জুবাইদা গুলশান আরা : বিকেলটা জুড়ে হৈহল্লা চলছে। পাড়ার ছেলে-ছোকরা তো একটাও ঘরে নেই। সবাই বেরিয়ে গেছে। সারা এলাকা জুড়ে, শহর জুড়ে শুরু হয়েছে উৎসব। অন্যদিকে ফাল্গুনের দিন এসে গেছে। কড়া রৌদ্দুর রিকশা-স্কুটারের জ্যাম, লোকের বেশুমার ভিড়। শহরটা হাঁসফাঁস করে। ছেলেরা ডিগবাজী খায় খুশীতে। এরই মাঝখানে পাতার আড়াল থেকে ডেকে ওঠে কোকিল। পাখিটার যে কি আবেগ। চারদিকে হৈহল্লার মাঝখানে বসে যেন কি এক আবেশ মাখা গলায় ডেকে ওঠে কু-উ-উ, কুউউ! চারদিকের মানুষগুলো একবার হলেও কান পাতে।
বৌ-ঝিরা কাজ করতে করতে উন্মনা হয়ে কোকিলের ডাক শুনে বাড়ির বিরাট প্রাসাদের কাঠামোয় সিমেন্ট লাগাতে লাগাতে মিস্ত্রীদের হাতও যেন একটু থামে। বড় বুক ভরে ডাকে কোকিলটা। ওতো একটা নয় আরও দুষ্টু শালিক, চড়ই মিলে জনবহুল পাড়াটাকে কোলাহল মুখর করে তোলে।
এখনও শীতের আবছা ভাব কাটেনি। কাশেম ঘুম ভেঙে ওঠে। ও বাবা, চারপাশে বেশ ঝরঝরে ভাব দেখছি। তাতো হবেই। পাড়ার সবাই যে ফাল্গুনের সঙ্গে মেতে উঠেছে। ফুল নিয়ে তো এলাহি কারবার। পাড়ার বড়োরা ছেলেমেয়েদের আনন্দে অংশ নিতে বেশ উৎসাহী।
এই এলাকার স্কুলের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায় যখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে সবাই গান গায়। বাজার তলায় ছোটো ছেলেমেয়েরা ছড়া কেটে কেটে পাড়া মাতিয়ে তোলে। আসলে আরও রহস্য রয়েছে। বিকেল হতেই ছেলে বুড়ো সবাই ছোটে মিয়া সাহেবের ময়দানে। ভোঁ ভোঁ করে শব্দ ওঠে ঘুড়ি ওড়ানোর। হায়রে হায়! কত কিসিমের ঘুড়ি! বাজারে রমিজ মিয়ার আট বছর বয়সী ছেলেটা হেঁটে হেঁটে বাঁশী বাজায়। তবে কদিন ধরে এসব আয়োজন সবচেয়ে বড় যে আনন্দ সেটা কাউকে জানায়না কাশেম। সব বন্ধুরাই হাত ধরাধরি করে খেলে বেড়ায়। আর দুপুর বেলা চুপি চুপি নিজের ঘরের কোণে কি যেন করে।
সেদিন তো আর এর একটু হলেই ধরা পড়ে যাচ্ছিলো। বিকেল বেলায় মুড়িমাখা নিয়ে ছেলের খোঁজ করতে এলো মা।-
-এই আন্ধারের মইদ্যে কি করছ বাজান।
- ঘুড্ডি বানাই। মা. আমার ঘুড্ডি দ্যাখবা সক্কলের চাইয়া সোন্দার আর বড় হইবো। অন্যডি তো দ্যাখবাই। কিন্তু আমারডা হইবো ফাসক্লাস।
Ñআইছা, হইছে হইছে অহন দুই মুঠ মুড়ি খাইয়া ল। মনে রাহিস দোকানে বাজানের খাওন লইয়া যাবি। মা নিজের কাজে চলে যান। মা চলে গেলে মশারির আড়াল থেকে বের করে আনে তার তৈরি ঘুড়িটা। মস্ত বড় ঘুড়িটা, সাদা, লাল রঙের কাগজে তৈরি। ঝালর দেওয়া। আজ অনেক দিন ধরে কাগজ যোগাড় করেছে সে। চিকিমিকি কাগজ দিয়ে তারা ফুল কেটেছে। তারপর সেগুলো দিয়ে সাজিয়েছে তার সাধের ঘুড়িকে। অনেক যতেœ বেড়ার আড়ালে লুকানো তার ঘুড়িটা ভাগ্যিস, বাজান জানেনা! বিকেলবেলায় সকলকে চলকে দেবে কাশেম।
বাতাসে ফুুলের গন্ধ মৌ মৌ করছে। কোথা দিয়ে যে দিনের জমজমাট আনন্দ শেষ হল টেরই পাওয়া যায়নি। এখন চলছে ঘুড়ি ওড়ানো, পাড়ার ছেলে বুড়ো সবাই ঘুড়ি নিয়ে মেতে উঠেছে। পাড়ার দোতলা বাড়ি, বারান্দা। ছাদের রেলিং থেকে। সবার হাতে ঘুড়ি উড়ছে। ঘুড়ির রঙ দিয়ে যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অনেকের হাতে প্রজাপতি ভীমরুল, পাখি, শাপলা ফুল। ময়ূরও আছে। অর্থাৎ আকাশ জুড়ে হাল্কা মেঘের নিচে উড়ছে অসংখ্য ঘুড়ি। হাজার রঙে রাঙা রঙধনু ঘুড়ি আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। হাজার হাজার মানুষ হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করছে। বাবার কোলে চড়ে বাচ্চারাও দেখছে। রাস্তার গাড়ি ঘোড়া নেই তেমন। সবার খুশী আর ধরে না।
চারদিক থেকে সবাই চিৎকার করছেÑ ওই যে, ফড়িং ঘুড়ি, ওই যে প্রজাপতি, ওই যে মাছ, মাছ.... ময়ূর.... ঘুড়ি....
এত সব আনন্দধ্বনির মধ্যে কাশেমের ঘুড়িটা যেন এক নতুন বিস্ময়।
Ñ আরে! এযে শহীদ মিনার
Ñ কাশেমের বাবাও এসেছেন দোকানে লোক বসিয়ে। কাশেম একটা চওড়া দেওয়ালের ওপরে দাঁড়িয়ে তার ঘুড়িটা ওড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ সবাই থেমে গেল। তারপর এক যোগে চিৎকার উঠলোÑ শহীদ মিনার। শহীদ মিনার....।
চমৎকার একটা উল্লাসধ্বনি উঠলো এলাকা জুড়ে। তারপর অবাক হয়ে দেখতে গেল সাদা সবুজে মেশানো শহীদ মিনারটা যেন আকাশে মাথা উঁচিয়ে বাতাসে উড়ছে। ঝক ঝক করছে সোনালী-রূপালী তারা।
Ñ এই জন্যই ছেলেটার কয়দিন কোন কামে পাই না। অর যে এমন একখানা সোন্দর ঘুড়ি বানাইছে বুঝতেই পারি নাই।
এমনি ঘুড়ির খেলা খেলতে খেলতে হঠাৎ পা ফসকে প্রাচীর থেকে নিচে পড়ে যায় কাশেম। হাতের লাইট টা সুদ্ধ কাশেম পড়ে যায়। পাশেই ছিলো পাড়ার একটা পুকুর। হায় হায় একি হল? ছেলেটা যে ঘুড়ি নিয়ে পড়ে গেল!
এত ভীড় এক লোক! তবু অনেক লোকই ছুটে এলো ছেলেটাকে পানি থেকে রক্ষা করতে।
Ñ অয় একলা একলা বাহাদুরী দেখাইতে গেছিলো ক্যান।
সর্বনাশ হইছে! অর তো সাঁতার বেশি জানে না। চিৎকার চেচামেচি উঠলো।
ফায়ার ব্রিগেড কে খবর দেয়া হল। এই রাক্ষুসে শহর কিছু দিনের মধ্যে কতগুলো শিশু মৃত্যুর কারণ ঘটিয়েছে। তবে কি আরও একটি শিশুকে হারাবে মানুষ?
আনন্দ-উল্লাস থেমে গেছে। বাচ্চাটাকে বাঁচানোই এখন আসল কথা। বেশ বড় বড় অফিসার এসেছেন। ফায়ার ব্রিগেডের একজন কর্মী এসে জ্যাকেট খুলে লাফ দিয়ে ডুব দিলেন কারণ ছেলেটি পানিতে পাড়েও দুই হাত ধরে আছে তার ঘুডডি। এ এক আশ্চার্য ব্যাপার। মাত্র ৮ বছর বয়স তার। পানির নিচে ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে যেতে ও ধরে রেখেছে তার ঘুডডিটা।
দ্রুত ছেলেটিকে তুলে এনে মাটিতে শুইয়ে দিলো উদ্ধার কর্মী। কিছু পানি বের হল তার পেট থেকে। কিন্তু অবাক কা-! হাতের মুঠিতে শক্ত করে ধরে রাখা মিনারের উঁচু চূড়ার অংশটুকু। ডুবে ভিজে নষ্ট হয়নি পুরোটা।
ছেলেটা বেঁচে গেছে। মা ওকে বুকে জড়িয়ে চোখের পানিতে ভাসে। পাড়াপ্রতিবেশী, মুরুব্বীরা এসে দেখে যান। পাড়ার ছেলেরা বারান্দায় ভিড় করে বসে।
Ñকেউরে কয় নাই। এত বড় ঘুড়ি ক্যামনে বানাইছে!’ ওদের কোলাহলে খুশী ঝরে পড়ে। রমিজ মিয়া এসে দরজায় দাঁড়ান।
বাজান, আসে। তোমাকে একটু বসাইয়া দেই।
ছেলের পিঠে হাত রেখে বসান রমিজ মিয়া। ছেলেটা এখনও দুর্বল সাংবাদিক দু’জনে তার সামনে মেলে ধরে একটা সংবাদপত্র। কি আশ্চর্য! একটা ছোটো ছেলের অজ্ঞান প্রায় শরীর মাটির ওপরে। পাশে তার বন্ধুর হাতে ধরা একটা ঘুড়ি। চমৎকার একটা শহীদ মিনারের আদলে তৈরি। কিছু জখম হলেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ঝলমলে রূপালী ঝালর। সবাই মুগ্ধ গয়ে দেখলো ছবিটা। নিচে লেখা আছেÑ ‘ডুবে যেতে যেতেও কাশেম তার হাত থেকে ঘুড়িটাকে ভেসে যেতে দেয়নি’ সাবাস্।
ঘরের সবাই আনন্দে হাত তালি দিয়ে ওঠে। খুশীতে কাশেমের কেমন যেন আন্দন আহে!’ মা কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
সন্ধ্যায় ক্ষীণ চাঁদের আলোয় বারান্দায় এসে ছেলেকে বসিয়ে দেন রমিজ মিয়া। কাশেম এখনও দুর্বল। আস্তে আস্তে বাবার সঙ্গে কথা বলে সে।
Ñ বাজান আমি ভাবছিলাম পইড়া গেলেও আমার শহীদ মিনারকে নষ্ট হইতে দিমুনা।
ঠিক করছো বাজান, ঠিক করছো। বলেন তার বাবা।
Ñবাজান দেহেন দেহেন! খুশীতে ঝলমল করে ওঠে কাশেম।
দু’জনেই দেখে। তাদের ঘরের দরজার ওপরে আঠা দিয়ে সুন্দরভাবে লাগানো রয়েছে কাশেমের শহীদ মিনার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন