শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

প্রসঙ্গ : রাসূলগণের উপর ঈমান

সত্যালোকের সন্ধানে

| প্রকাশের সময় : ১২ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এ, কে, এম, ফজলুর রহমান মুন্্শী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ইসলামে নবী ও রাসূলদের সংখ্যার কোনো নির্দিষ্ট অংক নেই। তিবরানীর একটি দুর্বল বর্ণনানুসারে জানা যায়, পৃথিবীতে এক লাখ চব্বিশ হাজার পয়গাম্বর প্রেরিত হয়েছেন। অন্যান্য বর্ণনায় পয়গাম্বরদের সংখ্যা এর চেয়ে কম উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কুরআনুল কারীমে শুধু ঐ সকল আম্বিয়ার নাম উল্লেখ করা হয়েছে আরববাসী যে সকল নামের সাথে পরিচিত ছিল। অথবা, তাদের প্রতিবেশী ইহুদি-নাসারাদের কিতাবে যে সকল নবীর কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। কোরআনুল কারীমে এমন কিছু আম্বিয়ার নাম উল্লেখ আছে যাদের সম্পর্কে কেবলমাত্র আরবরাই পরিচিত ছিল। ইহুদি এবং নাসারা এদের সম্পর্কে ছিল সম্পূর্ণ বেখবর। যেমন হযরত হুদ (আ.) এবং হযরত শোয়ায়েব (আ.)। কোন কোন নবী সম্পর্কে ইহুদি ও নাসারা অবগত ছিল। কিন্তু তারা তাদেরকে নবী ও রাসূল হিসেবে স্বীকার করত না। যেমন হযরত দাউদ (আ.) এবং হযরত সুলায়মান (আ.)। কিন্তু অহীয়ে মুহাম্মদী (সা.) এদের সকলকেই নবী বলে স্বীকার করে নিয়েছে এবং একই সাথে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা ও সত্যতার স্বীকৃতি প্রদান করেছে।
এ প্রসঙ্গে অপর একটি দিকনির্দেশনার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করা খুবই জরুরি। তা হলো এই যে, ইসলাম-পূর্ব যুগে নবুওত, রিসালত এবং পয়গাম্বরীর কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এমনকি সন্দেহাতীত হাকীকত পৃথিবীর সামনে পরিস্ফুট ছিল না। ইহুদিদের কাছে নবুওতের অর্থ ছিল কেবলমাত্র ভবিষ্যদ্বাণী করা এবং তারা বলে বেড়াত যে, নবী হচ্ছে ভবিষ্যদ্বক্তা মাত্র এবং তাদের সম্পর্কে এ ধারণাও পোষণ করত যে, তাদের নেক দোয়া এবং বদদোয়া দ্রুত কবুল হয়। (তৌরাত : তাকবীন কা- অধ্যায় ২০-৭) এজন্য হযরত ইব্রাহীম (আ.), হযরত লুত (আ.), হযরত ইসহাক (আ.), হযরত ইয়াকুব (আ.) এবং হযরত ইউসুফ (আ.)-এর নবুওত ও রিসালতের অস্পষ্ট ও আবছা অবকাঠামো তাদের নিকট অবশিষ্ট ছিল। এমনকি হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পরিবর্তে সিরিয়ার কাহিনীকার মালেককে তারা পয়গাম্বরের চেয়েও অধিক মর্যাদাশীল বলে মনে করত। (তাকবীন কা- : ১৪-১৮) হযরত দাউদ এবং হযরত সুলায়মান (আ.)-এর পদমর্যাদা ছিল তাদের দৃষ্টিতে একজন রাজা-বাদশাহর অনুরূপ। সে যুগের ভবিষ্যদ্বক্তা আরও অনেক পয়গাম্বরের পরিচয় পাওয়া যায়। এ কারণেই ইহুদিদের কাহিনী ও কিতাবসমূহে ই¯্রাঈলী পয়গাম্বরদের প্রতি অত্যন্ত কটূক্তি নিদ্বির্ধায় করা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, খ্রিস্টান সমাজেও নবুওত ও রিসালতের সার্বিক বৈশিষ্ট্যাবলী সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়নি। অন্যথায় তারা একথা মোটেও উচ্চারণ করতে পারত না যে, আমাদের পূর্ববর্তী আগমনকারীগণ চোর-ডাকাত ছাড়া কিছুই ছিল না। (ইঞ্জিল)
প্রচলিত ইঞ্জিল নামক গ্রন্থগুলোতে আল্লাহর প্রশংসা পরিদৃষ্ট হয় না। এমনকি রাসূলগণের আলোচনাও সেগুলোতে নেই। এ সকল কিতাবে নবীগণের সততা ও সত্যবাদিতার সাক্ষ্য-প্রমাণও নেই। হযরত যাকারিয়া (আ.), হযরত ইয়াহইয়া (আ.) যাদের উল্লেখ ইঞ্জিলে আছে তারাও পয়গাম্বরসুলভ মর্যাদাসহ তাদের দৃষ্টিতে পরিগণিত হতো না। কিন্তু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) আগমন করে মর্যাদাপূর্ণ পদমর্যাদা ও হাকীকত প্রকাশ করেছেন এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্যকে তুলে ধরেছেন এবং তিনিই এই বৈশিষ্ট্যাবলী তুলে ধরেছেন। তাদের সকলের ওপর ঈমান আনয়নকে মুক্তি ও নিষ্কৃতির উপায় বলে নির্ধারণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, নবুওত এবং রিসালত হচ্ছে সুনির্দিষ্ট কতিপয় মানুষকে প্রদত্ত আল্লাহর নির্ধারিত এক পদমর্যাদা। এ সকল মনোনীত ব্যক্তিবর্গকে এই পৃথিবীতে এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন যে, তারা আল্লাহর নির্দেশাবলী মানুষের সামনে তুলে ধরবে এবং সততা ও পবিত্রতার পুণ্যময় রাস্তা তাদের সামনে উন্মুক্ত করবে। কেননা, তারা হচ্ছে পথপ্রদর্শক, ভীতি প্রদর্শনকারী, আল্লাহর পথে আহ্বানকারী, খোশ-খবরী দানকারী, সত্যিকারের শিক্ষার মুবাল্লেগ এবং নূর। আল্লাহপাক তাদের সাথে কথা বলেছেন এবং নিজের বাণীসমূহ তাদের কাছে তুলে ধরতেন। এমনিভাবে নবী ও রাসূলগণ আল্লাহর নির্দেশাবলী সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন করতেন। তারা ছিলেন গুনাহ থেকে মুক্ত এবং অপবিত্র কর্মকা- থেকে সম্পূর্ণ বিমুক্ত। তারা ছিলেন আল্লাহপাকের মাকবুল ও পুণ্যশীল বান্দাহ এবং তারা সে আমলের সর্বোৎকৃষ্ট লোক ছিলেন। তাদের যাবতীয় কর্মকা- কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই উৎসর্গীকৃত ছিল। শুধু তাই নয়, আল্লাহপাকও তাদের প্রতি রাজি ও সন্তুষ্ট ছিলেন। এসকল পবিত্র ব্যক্তিসত্তা নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে আঞ্জাম দেয়ার জন্য প্রত্যেক কওমেই জন্মগ্রহণ করেছেন। যারা তাদেরকে মান্য করেছে তারা নাজাত লাভ করেছে এবং যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তারা হালাক ও বরবাদ হয়ে গেছে। কোরআনুল কারীমে তাদের জীবনেতিহাস এবং তাদের কর্মপদ্ধতি এবং তাদের উন্নত চরিত্রের উদাহরণ এবং তাদের একনিষ্ঠ আল্লাহ-প্রীতি ও একাগ্রতাকে এমনভাবে বয়ান করা হয়েছে যে, তাদের এসকল কাহিনী পাঠ ও শ্রবণ করলে তাদের প্রতি আনুগত্য ও আকর্ষণের মাত্রা ক্রমশই বেড়ে যায় এবং তাদের সততা ও সত্যবাদিতার ওপর সুদৃঢ় মনোবল গঠিত হয়। একই সাথে তাদের নবুওতের মর্যাদার পরিপন্থী যে সকল কথা ও কাহিনী তাদের প্রতি আরোপ করা হয়েছিল, ইসলাম সেগুলোকে সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং এগুলোর ভিত্তিহীনতার প্রমাণ উপস্থাপন করেছে।
 মোটকথা, নবুওত ও রিসালতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ইসলাম তুলে ধরে ঘোষণা করেছে, নবী ও এবং রাসূলগণ গুনাহ থেকে পবিত্র এবং নিকৃষ্ট ও কদর্য আচার-আচরণ হতে তারা ছিলেন সম্পূর্ণ মুক্ত। বনী ই¯্রাঈলের কাছে নবুওত এবং রিসালতের এহেন সমুন্নত মর্যাদার চিন্তা ও কল্পনার লেশ মাত্র ছিল না। এজন্যই তারা অত্যন্ত নির্ভীকরূপে পয়গাম্বরদের প্রতি ইলজাম আরোপ করতে কুষ্ঠাবোধ করেনি।
খ্রিস্টানরা একমাত্র ঈসা (আ.)-কে নিষ্পাপ মনে করে। তাদের দৃষ্টিতে অন্য সকলেই পাপী ও অপরাধী। কিন্তু ইসলাম দুনিয়ার সকল পয়গাম্বর এবং রাসূলদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের একই পরিম-ল কায়েম করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে পবিত্রতা এবং নিষ্কলুষতা সকল আম্বিয়া ও রাসূলদের সম্মিলিত গুণ।
কেননা এক গোনাহগার অপর গোনাহগারের পথ প্রদর্শনের উপযুক্ত হতে পারে না, যেমন এক অন্ধ অপর অন্ধকে পথ দেখাতে পারে না। এই নিরিখে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অহী তাঁর শিক্ষা আল্লাহপাকের সকল নিষ্পাপ রাসূলদের শ্রেষ্ঠত্ব ও বুজুর্গী পৃথিবীতে কায়েম করেছে এবং যে সকল প্রচ্ছন্ন বিরুদ্ধাবাদীর দল তাদের পবিত্রতা ও নিষ্কলুষতার পর্দায়  নিজেদের অজ্ঞতা ও মুর্খতার কারণে মালিন্য ও আবিলতা আরোপ করেছিল, সেগুলোকে ধুয়ে-মুছে পাক-সাফ করেছে। আর এটাই হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহৎ কর্মকা-ের একটি বিরাট দিক।
 খোদ ইঞ্জিলের (যদিও তা আসল ইঞ্জিল নয়) ভাষ্যে স্স্পুষ্ট উল্লেখ ছিল যে, হযরত ঈসা (আ.) দশটি আহকামের বাইরে নিজের মাতার প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করতে পারতেন না। এই ভুল ও ভ্রান্তিকর নির্দেশের মূলোৎপাটন করেছে আল কোরআন এবং হযরত ঈসা (আ.)-এর জবান হতেই ঘোষিত হয়েছে : “আমি হলাম স্বীয় মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারকারী এবং আল্লাহপাক আমাকে অত্যাচারী কঠোর চরিত্রের অধিকারী করে সৃষ্টি করেননি।” (সূরা মরিয়ম : রুকু-২)  অথচ দশটি আহকামের মাঝে মাতা-পিতার প্রতি শিষ্টাচার প্রদর্শন না করা ছিল দুর্ভাগ্যের বিষয়। তাছাড়া প্রচলিত ইঞ্জিলে হযরত ঈসা (আ.)-এর ওপর এই অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল যে, তিনি নামাজ-রোজার প্রতি ছিলেন বেপরোয়া। অথচ এ সম্পর্কে কোরআনের ভাষ্য হলো : “হযরত ঈসা (আ.) বলেন, আল্লাহপাক আমাকে নামাজ এবং জাকাতের নির্দেশ দিয়েছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি জীবিত থাকব।”
(সূরা মরিয়ম : রুকু-২)  ইহুদিরা হযরত মরিয়ম (আ.)-এর ওপর অভিযোগ উত্থাপন করেছিল। কিন্তু কোরআনুল কারীম তাদের এই অভিযোগ খ-ন করেছে, তা দূর করে দিয়েছে এবং এই ঘোষণা জারি করেছে : “এবং মরিয়ম বিনতে ইমরান যিনি স্বীয় পবিত্রতাকে হেফাজত করেছিলেন, সুতরাং আমি তার মাঝে প্রাণ ফুঁকে দিলাম এবং তিনি স্বীয় প্রতিপালকের নির্দেশসমূহ এবং তাঁর কিতাবসমূহকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিলেন এবং তিনি ছিলেন বন্দেগীকারীদের অন্তর্ভুক্ত।”
(সূরা মরিয়ম : রুকু-২)  কূট ষড়যন্ত্রকারী ইহুদিরা হযরত সুলায়মান (আ.)-কে তাবীজ-তুমার এবং আমালিয়াতের আবিষ্কর্তা বলে মনে করত। অথচ ছেহের এবং যাদু-টোনা তৌরিতের দৃষ্টিতে ছিল শিরকের শামিল। কোরআনুল কারীম খোলাখুলি ইহুদিদের এই ইলজামের খ-ন করেছে। ইরশাদ হচ্ছে : “এবং সুলায়মান (আ.) কুফুরিসুলভ কোনো কাজ করেননি; কিন্তু শয়তানই কুফুরির কাজ করেছে এবং সে মানুষকে যাদু শিক্ষা দিয়েছে।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৩) অনুরূপভাবে ইহুদিরা হযরত লূত (আ.)-এর ওপর অপকর্মের ইলজাম দিয়েছিল। অথচ কোরআনুল কারীম এগুলোর অসারতা প্রতিপন্ন করেছে এবং সার্বিকভাবে এগুলোকে ভিত্তিহীন মিথ্যা বলে সাব্যস্ত করেছে। উপরে বর্ণিত হয়েছে যে, কোরআনুল কারীম অথবা রাসূলুল্লাহ (সা.) দুনিয়ার সকল পয়গাম্বরের নাম উল্লেখ করেননি। শুধু নামের তালিকা অথবা নামের পরিচিতি বা ব্যক্তি পরিচিতির দ্বারা মানুষের অন্তরে আকর্ষণ এবং উদ্দীপনার উদ্রেক হয় না; এমনকি বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব প্রতিফলিত হয় না। তবু জানা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আহ্বান ধ্বনি একদিন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়বে এবং বহু ভিন্নধর্মী অন্য আম্বিয়াদের আস্তানাসমূহ এই পয়গাম্বরের হালকায় প্রবেশ করবে। এবং নিজেদের আম্বিয়াদের নাম ও পরিচিতি সাহীফায়ে মুহাম্মদী (সা.)-এর মাঝে তালাশ করবে। এজন্য একটি বিশেষ আয়াতে সকল আম্বিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের সত্যতার পরিচিতিও তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে : “অবশ্যই আমি আপনার নিকট অহী প্রেরণ করেছি, যেমন হযরত নূহ (আ.) ও তাঁর পরবর্তী নবীগণের নিকট অহী প্রেরণ করেছিলাম, হযরত ইব্রাহীম (আ.), হযরত ইসহাক (আ.), হযরত ইয়াকুব (আ.) ও তাঁর বংশধরগণ, হযরত ঈসা (আ.), হযরত আইয়ুব (আ.), হযরত ইউনুস (আ.), হযরত হারুন (আ.) এবং হযরত সুলায়মান (আ.)-এর নিকট অহী প্রেরণ করেছিলাম। এবং হযরত দাউদ (আ.)-কে যাবুর দিয়েছিলাম। অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি যাদের কথা পূর্বে আপনাকে বলেছি এবং অনেক রাসূল যাদের কথা আপনাকে বলিনি এবং হযরত মূসা (আ.)-এর সাথে আল্লাহপাক সাক্ষাৎ কথাবার্তা বলেছিলেন। সুসংবাদবাহী ও সাবধানকারী রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূল আসার পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে এবং পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” (সূরা নিসা : রুকু-২৩) আম্বিয়াদের সম্পর্কে এই হাকীকতটি সূরা মু’মিনেও দ্বিতীয়বার বয়ান করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে : “এবং অবশ্যই আমি আপনার পূর্বে বহু রাসূল প্রেরণ করেছি, যাদের কিছু সংখ্যকের কথা আমি আপনার কাছে বিবৃত করেছি এবং কিছু সংখ্যকের কথা বিবৃত করিনি।” (সূরা মু’মিন : রুকু-৪)
তা’লীমে মুহাম্মদী (সা.)-এর বিধান মোতাবেক এই বিশ্বাস করাও জরুরি যে, দুনিয়ার বড় বড় কাওম এবং দেশ যেমন- চীন, ইরান, হিন্দুস্তানেও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পূর্বে আল্লাহর প্রেরিত নবীগণের আগমন ঘটেছিল। আর এজন্য এ সকল অঞ্চলের অধিবাসীরা যে সকল বুজুর্গের ইজ্জত ও সম্মান করে এবং নিজেদের দীন ও মাজহাবকে যাদের দিকে সম্পৃক্ত করে, তাদের সততা, সত্যবাদিতার সার্বিক অঙ্গীকার কোন মুসলমানই করতে পারে না। এই নিরিখে কোনো কোনো বিদ্বজ্জন হিন্দুস্তানের কৃষ্ণ ও রামকে এবং ইরানের জরদস্তকে, এমনকি কেউ কেউ বুদ্ধকেও পয়গাম্বর বলে অভিমত প্রকাশ করেছে। মোটকথা, তাদের কিংবা অন্য কারোরও নবী হওয়ার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে সন্দেহ করা যায় না। কিন্তু প্রকৃতই তারা নবী ছিলেন কিনা, তা নিরূপণ করার মানদ- আল কোরআনেই সুস্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। তবে এদেরকে একীনসহ নবী হিসেবে নির্দিষ্ট করা সীমালঙ্ঘন ছাড়া কিছুই নয়। এর সার্বিক আলোচনা নি¤েœ পেশ করা হলো। কোরআনুল কারীমে আম্বিয়াদের দু’টি পরিচয় সূত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমত, আম্বিয়াদের নাম এবং কর্মকা- সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যাদের নাম কোরআনুল কারীমে সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি এক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত হলো এই যে, যে সকল আম্বিয়ার নাম কোরআনুল কারীমে সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের ওপর নাম বনাম বিশ্বাস স্থাপন করা সকল মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু যাদের নাম সরাসরি উল্লেখ নেই, তাদের সম্পর্কে শুধুমাত্র এতটুকু ইজমালী বিশ্বাসই যথেষ্ট যে, ঐ সকল জাতির বা কাওমের কাছেও প্রেরিত পুরুষ নবী এবং রাসূল আগমন করেছিলেন। যদিও তাদের নাম জানা নেই। কিন্তু যে সকল কাওম বা জাতি সেই অনুল্লিখিত নবীদেরকে নবী হিসেবে নাম স্মরণ করে, এ সম্পর্কে ইসলামে দিক দর্শনের দু’টি পথ রয়েছে। প্রথমত, অনুল্লিখিত যে সকল ব্যক্তিসত্তাকে নবী বলে মনে করা হচ্ছে যদি তাদের জীবন এবং শিক্ষা নবুওত এবং রিসালতের মর্যাদার অনুকূল হয়, তাহলে তাদের নবুওত এবং রিসালতের দিকে জোরালো কারণ পাওয়া যাবে। কিন্তু তাদেরকে নবী হিসেবে চূড়ান্ত বিশ্বাসের আওতাভুক্ত করা যাবে না। কারণ, নবী ও রাসূলকে বিশ্বাস করার মূল মানদ- হচ্ছে অহী। যেহেতু অহী তাদের সম্পর্কে নীরব ভূমিকা পালন করেছে, সেহেতু সুনির্দিষ্ট পন্থা বা মতাদর্শ গ্রহণ করা মোটেই ঠিক হবে না। (কালেমাতে তাইয়্যিবাত : হযরত শাহ মাজহার জান জানান; মিলাল ওয়ান্নিহাল : ইবনে হাজাম) এই শ্রেণীর আম্বিয়া তাদের নাম যদিও কোরআনুল কারীমে নেই কিন্তু তারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পূর্বে জীবনকাল অতিবাহিত করেছেন এবং তাদের অনুসারীগণ তাদেরকে নবুওত এবং রিসালতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তাদের পরিচয় ও সনাক্তকরণের একটি নিয়ম-নীতি কোরআনুল কারীম নির্ধারণ করে দিয়েছে। তা হলো তারা নিজেদের কাওম এবং জাতিকে তাওহীদের শিক্ষা দিয়েছেন কিনা। যদি তারা তাওহীদের শিক্ষা প্রদান করে থাকেন তাহলে তাদেরকে নবুওত ও রিসালতের মর্যাদায় সমাসীন বলে মনে করা যাবে। আল কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে : “এবং আমি প্রত্যেক কাওমের মাঝে রাসূল প্রেরণ করেছি যেন এই শিক্ষা প্রচার করে যে, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর এবং মিথ্যা উপাস্যদের খপ্পর হতে বেঁচে থাক।” (সূরা নহল : রুকু-৫) অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে : “এবং আমি আপনার পূর্বে এমন কোনো নবীকে প্রেরণ করিনি যারা এই শিক্ষা প্রদান করে নাই যে, আল্লাহ ছাড়া কোনই উপাস্য নাই সুতরাং তোমরা আল্লাহপাকেরই ইবাদত কর।”  (সূরা আম্বিয়া : রুকু-২) এ সকল কারণে পূর্ববর্তী মানব সংস্কারকগণকে এবং পৃথিবীর পথ-প্রদর্শকগণকে যারা পৃথিবীবাসীর সামনে তাওহীদের শিক্ষাকে সমুন্নত করেছেন এবং মূর্তিপূজা ও অংশীবাদিতার ছোঁয়াচ হতে মানুষকে বেঁচে থাকার পরামর্শ প্রদান করেছেন তাদের সম্পর্কে নিশ্চিতরূপে একথা বলা যাবে না যে, তারা নবী কিংবা রাসূল ছিলেন না। কেননা কোরআনুল কারীমের বিধান মোতাবেক পৃথিবীর এত বড় বড় জনসমষ্টি ষোল আনাভাবে নবী এবং রাসূল থেকে বঞ্চিত থাকবে এমনটি কল্পনা করা যায় না। কেননা কোরআনুল কারীমের স্বীকৃত ও সমর্থিত শিক্ষাকে গ্রহণ না করে কোন মানুষই মুসলমান পদবাচ্যের যোগ্য হতে পারে না। কিন্তু এর জন্য তাওহীদের শিক্ষা পাওয়া প্রধান শর্ত। যেখানে এ শিক্ষার অভাব সেখানে রিসালত ও নবুওতের মার্যাদাকে আরোপ করা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। তবে হ্যাঁ, কোরআনুল কারীমে হয়ত কোন নবী এবং রাসূলের নাম উল্লেখ নেই অথচ তারা যে তাওহীদের শিক্ষা প্রদান করে ছিলেন তা প্রামাণ্য সূত্রে সমর্থিত, তাদের নবুওত ও রিসালতকে সমর্থন করা যেতে পারে। কোরআনুল কারীমের দিকনির্দেশনা মোতাবেক এটাও সুস্পষ্ট যে, নবী এবং রাসূলগণের মর্যাদা ও কর্মকা-ের ব্যাপ্তি একই সমান ছিল না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেউ হয়ত অধিক মর্যাদার অধিকারী; কিন্তু সামগ্রিকভাবে নয়। এই দিকনির্দেশনা কোরআনুল কারীমে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে : “এই রাসূলগণের মাঝে আমি কাউকে অন্য কারও ওপর অধিক ফজিলত প্রদান করেছি এবং তাদের কারও সাথে আল্লাহপাক বাক্যালাপ করেছেন এবং কাউকে বেশি মর্যাদা প্রদান করেছেন এবং আমি ঈসা ইবনে মরিয়মকে নিদর্শনাবলী প্রদান করেছি এবং পবিত্রতা দ্বারা তাকে সহায়তা দান করেছি।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-৩৩) রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্যান্য নবী ও রাসূলগণের সম্মান এবং ইজ্জতকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে এতই সচেতনতা অবলম্বন করেছিলেন যে, কখনও কখনও তিনি নিজের কথাও বিস্মৃত হয়ে যেতেন। একবার জনৈক সাহাবী তাঁকে ইয়া খাইরাল বারিইয়্যাহ অর্থাৎ হে সর্বোত্তম সৃষ্টি বলে সম্বোধন করল। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, “তিনি ছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আ.)।” (মুসনাদে ইবনে হাম্বল : ১ম খ : ১২৪ পৃ:) আর একবার রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! কোন নবী সবচেয়ে উঁচু খান্দানের ছিলেন? তিনি উত্তর করলেন, “হযরত ইউসুফ পয়গাম্বর ইবনে পয়গাম্বর ইবনে পয়গাম্বর ইবনে পয়গাম্বর খলিলুল্লাহ।” (সহীহ বুখারি, কিতুবুল আম্বিয়া : মানাকেবে হযরত ইউসুফ, পৃ: ৪৭৯) একবার একজন ইহুদি মদিনার রাস্তায় একথা বলে বেড়াচ্ছিল যে, “ঐ আল্লাহর শপথ, যিনি হযরত মূসা (আ.)-কে সকল মানুষের ওপর মর্যাদা প্রদান করেছেন।” একজন মুসলমান তার একথা দাঁড়িয়ে শুনছিলেন এবং তিনি মনে করলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বর্তমানে এ লোকটি একি কথা বলছে? রাগে, গোসায় উত্তেজিত হয়ে তিনি ইহুদি লোকটিকে ভীষণভাবে প্রহার করলেন। ইহুদি দরবারে নববীতে উপস্থিত হয়ে এই অভিযোগ পেশ করল। রাসূলুল্লাহ (সা.) অভিযুক্ত সাহাবীকে দরবারে তলব করলেন এবং ঘটনার বিবরণ শুনলেন। এতে তিনি খুবই অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বললেন, “তোমরা পয়গাম্বরদের মাঝে পরস্পরকে পরস্পরের ওপর এমন মর্যাদা প্রদান কর না যাতে কারও পদমর্যাদার অবমূল্যায়ন ঘটে।”
(সহীহ বুখারি : মানাকেবে হযরত মূসা (আ.), ৪৮৯ পৃ:)
এগুলোই হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহতী শিক্ষা। যার বদৌলতে বিশ্বময় একই ধর্মাদর্শ, রূহানী সমতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব এবং সকল নবী ও রাসূলের সম্মান ও মর্যাদার অনুপ্রেরণা পয়দা হয়েছে। বনী ইসরাইলের নবীগণের অনুসারীদের সংখ্যা বিশ্বজুড়ে কয়েক লাখের বেশি ছিল না। রাসূলুল্লাহ (সা.) যে পরিপূর্ণ ইসলামের সাংবিধানিক ও ব্যবহারিক জীবন-দর্শন বিশ্বময় প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এই সত্য মতাদর্শের অনুসারদের সংখ্যা বর্তমান বিশ্বে ১৭০ কোটিরও অধিক হয়ে গেছে। একই সাথে হযরত মরিয়ম (আ.) এবং হযরত ঈসা (আ.)-কে ইহুদিরা দীর্ঘ ছয়শত বছর যাবত যে সকল অপবাদ প্রদান করেছিল, রাসূলূল্লাহ (সা.) আগমন করেই তাদের অপবাদকে খ-ন করেন এবং তাদেরকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে তাদের সচ্চরিত্রতা ও পবিত্রতার সাক্ষ্য প্রদান করেন। যার বদৌলতে বর্তমান বিশ্বে হাজার হাজার ভাষাভাষী লোক তাদের পবিত্রতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। প্রকারান্তরে হিন্দুস্তান, ইরান, চীন এবং অন্যান্য দেশে সত্যধর্ম প্রচারকদের পরিচয় এবং তাদের কর্মকা- সম্পর্কে বহির্বিশ্বে মোটেই অবহিত ছিল না এবং এ সকল ধর্মবেত্তাদের সম্মান ও মর্যাদার আসনও বহির্বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। কিন্তু মুসলমানগণ যেখানেই গমন করেছেন সেখানেই সত্যিকার নবী ও রাসূলদের সম্মান ও মর্যাদাকে বহন করে নিয়ে গেছেন। (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন