীতা তা কোন অবস্থায় বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য যথেষ্ট নয়। ইসলাম একনায়কত্ব অনুমোদন করে না। আল্লাহপাক সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন মুমিনদের কার্য পরিচালিত হবে পরামর্শের ভিত্তিতে।’’ (কোরআন) রাসূল, বলেছেন- “আল্লাহর শপথ আমরা কিছুতেই তাদের হাতে নেতৃত্ব অর্পণ করতে পারি না, যারা শুধু এটাই কামনা করে এবং এর প্রতি লোভ করে।’’ (বুখারি)
ইসলামী গণতন্ত্রের রূপ, পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র হতে পৃথক। আল্লামা ইকবালের মতে, গণতন্ত্রের ভিত্তি যদি রূহানীও নৈতিক হয় তা’হলেই তা হবে সর্বোৎকৃষ্ট রাজনৈতিক পদ্ধতি। ইসলামী রাষ্ট্রকে এ কারণেই তিনি রূহানী গণতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। রাসূল নিজে তাঁরপর কে সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত ব্যক্তি জানা সত্ত্বেও খলীফা নিযুক্ত করে যাননি। তিনি এ দায়িত্ব সাহাবাদের উপরই অর্পণ করে যান।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘জগতের বুকে ইসলাম সর্বোৎকৃষ্ট গণতন্ত্রমূলক ধর্ম। প্রশান্ত মহাসাগর হতে আরম্ভ করে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত সমস্ত মানবম-লকে উদারনীতির এক সূত্রে আবদ্ধ করে ইসলাম পার্থিব উন্নতির চরম উৎকর্ষ লাভ করেছে।’’ লেডী ইভলিন কোবাল্ট লন্ডনে বলেছেন, ‘ইসলামই সর্বাপেক্ষা বাস্তব ধর্ম। বর্তমান বিশ্বের বিভিন্নমুখী জটিল সমস্যার সমাধানের একমাত্র নিখুঁত উপায় হচ্ছে ইসলাম। ইসলামই একমাত্র সেই সহজ-সরল পুণ্য পন্থা যে পথে এই ধুলির ধরায় বেহেস্তি সুখ ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।’’
পৃথিবীতে অনেক নেতা, অনেক রাষ্ট্র নায়ক, অনেক মহামানব জন্ম নিয়েছেন, কিন্তু তাদের কৃতিত্ব বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুন্দরভাবে সফল হয়েছেন একমাত্র হযরত মোহাম্মদ (সা.)। পৃথিবীতে এ যাবৎ কোন মহামানব; কোন নেতা; এত বড় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এ স্বল্প সময়ে আনতে সক্ষম হননি এবং তার স্থায়িত্বও এত নয়। তাই আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইহুদি অধ্যাপক জুলুস ম্যাসার ম্যান বলতে বাধা হয়েছেন- “সম্ভবত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হচ্ছেন মোহাম্মদ।’’
ফরাসি লেখক আলফ্রেড দেলা মার্টিন তার লিখিত বই- ‘দি হিস্টরি অব তুর্কী’ গ্রন্থে লিখেছেন, “উদ্দেশ্যের মহত্ব, উপকরণের স্বল্পতা এবং বিস্ময়কর সফলতা, যদি এ তিনটি বিষয়ই মানব প্রতিভার মানদ- হয়, তাহলে ইতিহাসের অন্য কোন মহামানবকে এনে মোহাম্মদের সাথে তুলনাকরার এমন সাহস কার আছে?’’ আজ সারাটা বিশ্বজুড়ে যে দু’টি শব্দ বেশি উচ্চারিত হচ্ছে তা হলো- ‘শান্তি ও মানবাধিকার।’ এ শব্দ দু’টি পরস্পর পরিপূরক। ‘শান্তি’ এ শব্দটি বড় অর্থবোধক ও বড় ব্যাপক। আজ বিশ্বশান্তি ধুলায় লুণ্ঠিত, বিশ্ব মানবতা ও মানবাধিকার সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে বন্দি। আমরা আজ আমাদের নিজস্ব মনগড়া মতবাদের ভিত্তিতে এর সমাধান খুঁজছি। তাই, বার বার ব্যর্থ হচ্ছি। বিশ্বশান্তি খুঁজতে হলে ‘শান্তি ও মুক্তির চাবি’ যার হাতে তার সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তিনি হলেন- হযরত মোহাম্মদ (সা.)।‘ইসলাম’ শব্দ উৎপন্ন হয়েছে- ‘ছল্ম’ থেকে যার অর্থ শান্তি। আর সে শান্তি বাস্তবায়নের উজ্জ্বল উদাহরণ হলেন মোহাম্মদ (সা.) তাই, মুসলমানদের পারস্পরিক অভিবাদন হলো ‘সালাম’।
তিনি বলেছেন, ‘কোন অমুসলিম নাগরিককে যে অত্যাচার করলো বা তার অধিকার ক্ষুণœ করলো বা তাকে সাধ্যাতীত পরিশ্রম করালো বা তার অমতে তার থেকে কিছু নিয়ে নিলো, কিয়ামতের দিন আমি হব তার বিপক্ষে মামলা দায়েরকারী।’’ অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করা সম্পর্কে রাসূল বলেছেন’’ যে কোনো সংখ্যালঘুকে হত্যা করিবে সে বেহেস্তের সুঘ্রাণ উপভোগ করতে পারবে না। অথচ বেহেস্তের সুঘ্রাণ চল্লিশ বছরের দূরত্ব হতেও অনুভব করা যাবে।’’ আরো বলেছেন, ‘যে সংখ্যালঘুকে উত্ত্যক্ত করলো সে আমাকে উত্ত্যক্ত করলো, আর যে আমাকে উত্ত্যক্ত করলো আল্লাহকেই সে উত্ত্যক্ত করলো।’’ (দ্রঃ অমুসলিমদের প্রতি ইসলামের উদারতা- ডঃ ইউসুফ কারযাভী) আজ বিশ্ব মানব সমস্ত মানব গড়া মতবাদ হতে নিরাশ হয়ে একটা যুগপোযোগী, সুন্দর মতাদর্শের দিকে এগিয়ে আসছে। আর তা হলো- ‘মোহাম্মদী মতাদর্শ।’ একদিন সমগ্র সৃষ্টির সূচনা হয়েছিল মোহাম্মদ (সা.)-এর নূর হতে। সমগ্র আত্মা আত্মার জগতে তাঁকে স্বীকার করে নিয়েছিল। আজও আবার সমগ্র বিশ্ব মানব তাঁর দিকে ধাবিত হচ্ছে। রাসূল বলেছেন “সব জিনিসই তার আসলের (মূলের) দিকে প্রধাবিত হয়।’’ বিজ্ঞান বলে ‘সকল বস্তু তার মূল বা কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।’ আজ তাই আমরা আবার তাঁর দিকে এগিয়ে চলেছি, তাঁকে সর্বযুগের নেতা হিসেবে গ্রহণ করতে এবং তাঁকে ভালোবেসে তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। তবে, তাঁর অনুসরণ হতে হবে যুগোপযোগী, অন্ধ অনুসরণ নয়। এটাই বলে গেছেন বারো শরীফের মহান ইমাম হযরত শাহ সূফী মীর মাস্উদ হেলাল (রা.)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Shahidur Rahman ৫ জানুয়ারি, ২০১৭, ১১:৪৬ এএম says : 0
100% right
Total Reply(0)
Mohammed Shah Jahan ১৯ জানুয়ারি, ২০১৭, ১১:২১ এএম says : 0
Yes. Islam is the best.
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন