লায়ন অধ্যক্ষ ডা. বরুণ কুমার আচার্য : ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন চট্টগ্রামে তেমন সাংগঠনিক রূপ না পেলেও সক্রিয় প্রতিবাদে মুখর ছিল। তমদ্দুন মজলিসের চট্টগ্রাম শাখাই এ সময় ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। তমদ্দুন মজলিসের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সোলায়মান খান, এজাহারুল হক, সাদেক নবী, মঈনুল আহসান সিদ্দিকী (মন্টু), চৌধুরী শাহাবুদ্দীন আহমদ খালেদ, মাহফুজুল হক, মো. ইব্রাহীম, শাহ ওবায়দুর রহমান, মকসুদুর রহমান প্রমুখ এ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। চট্টগ্রামে তখন তমদ্দুন মজলিসের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। মোমিন রোডে অবস্থিত তমদ্দুন মজলিসের অফিসে সে সময় প্রায়ই সভা হতো। এমএ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী বিরোধীদলীয় যে কোন আন্দোলনে খুবই সক্রিয় ছিলেন। তমদ্দুন মজলিসের সাথে আদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সহযোগিতার হাত প্রসারের ক্ষেত্রে দ্বিধা করতেন না। চট্টগ্রামে ১৯৪৭-৪৮ সালেই তমদ্দুন মজলিসের শাখা গঠিত হয় চট্টগ্রাম ডিগ্রি কলেজের ছাত্র সোলায়মান খানের উদ্যোগে। সোলায়মান খান ছাড়াও চট্টগ্রাম তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক চৌধুরী শাহাবুদ্দীন খালেদ, ড. মাহফুজুল হক, ইব্রাহীম চৌধুরী, অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সোলায়মান প্রমুখ ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামে তমদ্দুন মজলিসের আজিজুর রহমানের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা ছিল। মজলিসের তফাজ্জল আলী, ডা. মুহাম্মদ আলী, আহমদ ফরিদ (সাবেক রাষ্ট্রদূত), এজাহরুল হক, হাসান ইকবাল, সাদেক নবী, মঈনুল আহসান সিদ্দিকী (মন্টু), আহমদ ছগীর, মোহাম্মদ নুরুল্লাহ, হাবীবুর রহমান, মাওলানা হাসান শরীফ, সৈয়দ মোস্তফা জামাল, আবদুর সাত্তার চৌধুরী প্রমুখের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল। বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির প্রথমভাগে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন গোলাম আকবর চৌধুরী (তমদ্দুন মজলিস), এমএ হালিম, আবদুল ওয়াদুদ, আবদুল হাই, ফরমান উল্লাহ খান ও এএনএম নুরুন্নবী প্রমুখ। এই কমিটি ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আন্দরকিল্লাস্থ তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন সাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী এবং যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন তমদ্দুন মজলিস নেতা ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান। আন্দোলন শুরু হলে মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী চিকেন পক্সে আক্রান্ত হলে তমদ্দুন মজলিস নেতা আজিজুর রহমান ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। সকল শ্রেণীর পেশাজীবী সংগঠন, কৃষক-শ্রমিক সংগঠন, আওয়ামী মুসলিম লীগকেও তমদ্দুন মজলিসের প্রতিনিধিদের এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের অন্যদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিলেন : জুহুর আহমদ চৌধুরী (আওয়ামী মুসলিম লীগ), মোজাফফর আহমদ (আওয়ামী মুসলিম লীগ), ডা. আনোয়ার হোসেন (শিল্পপতি), আজিজুর রহমান (গোরা আজিজ), চৌধুরী হারুন-আর-রশিদ, ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান (তমদ্দুন মজলিস নেতা), হাবিব উল্লা (তমদ্দুন মজলিস/পরে সাংবাদিক), নুরুজ্জামান, কৃষ্ণগোপাল সেনগুপ্ত (কালা চাঁদ), শামসুদ্দিন আহমদ, মফিজুল ইসলাম, রুহুল আমিন নিজামী, ইয়াহিয়াহ খালেদ (তমদ্দুন মজলিস), এমএ মান্নান (তমদ্দুন মজলিস নেতা ও পরে আওয়ামী লীগ নেতা), এমদাদুল ইসলাম, আবু জাফর, ডা. সাইদুর রহমান, আমির হোসেন দোভাষ (ভাষা আন্দোলনে অর্থ সাহায্যকারী), এজাহারুল হক প্রমুখ। আন্দরকিল্লাস্থ বর্তমান দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়টিই (তখনকার আওয়মী লীগ অফিস) ছিল তৎকালীন সংগ্রাম পরিষদ দফতর। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী, ২১ ফেব্রুয়ারি দেশের অন্যান্য জেলার মতো সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে চট্টগ্রামে হরতাল-মিটিং-মিছিল এবং লালদীঘি মাঠে জনসভার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এই কর্মসূচির প্রস্তুতি পর্যায়ে সার্বক্ষণিক কাজ করেছেন আজিজুর রহমান (তমদ্দুন মজলিস), ফরিদ আহমদ (তমদ্দুন মজলিস) এবং আজিজুর রহমান (লাল আজিজ)। কর্মসূচি সফল বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এই দু’জন ১৯ ফেব্রুয়ারি ডক শ্রমিকদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে বন্দর এলাকায় গমন করেন এবং শ্রমিকদের মাঝে বক্তব্য রাখেন। এরপর মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে ২০ ফেব্রুয়ারি তার অনুপস্থিতিতে তমদ্দুন মজলিস নেতা আজিজুর রহমান সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি রাতদিন পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে পোস্টার লাগানো হয়। পাড়ায় পাড়ায় অবস্থিত ক্লাব ও সংগঠনগুলো হরতাল সফল করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। কর্মসূচি অনুযায়ী বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ও আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তনের প্রচেষ্টার প্রতিবাদে ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সমস্ত দোকানপাট যানবাহন, সরকারি অফিস-আদালত ও স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি এখানে পূর্ণ দিবসে হরতাল পালিত হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি সমগ্র জেলাব্যাপী পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সকল প্রকার যানবাহন, স্কুল-কলেজ, দোকানপাট, অফিস-আদালত এবং কলকারখানা বন্ধ থাকে। বেলা বারোটার দিকে পাহাড়তলী রেলওয়ে লোকোশেডের কাছে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতির খবর পেয়ে তমদ্দুন মজলিস নেতা আজিজুর রহমান এবং সংগ্রাম পরিষদ সেখানে ছুটে যায়। তখন তমদ্দুন মজলিসের নেতা তোফাজ্জল আলীর নেতৃত্বে কয়েকজন কর্মী রেললাইনের উপর শুয়ে পড়েন এবং অন্যরা বিভিন্ন শ্লোগান দেন। ফলে সকাল থেকে রেল চলাচল বন্ধ থাকে। পরিস্থিতি গুরুতর অবনতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ভেবে সংগ্রাম পরিষদ নেতৃদ্বয় তোফাজ্জল আলী ও অন্য কর্মীদের বোঝাবার চেষ্টা করেন যে, এক বেলা তো ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়েছে, এটাই বড় সাফল্য এবং এখন ট্রেন ছেড়ে যেতে পারে। কর্মীদের মাঝে তখনো চরম উত্তেজনা বিরাজ করছিল।
সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়। চট্টগ্রামের সাতকানিয়াতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি স্কুল ও কলেজে পূর্ণ ধর্মঘট পালন করা হয় এবং হাইস্কুল মাঠে এক সভায় অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ও আরবি হরফে বাংলা লিখার প্রতিবাদ করা হয়। ঐ দিন ছাত্রদের এক বিরাট মিছিল শহরের রাস্তাসমূহ প্রদক্ষিণ করে। এ সময়ে সাতকানিয়া তমদ্দুন মজলিস ও কলেজ ইউনিয়ন কমন রুমের তৎকালীন সম্পাদক সৈয়দ মোস্তফা জামাল (পরবর্তিতে সাংবাদিক ও ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির সাধারণ সম্পাদক)-কে আহ্বায়ক করে রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠন করা হয়। সাতকানিয়াতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ মোস্তফা জামালের নেতৃত্বে ধর্মঘট ও প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ঐ দিন বিকেলে বার লাইব্রেরি ময়দানে আজিজ আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৫ মার্চ, ১৯৫২ তারিখে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সাতকানিয়াতে শহীদ দিবস পালন করা হয়। তমদ্দুন মজলিস কর্মী মুহম্মদ হাবীব বিন খলিল ও কাজী রইস উদ্দিন আহমদ এ সময়ে ভাষা আন্দোলন সংগঠনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অবদান ছিল অপরিসীম। ভাষা আন্দোলনেও তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিসের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। মুসলিম লীগের সকল অপকর্মের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার ছিলেন। আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের বিরোধিতায় তারা সোচ্চার ছিলেন। আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের বিরোধিতায় তারা অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। পঞ্চাশের দশকে শহরের প্রতিটি স্কুল-কলেজে তমদ্দুন মজলিসের সক্রিয় শাখা থাকায় এই আন্দোলনে মজলিস কর্মীদের বিশেষ ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়। মূলত ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে পরবর্তিতে স্বাধীনতা ও আজকের বাংলাদেশ। এটি বাঙালি জাতির জন্য পর্বত সমতুল্য গৌরব ও অহঙ্কার। পৃথিবীতে বাঙালি একমাত্র জাতি যারা মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে।
লেখক : সভাপতি, চট্টগ্রাম সাহিত্য ও সমাজ অনুশীলন কেন্দ্র।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন