ড. এস এম লুৎফুর রহমান : অনেকেই জানেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী খুব উদার লোক ছিলেন। ছিলেন সত্যবাদীও। তাই তিনি মহামহোপাধ্যায় প-িত হয়েও বাঙালা ভাষা যে ‘সংস্কৃতের সন্তান’ নয়, সে-কথা সেকালের ব্রাহ্মণ প-িতদের মুখের ওপর বলতে দ্বিধা করেননি। লিখিতভাবেও বলেছেন। দীনেশচন্দ্র সেন ও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া সে যুগের আর কোনো ব্রাহ্মণ প-িত এ কথা এত স্পষ্টভাবে বলার সাহস দেখাননি। সে-কারণে তাকে মোবারকবাদ দিতেই হয়।
কিন্তু বাঙালা ভাষার মূল কোথায়, তাও তিনি বলেননি। তবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এর আগে মুসলমানদের যে একটা নিজস্ব ভাষা আছে, আর তার একটা “খিঁচুড়ি রকম সাহিত্য” আছে; তা তিনি ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’-এর সভায় দাঁড়িয়ে না বলে পারেননি। ১. ড. সুকুমার সেন এ ভাষাকে বলেছেন, ‘ইছলামী বাংলা’ আর এর সাহিত্য-রূপকে বলেছেন, ‘ইসলামী বাংলা সাহিত্য’, ‘পুঁথি সাহিত্য’ ইত্যাদি। ২. মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শস্ত্রী ওই বাঙালাকে বলেছেন, ‘কিতাবতী বাঙালা’। ৩. এ-বাঙালার সাথে যে তার আবাল্য পরিচয় ছিল তা না বললেও চলে। তার নজির দিতে ১৮৮৭ সালে ‘বিভা’ নামে একটা সাধারণ পত্রিকায় ওই কিতাবতী বাঙালার ‘খিঁচুড়ি রকম সাহিত্যে’র৪ পরিচয় দেবার জন্য একখানি ছাপানো ‘কলমী পুঁথি’র আলোচনা করেন। পুঁথিখানির নাম “শুজ্জু উজাল বিবির কেচ্ছা”।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, তখন অপরাপর বড় ‘মুছলমানী কেতাব’ থাকা সত্ত্বেও পুঁথি-সাহিত্যের পরিচয় দিতে এবং মুসলিম কবিদের ‘যোগ্যতা দেখাতে’ এ-পুঁথিখানিকেই বেছে নিলেন কেন, তা বলা মুশকিল। আমাদের ‘শুজ্জু’, ‘উজাল’, ‘বিবি’, ‘কেচ্ছা’ শব্দগুলোই হয়তো তার মনোযোগ আকর্ষণের বিশেষ কারণ হয়েছে। ওই শব্দগুলোই তার ‘নেক নজর’ কেড়েছে।
যাহোক, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ওই লেখা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ ছিল খুবই কম। কেননা, ১৯-২০ শতকের মুসলিম পুঁথি-সাহিত্যের বিশাল ভা-ার এখন শূন্য-প্রায়। এখন কোনো পুঁথি চাইলেই হাতে পাওয়া যায় না। লাখ লাখ পুঁথির মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ হাজার পুঁথির একটা কালেকশন কোথাও মেলে না। তাই এ-পুঁথি কোথাও পাওয়া যাবে বলে ভাবিনি। কিন্তু সুখের বিষয়, ‘মুছলমানী পুঁথি’ খুঁজতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে এর একটা কপি পেয়ে যাই। কেতাবখানি ছাপা, ছোট এবং নামপাতাহীন। তাই এর আদি রচনাকাল, প্রকাশকাল, মুদ্রণ স্থান কিছুই ঠিকঠাক জানার উপায় নেই।
তবে হাতে পাওয়া ‘ছহি করা’ বইখানি যে ঢাকার চকবাজার-কেতাব পট্টি থেকে এম আবদুল লতিফ ও আবদুল হামিদ ছেপে প্রকাশ করেছেন, তা একটা বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়। পুঁথির শেষে ছাপা ওই বিজ্ঞাপন থেকে আরও জানা যায়, ‘কোরআন-কেতাব প্রকাশক হামিদিয়া লাইব্রেরি এ-কেতাবের প্রকাশক ও পরিবেশক। কিন্তু বিজ্ঞাপনে প্রকাশকালের উল্লেখ না থাকায় কেতাবখানির সংস্করণ ও রচনাকাল বা প্রকাশকাল নির্ণয় করা অসম্ভব।
মোট কুড়ি পৃষ্ঠার এ-কেতাব নিয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছাড়া আর কেউ কোথাও আলোচনা করেছেন কিনা সন্দেহ। ড. আহমদ শরীফ সম্পাদিত বিরাট ‘পুঁথি-পরিচয়’ গ্রন্থে এ কেতাবের নাম-ই নেই।৬ নাম নেইÑ ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের ‘মুসলিম বাংলা সাহিত্যে’ও। আজহার ইসলামের ‘মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবি’৮ বা ড. মুনতাসীর মামুনের “উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গে মুদ্রিত পুঁথি”-তেও এর নাম গরহাজির।৯ ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুমের ‘ঢাকার কয়েকজন পুঁথি রচয়িতা’ নিবন্ধেও এর হদিস নেই। মরহুম আলী আহমেদের ‘বাংলা কলমী পুঁথির’ বিবরণ১১ অথবা ড. আনিসুজ্জামানের ‘মুসলিম বাংলা সাহিত্যে’ও নেই এর নামধাম।১২
ড. সুকুমার সেন, ‘ইসলামী বাংলা সাহিত্যে’ এ কেতাবের নাম উল্লেখ করলেও কোনো আলোচনা করেননি। তিনি পুঁথিখানির রচনাকালে বলেছেন- ১৮৬৭ খ্রি. অব্দ।১৩ মুসলিম গবেষকদের মধ্যে নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান, তার ‘বাঙ্গালা সাহিত্যে’র নুতন ইতিহাস এ কেতাবখানির প্রকাশকাল লিখেছেন ১৮৮০ সাল। আর কবির নাম বলেছেন বক্তিয়ার খান। তার ভাষায় ‘শুজ্জ উজাল বিবির পুঁথি, বক্তিয়ার খান, ১৮৮০।’১৪ অপরদিকে ড. সুকুমার সেন আলোচ্য কেতাবের লেখক পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, “নয়ান, মোহাম্মদ এরাদত খান ও বক্তিয়ার খানের ‘সুর্জ্জু উজাল বিবির পুথি’।”১৫ নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ানও পুঁথির নাম ঠিকঠাক লেখেননি। তিনি অন্যত্র, অন্য প্রসঙ্গে এ-কেতাবের নাম লিখেছেনÑ “সূর্য্য উজাল বিবির পুঁথি” ইত্যাদি।
এ আলোচনা থেকে দেখা যায়, পুঁথিখানির প্রকৃত নাম কেউ-ই যথাযথভাবে লেখেননি। আমাদের প্রাপ্ত পুঁথির নাম “ছহি সুর্জ্জ উজাল বিবির পুঁথি।”
শাস্ত্রীজি পুঁথিখানির প্রকৃত নাম ঠিকঠাক লেখেননি এবং তিনি যে-অংশ কোট করেছেন, তার মধ্যে কয়েকটি শব্দও বিকৃত। এ রচনার সাথে সংযুক্ত কেতাবের ওই অংশে নজর দিলে তা স্পষ্ট হবে। যথা-
“আল্লা ২ বল ভাই যত মোমিনগণ ॥
সুর্জ্জ উজাল বিবীর কথা শুন দিয়া মন*
সুর্জ্জ উজাল বিবী যদি সুর্জ্জ পানে চায় ॥
দেখিয়া আছমানের সুর্জ্জ সেই লজ্জা পায়
সুর্জ্জ উজাল বিবী এয়ছাই রঙ্গ লাল ॥
আছমানের চন্দ্র দেখে হয় ময়লা হাল।”২১
খেয়াল করলে দেখা য়ায়, “ছহী পাঠের থেকে শাস্ত্রীর পাঠের ছটি স্থানে পাঠ-বৈষম্য প্রকট। এক নাম- শব্দ ‘সুর্জ্জরই তিনটি বিকৃতি। “শুর্জ্জু”, “শুজ্জু”, “শুজ্জ”। একচরণ ব্যবধানে “আছমানে”র শব্দটি দুরকম বানানে লেখা। দোছরা চরণে “কথা শুন” হয়েছে “কিছু শুনা”। ফলে না আছে ছন্দ, না হয়েছে অর্থ। “বিবী এয়ছাই”- শাস্ত্রীজির কোটেশনে “বিবি এর ছাই” এবং লাল হয়েছে “নাল”। একইভাবে তিনি পুঁথির কাহিনী-পরিচয় দিতে গিয়ে আরও যে আটটি কোটেশন দিয়েছেন তাও বিকৃত ও ভুল গলতিময়। অপরদিকে, নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান ভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচ্য কেতাবের যে ছটি চরণ কোট করেছেন তা এরকমÑ
“পহেলা করেছে সাদী মল্লিকা আকার।
তারপরে করে সাদী জৈগুণ সুন্দর ॥
সমর্ত্তভানে করে সাদী জোরে পরোয়ান।
তারপরে করে সাদী বিবি সোনাভান ॥
পবন কুমারী বিয়া করে আপনার জোরে।
এই পঞ্চ বিবি দেখ হানিফার ঘরে ॥”২২
এর সাথে সংযুক্ত পুঁথির নিচেয় উদ্ধৃত পাঠ লক্ষণীয়। যথা-
“পহেলা ক’রেছে সাদি মল্লিকা আকার ॥
তারপরে করে সাদি জৈগুন সুন্দর
সোমর্ত্তভানে করে সাদি জোরে পাহালওান ॥
তারপরে করে সাদি বিবী সোনাভান*
পবন কুমারী বিভা করে আপনার জোরে ॥
এই পঞ্চ বিবী দেখ হানিফার ঘরে।
উপরের কোটেশনটি নিচের কোটেশনের সাথে মিলালে দেখা যায়, ‘সাদি’ বানান চারবার মূল থেকে বদলিয়ে ‘ছহি’ (শুদ্ধ) করা হয়েছে। তারপর দ্বিতীয় চরণের “জৈগুন” এর “গুন” কে করা হয়েছে “গুণ”। তৃতীয় চরণের “সোমর্ত্তবান”কে করা হয়েছে “সমর্তভান” এবং একই চরণের “পাহালত্তান” কে বানানো হয়েছে “পলোয়ান”। চতুর্থ ও ষষ্ঠ চরণের “বিবী” শব্দটিও “বিবি” লেখা হয়েছে। আর পঞ্চম চরণের “বিভা”কে ‘ছহি’ করে বদলে লেখা হয়েছে “বিয়া”। অবাক ব্যাপার হলোÑ শাস্ত্রী মশায় “অশিক্ষিত মুছলমানরাও বাংলা ভাষায় বহুতর পুস্তক লিখিয়া থাকেন”, কী করে বললেন, তা ‘আক্কেল গুড়–ম কা বাত’। কারণ ‘দুনিয়ার কোন দেশে কোন ভাষায় আজতক কোন অশিক্ষিত ব্যক্তি একখানা বইয়ের একটা পাতাও লিখতে পেরেছেন বলে ‘গিনেস বুক’-সূত্রেও জানা যায় না। তার ওপর তাদের লেখায় থাকে ‘অনেক উরদু, আরবী ও ফারছী শব্দ মেশানো’। লেখকের এই উরদু-আরবী-ফারছী শব্দগুলোর ওপর যে খুব-ই ঘেন্না; তা পষ্ট। আর সে-কারণেই তিনি তাদের ভাষাÑ ‘মুছলমানী বাঙালা’-কে বলেছেন “অশিক্ষিতদের ভাষা”। তা হলে, সহজেই প্রশ্ন করা যায়, এ অশিক্ষিতরা আরবী, ফারছী, উরদু, হিন্দী শব্দ শিখল কি করে? লিখলই বা কি করে? অথবা তা, হাজার হাজার বই-কেতাবে ঢোকালো কারা, কি করে? কখনো কখনো শিক্ষিত কবিরা হয়তো বিশাল বাঙালা-সংস্কৃত অভিধান খুলে শব্দ বেছে নিয়ে কবিতা লিখতে পারেন বা লিখেছেনÑকিন্তু ‘অশিক্ষিত’ মুছলিম গ্রাম্য কবিদের তো সে সুযোগ ছিল না। আরবী, ফারছী, উরদু, হিন্দী শব্দভরা সে-রকম কোন বাঙালা অভিধান সেকালেও ছিল না, একালেও নেই; যার মধ্যে ‘মুছলমানী বাংলা’য় লেখা, মুছলমানী পুঁথির সব শব্দই পাওয়া যায়। তাহলে শব্দগুলো এলো কোথা হতে?
বলা দরকার যে, লেখক বিদায় হলেও আমরা তার পাছ ছাড়তে পারছি না। কারণ তিনি তার আলোচনার মধ্যে ‘নামাজ’কে লিখেছেনÑ ‘নমাজ’ ও ‘নেমাজ’। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কাছে ‘নামাজ’ শব্দটা লেখা খুব-ই কঠিন ছিল কি?
তাছাড়া, তিনি তার আলোচনা ও কোটেশনের মধ্যে আরও অসঙ্গত ও ভুল-কথা, ভুল শব্দরূপ ব্যবহার করেছেন। তিনি তার আলোচনায় “সাদোয়ান” শব্দ “খানার অধিষ্ঠাত্রী দেবতা”-অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। তার না জানার কথা নয়, মুসলমানদের এক আল্লাহ ছাড়া আর কোনো দেব-দেবতা নেই। ‘সাদোয়ান’ কোন-ফেরেশতা-দেবতা নয়; ছেরেফ ভাত মাত্র। ছোটবেলায় মা-নানীর মুখে এ শব্দ বহুবার শুনেছি।
এক-ইভাবে, তিনি তার আলোচনার মধ্যে “মেহমানি-যজ্ঞে”র কথাও বলেছেন। ‘মেহমানি’ হলোÑ ‘মেহমানদারি’; মেহমানকে খাওয়ানো। আপ্যায়ন করা। তা কোনো “যজ্ঞ” কর্ম নয়। আর “মেহমান” মানে আত্মীয়-কুটুম্ব বা অতিথি। মেহমান ও ‘মেজবান’-এর মধ্যে ফারাক আছে। একজন বা কয়েকজন ব্যক্তি কারও বাড়িতে এলে তাদের ‘মেহমান’ বলে; আর বহু ব্যক্তি কোনো লোকের দাওয়াতে এসে আহারাদি করে আপ্যায়িত হলে; তাদের বলে ‘মেজবান’। তাদের ওই ভোজনাদিকে বলে ‘মেজবানি’। এর কোনোটাই “যজ্ঞ” নয়।
আমরা আগেই বলেছি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-মীর মশাররফ হোসেনও তার ‘আরবী-ফারছী-উরদু শব্দ বাদ’ দিয়ে লেখা, “বিষাদ-সিন্ধু” এবং “বসন্ত কুমারী নাটক”-এর তারিফ করেছেন। তার মানে, তিনি মুসলমানদের বললেও আরবী, ফারছী, উরদু শব্দ বাঙালা ভাষায় থাকুকÑ তা চাননি। তার ছাফ উদ্দেশ্য মুসলমানদের মধ্যে আরবী, ফারছী ও উরদু ভাষার চর্চা বন্ধ হোক। অথচ ওই তিন ভাষার শব্দ হিন্দুরা লিখলে, তাতে তিনি কখনও আপত্তি করেননি। নাখোশ হননি। তার যত রাগ কেবল মুসলিম কলমে ফারছী-বাঙালায় লেখা পুঁথিগুলোর ওপর; সেগুলোয় নিহিত আরবী, ফারছী, উরদু শব্দের ওপর। তাই শায়েরী কাব্যের কবিরা, অনেকে অতি উচ্চশিক্ষিত এবং আরবী, ফারছী, উরদু ও বাঙালা ভাষায় বিশেষজ্ঞ হলেও তারা তার কাছে ‘অজ্ঞ’, ‘মূর্খ,’ ‘অশিক্ষিত’ এবং ‘নিন্দিত’। আলিম-মুয়াল্লিম, মুন্্শী, মৌলভী, পীর, কাজী, শেখ, ছৈয়দ-কবি-কাতেবান-বিদ্বেষী মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে, ফারছী-বাঙালায় লেখা গোটা পুঁথি-সাহিত্য বিরোধী হবেন, সেটাই স্বাভাবিক।
এ-কারণে, আগেই বলা হয়েছে, তিনি প্রথম শ্রেণীর কোনো পুঁথি-কেতাব বেছে না নিয়ে অতি অখাস্তা একখানি পুঁথি বেছে নেন, যা উদ্দেশ্যমূলক একটি নির্বাচন। শাস্ত্রী মশায় হয়তো এ পুঁথির নায়ক হানিফাÑ(একটি কাল্পনিক চরিত্র)র পাঁচ বিবি (ইছলামে চার বিবি) রাখার নীতিহীনতা এবং তার কামুকতার পরিচয় তুলে ধরার জন্যই এ তুচ্ছ কেতাবখানির ওপর নেক নজর দিয়েছেন। তাকে আমরা জানাতে চাইÑ কাহিনীটা পুরোপুরি কাল্পনিক। একমাত্র হযরত আলী ও ফাতিমা ব্যতীত অন্য কোনো চরিত্রই বাস্তব নয়। ঐতিহাসিক নয়। তাই নায়ককে ইছলাম-বিরোধী বিয়ে-পাগল ও কামুক তথা নিন্দনীয় প্রশংসনীয় কোনোটাই ভাবার কোন অবকাশ নেই।
পরিশেষে, শাস্ত্রীজী সম্পর্কে এটুকু জানা ও জানানোর দরকার যে, তিনি বিশ শতকের পহেলা দশকে যে উদারতা নিয়ে “মুছলমানী বাঙালা”র সমর্থন করে বলেছিলেনÑ “চলতি মুসলমানি শব্দগুলো তোমরা তাড়াইবে কেন? তাড়াইবার তোমাদের কি অধিকার আছে? যে সকল শব্দ তিন, চার, পাঁচশত বৎসর হইতে চলিয়া আসিতেছে, তাহাদের তো ভাষায় থাকিবার কায়েমী স্বত্ব জন্মিয়া গিয়াছে।”৩০... সে উদারতা পরে আর তার ছিল না। ‘মুসলমান’ ও ‘মুছলমানী বাঙালা’র প্রতি তার নেক নজরের বদলে নষ্ট নজর পড়েছিল। তাই গোলাম আহমাদ মোর্তজা বলেছেনÑ “হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে প্রচারিত নেতার নাম ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। কিন্তু তারও পূর্বে মুসলিম-বিরোধিতায় উৎকট সাম্প্রদায়িক (মুছলিম-বিদ্বেষী) একটি দল তৈরি হয়েছিল ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদের নেতৃত্বে। সেই দলটির নাম- “অখিল ভারত হিন্দুসভা।”৩১ তাতে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
আর ‘মুছলমানী বাঙালা’ নিপাক করার কাজে তার অনন্য ভূমিকার বয়ান দিতে ভারতীয় বাঙালার লেখক গোলাম আহমাদ মোর্তজা আরও লিখেছেনÑ “মুসলমান আমলে সারা দেশের লোক স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে বাংলা ভাষা ব্যবহার করত, তাতে স্বাভাবিকভাবেই আরবী, ফারছী, উরদু শব্দ যুক্ত হয়েছিল। ওই সহজ কথোপকথনের ভাষাকে ‘মুসলমানি’ ভাষা মনে করে; আরবী, ফারছী, উরদু শব্দগুলোকে সরিয়ে দিয়ে সেই জায়গায় মনগড়া ব্রিটিশ কল্পনাপ্রসূত যেসব সংস্কৃত শব্দ আমদানি করা হয়েছিল, তার শ্রেষ্ঠতম নায়ক ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।”৩২ আর এ-কারণেই “সুর্জ্জ উজাল বিবি”র ওপর পড়া, তার বিশেষ নজরকে ‘নেক নজর’ বলা হয়েছে।
লেখক : গবেষক, সাবেক অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন