তারেক সালমান : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নানামুখী সমীকরণ করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে আগামী বছর ২০১৮ সালের শেষের দিকে অনুষ্ঠেয় এই জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের সাংগঠনিক ভিত্তি দৃঢ় করা, সরকারের উন্নয়ন জনগণের কাছে তুলে ধরা, উন্নয়নের সুফল জনগণের দ্বোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়াসহ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে মাঠ দখল নিয়েই বিভিন্ন ছক আকছে ক্ষমতাসীনেরা। এ মুহূর্তে শিগগিরই দেশে নতুন নির্বাচন দাবি করা বিএনপিকে নিয়ে রাজনৈতিক কোনো চিন্তা আমলেই নিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপি নয়, ‘উগ্র সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ’ নিয়ে চিন্তিত ও সেই বিষয়ে সতর্ক থাকবে আওয়ামী লীগ। তাই নতুন বছরে নেতাকর্মী-জনগণের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে দলকে সুসংগঠিত করবে আওয়ামী লীগ। আর উন্নয়ন, অগ্রগতি ও অর্জনের সাথে জনগণের সেতুবন্ধন ঘটিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি সারবে দলটি। দরিদ্র ও দুস্থ্যভাতাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের উন্নয়নের সুফল জনগণের জন্য নিশ্চিত করতে বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। সুসংগঠিত দল নিয়ে উন্নয়নের প্রচারণার মধ্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দুই বছর আগেই মাঠ নিজেদের পক্ষে নেয়ার টার্গেট শাসকগোষ্ঠীর। আর আগামী জাতীয় নির্বাচনে স্বচ্ছ ইমেজের অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রার্থীর মনোনয়ন নিয়েও ব্যাপক ভাবনা রয়েছে দলটির। নির্বাচনের প্রায় দুই বছর বাকি থাকলেও চলতি বছরই নির্বাচনকেন্দ্রীক ‘গ্রাউন্ড ওয়ার্ক’ সম্পন্ন করতে চায় ক্ষমতাসীনেরা
গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই ভাষনেও প্রধানমন্ত্রী সুষ্পষ্ট করে বলেছেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার চলতি মেয়াদে তিন বছর অতিক্রম করেছে। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। জনগণের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। আমাদের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের প্রার্থীর জনপ্রিয়তার মাপকাঠি যাচাই, সঠিক প্রার্থী বাছাই, তৃণমূলে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিতকরণ, অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন, নির্বাচন পর্যন্ত মাঠের রাজনীতির করণীয়, নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা, বহির্বিশ্বের সহযোগিতা পাওয়াসহ সামনে যেসব বাধা আছে বলে মনে হচ্ছে সেগুলো দূর করার চেষ্টায় কাজ শুরু করেছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে দেশের সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই হবে। সমঝোতা সব কিছুই হবে সংবিধান অনুযায়ী। আমরা সংবিধানের বাইরে যাবো না। পরবর্তী নির্বাচন, আমরা সংবিধানের বাইরে যাবো না। উই ক্যান নট গো বিলং কনস্টিটিউশন।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়েছে প্রার্থী বাছাই। কারণ, নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র দুই বছর, যা একটি জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য খুব পর্যাপ্ত সময় নয়। এ কারণে চলতি বছরেই প্রার্থী ঠিক করে ফেলতে চায় ক্ষমতাসীনরা। আর প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা ও তুলণামূলক স্বচ্ছ ইমেজ। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও নির্বাচনে দলের প্রার্থী এ ক্ষেত্রে মডেল হিসেবে সামনে রাখছে আওয়ামী লীগ।
সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জোর দিয়েছেন। তিনি নেতাকর্মীদের বারবার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছেন, আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে হলে দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। নেতাকর্মীদের সংশোধিত হতে হবে। জনগণের সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে।
দলীয় নেতাকর্মীদের আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়ে কাদের বলেন, আগামী নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই। এ জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। দলকে একটি সুশৃঙ্খল, কলহ-কোন্দলমুক্ত শক্তি হিসেবে আমাদের তৈরি হতে হবে। দলের মধ্যে কেউ বিপথগামী হলে সংশোধন করা হবে। সংশোধন করা সম্ভব না হলে তাকে দল থেকে বের করে দিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। গুটিকয়েক কর্মীর জন্য শেখ হাসিনার উন্নয়নকে মøান করতে দেয়া যাবে না।
কাদের আরো বলেন, আগামী নির্বাচনের জন্য সকল নেতাকর্মীদের প্রস্তুত হতে হবে। জণগণের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবেন না। এখন যাদের শাস্তি দিচ্ছেন তখন তারা আমাদের ভালো প্রার্থীকেও ভোটের মাধ্যমে শাস্তি দিয়ে দিবে। যে কোনো কাজ করেনÑ মানুষের চোখের ভাষা, মনের ভাষা বুঝতে হবে। এই দিন দিন নয়, আরো দিন আছে। যে কাজই করেন না কেনো, জনগণের চোখের ভাষা এবং মনের ভাষা বুঝে চলতে হবে। তা না হলে তারা নির্বাচনের মাধ্যমে উপযুক্ত জবাব দিয়ে দেবে। যেমনটি বিএনপিকে দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় এক সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কে কোন মাপের নেতা, সেটা বিবেচ্য বিষয় হবে না। কারণ আমাদের লক্ষ্য হলোÑ জয়ী হয়ে আসা। দল জয়ী হয়ে আসতে পারলে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে তখন সবাই ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবে। আর তাতে যদি ব্যর্থ হই; তাহলে যত বড় নেতাই নির্বাচিত হোক না কেন, কোনো কাজে আসবে না।
দলীয় সূত্র জানায়, দলীয় কোন্দল মেটানোকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। টানা দুইবার ক্ষমতায় থাকার কারণে দলে নেতার সংখ্যাও ব্যাপক হারে বেড়েছে। তবে সবাই এলাকায় জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি এটা একটা ইতিবাচক বিষয়। অধিকাংশ জেলায় সংসদ সদস্য এবং জেলা নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও রয়েছে। এ বিষয়গুলো সামনে রেখে সব সমস্যা সমাধানের কাজ চলছে।
দলের অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, বিগত সময়ে দলের ক্রাইসিস মুহূর্তে কার কি ভূমিকা ছিল, তা বিচার-বিবেচনা করা হবে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনগুলোতে (ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন) নেতাদের ভূমিকা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে। কার কারণে দলীয় প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে, সে বিষয়গুলোও এরই মধ্যে নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের পরও দলীয় প্রার্থীর পক্ষে যারা কাজ করেনি তাদের সম্পর্কে ইতোমধ্যে দলীয় প্রধানকে অবহিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই অনেককে সতর্ক করা হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের সময়ও বিতর্কিত ও সন্দেহভাজনদের বিষয়টি মাথায় রাখা হবে।
সূত্র জানায়, স্বচ্ছ ইমেজের নেতা নির্বাচনে প্রাথমিক কাজ গত বছরের শেষভাগ থেকেই কাজ শুরু হয়েছে। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বিশ্বস্তদের দিয়ে সারাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আসনভিত্তিক প্রাথমিক জরিপ করিয়েছেন। বাকি কাজও চলতি বছরেই শেষ করা হবে।
এদিকে চলতি মাস থেকে সারাদেশে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব নিরসনে মাঠে নামবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এর পাশাপাশি তারা নেতাদের জনপ্রিয়তাও যাচাই করবেন। এখন থেকেই দলের সিনিয়র নেতাদের নির্বাচন জরিপসংক্রান্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানান, জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে চলতি বছরে সংগঠন গোছানো, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দলাদলি দূর করা, ঝিমিয়ে পড়া নেতাকর্মীদের চাঙা করার মতো কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাবে আওয়ামী লীগ।
নেতারা মনে করেন, দল টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে সংগঠন অনেকাংশে অসংগঠিত হয়ে পড়েছে। নির্বাচনের আগেই তাই দলকে গুছিয়ে নিতে হবে। নেতাকর্মীদের মধ্যে টানাপড়েন রেখে নির্বাচন মোকাবেলা করা এবং তাতে বিজয় ছিনিয়ে আনা কষ্টসাধ্য কাজ হবে। নির্বাচনে দলের সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনকেন্দ্রীক কাজের পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- জনগণের দৃষ্টিগোচর করতে কাজ করবে আওয়ামী লীগ।
দলের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, নতুন বছরে দলকে চাঙা করার দিকে বেশি মনোযোগ থাকবে আওয়ামী লীগের। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলোÑ একাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়া। এ লক্ষ্য পূরণ করতে হলে দলকে সেভাবে সংগঠিত করতে হবে। নির্বাচন আর দল গোছানো নিয়েই চলতি বছর আওয়ামী লীগ ব্যস্ত থাকবে।
দলের এক সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় নির্বাচনই আওয়ামী লীগের সকল মনযোগের বিষয়, কোনোভাবেই বিএনপি নয়। সেক্ষেত্রে নানাভাবে পর্যুদস্ত বিএনপিকে নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার মামলার সঙ্গে জিয়াউর রহমানে ‘সমাধি’ সরানোর মধ্যে ব্যস্ত রাখার কৌশল নিতে পারে ক্ষমতাসীনেরা। তাই চলতি বছরটি আওয়ামী লীগের কাছে নির্বাচনী প্রস্তুতির বছর। নির্বাচনের প্রায় দুই বছর বাকি থাকলেও এ বছরই নির্বাচনকেন্দ্রীক ‘গ্রাউন্ড ওয়ার্ক’ সম্পন্ন করতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নতুন বছরে আমরা আমাদের দল গোছাব। সাংগঠনিকভাবে আরো শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেবো। বিএনপির বিষয়ে তিনি বলেন, বিএনপি একটি ডেড হর্স, তাদের নিয়ে আমাদের কোনো রাজনৈতিক চিন্তা নেই; তবে তাদের উগ্র সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিষয়ে আমরা দলীয়ভাবে একই সঙ্গে সরকারও সতর্ক থাকবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন