তারেক সালমান : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সরব হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ। প্রার্থী তালিকায় স্থান পাওয়ার জন্য দলীয় সভাপতির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাও করছেন অনেকেই। তবে দল থেকে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ইতোমধ্যেই নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে সংসদ সদস্যদের দায়িত্বকালীন ‘পারফরম্যান্স’ কেন্দ্রীয় অফিসে প্রেরণের জন্য। অন্যদিকে, দলের অভ্যন্তরে আগামী নির্বাচনকে ঘিরে শুরু হয়েছে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির কাজও।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ঘোষণাই রাজনীতিতে এই নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহলে বিগত বছর থেকেই চলছিল গুজব-গুঞ্জন ও আলোচনা। নতুন বছরের দ্বিতীয় সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে এই আলোচনা আরো জোরালো হয়েছে।
এদিকে দীর্ঘদিন পর ধানমন্ডির নিজ রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা অফিস করেছেন। সেখানে তিনি নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে তার দেয়া বক্তব্য অনেকেই নির্বাচনের আগাম আভাস বলেই মনে করছেন। উল্লেখ্য, গত শনিবার বিকালে প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ করেই তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে যান। সেখানে তিনি নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচন কার্যত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বাইরে অন্য দলগুলো বর্জন করে। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও দলটির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এ নির্বাচন শুধু বর্জনই নয়, প্রতিহতের ঘোষণা দেয়। ২০ দলীয় জোটের বাইরেও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোও সেই নির্বাচন বর্জন করে। ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ ও তার জোটের নির্বাচনের বিরুদ্ধে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো অবস্থান নেয়। আর এ নির্বাচন করা ও বর্জনকে কেন্দ্র করে দেশে ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনাও ঘটে। সাধারণ ভোটাররা আতঙ্কে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। দেশের ইতিহাসে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জন সংসদ সদস্যও নির্বাচন হয়ে আসেন। বাকি যেসব সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসেন তাতে ভোটারদের অংশগ্রহণ নামমাত্র দেখা যায়। সেই থেকে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সুশীলসমাজ নতুন একটি নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এলেও সরকারের পক্ষ থেকে এতদিন কোনো সাড়া মেলেনি। কিন্তু গত বছরের ২২-২৩ অক্টোবর অত্যন্ত জাঁকজমকের মধ্যদিয়ে দলের ২০তম জাতীয় সম্মেলন সম্পন্ন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আর সেই সম্মেলন ও সম্মেলনের পর থেকেই সরকারি দলের নেতাদের মুখে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা শোনা যায়। দলের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক যোগাযোগ এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। সর্বশেষ শনিবার বিকালে নিজ রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তা আরো জোরদার হয়ে উঠেছে। অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ পরবর্তী নির্বাচনের ট্রেনে উঠে পড়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, আগামী নির্বাচনের জন্য দলীয় ইশতেহার তৈরির লক্ষ্যে দলের উপদেষ্টাম-লীর সদস্যদের নেতৃত্বে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক আলাদা আলাদা সেল গঠনের কাজ শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করে, বিগত নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যে ওয়াদা করেছিল তার থেকে বেশি কাজ হয়েছে। এবার তিন বছরে নির্বাচনী ইশতেহারের ওয়াদা বাস্তবায়নেও আওয়ামী লীগ এগিয়ে আছে। এছাড়া, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের প্রার্থীর জনপ্রিয়তার মাপকাঠি যাচাই, সঠিক প্রার্থী বাছাই, তৃণমূলে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিতকরণ, অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন, নির্বাচন পর্যন্ত মাঠের রাজনীতির করণীয়, নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা, বহির্বিশ্বের সহযোগিতা পাওয়াসহ সামনে যেসব বাধা আছে বলে মনে হচ্ছে সেগুলো দূর করার চেষ্টায় কাজ শুরু করেছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা।
দলটির নেতাদের আত্মবিশ্বাস বিগত নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনেও দেশের উন্নয়ন ও প্রগতির স্বার্থে জনগণ আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়ে ইতোমধ্যেই বলেছেন, আগামী নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই। এ জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। দলকে একটি সুশৃঙ্খল, কলহ- কোন্দলমুক্ত শক্তি হিসেবে আমাদের তৈরি হতে হবে।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কাদের আরো বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জনগণের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবেন না। এখন যাদের শাস্তি দিচ্ছেন তখন তারা আমাদের ভালো প্রার্থীকেও ভোটের মাধ্যমে শাস্তি দিয়ে দেবে। যেকোনো কাজ করেন মানুষের চোখের ভাষা, মনের ভাষা বুঝতে হবে। এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে।
তিনি বলেন, যে কাজই করেন না কেন, জনগণের চোখের ভাষা এবং মনের ভাষা বুঝে চলতে হবে। তা না হলে তারা নির্বাচনের মাধ্যমে উপযুক্ত জবাব দিয়ে দেবে। যেমনটি বিএনপিকে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী নেতারা মনে করেন, ৮ বছর ধরে দল টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে সংগঠন অনেকাংশে অসংগঠিত হয়ে পড়েছে। নির্বাচনের আগেই তাই দলকে গুছিয়ে নিতে হবে। নেতাকর্মীদের মধ্যে টানাপড়েন রেখে নির্বাচন মোকাবেলা করা এবং তাতে বিজয় ছিনিয়ে আনা কষ্টসাধ্য কাজ হবে। নির্বাচনে দলের সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনকেন্দ্রিক কাজের পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- জনগণের দৃষ্টিগোচর করতে কাজ করবে আওয়ামী লীগ। সে লক্ষ্যে চলতি মাস থেকে সারাদেশে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব নিরসনে মাঠে নামবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এর পাশাপাশি তারা নেতাদের জনপ্রিয়তাও যাচাই করবেন। এখন থেকেই দলের সিনিয়র নেতাদের নির্বাচন জরিপ সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে চলতি বছরে সংগঠন গোছানো, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দলাদলি দূর করা, ঝিমিয়ে পড়া নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করার মতো কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাবে আওয়ামী লীগ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন