মাওলানা মুহাম্মদ রেজাউল করিম : আধ্যাত্মিক সম্রাট, কুতুবুল আউলিয়া, আওলাদে রাসূল, হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব শাহসূফী হাফেজ কারী ছৈয়দ আহ্মদ শাহ ছিরিকোটি আল্কাদেরী পেশোয়ারী (রহ.) ছিলেন বিশ্বব্যাপী শিক্ষা বিস্তারের অগ্রণী রাহবারদের অন্যতম। আল্লাহর এ মহান অলি, আলে রাসূল, যুগ শ্রেষ্ঠ তাপস, তাঁর মিশনের এক পর্যায়ে বার আউলিয়ার পূণ্যভূমি চট্টলার বুকে তাশরীফ আনেন এবং প্রতিষ্ঠিত করেন আধ্যাত্মিক ও দ্বীনি সংস্থা আন্জুমানে রহ্মানিয়া আহ্মদিয়া সুন্নিয়া (ট্রাস্ট) এবং এশিয়াখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন চট্টগ্রাম জামেয়া আহ্মদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা ।
প্রতিষ্ঠা সাল : ১৯৫৪ সালের এক শুভক্ষণে চট্টগ্রাম জেলার পাঁচলাইশ থানাধীন ৭নং ওয়ার্ডের পশ্চিম ষোলশহরস্থ নাজির পাড়ায় এ ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।
পরিচালনা পর্ষদ : এ প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আনজুমান এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সরকারি বিধি অনুযায়ী গঠিত পরিচালনা পরিষদের মাধ্যমে জামেয়ার যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বর্তমান জামেয়া পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্বপালন করছেন দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ প্রফেসর আলহাজ্ব মুহাম্মদ দিদারুল ইসলাম।
অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও কর্মচারীবৃন্দ : প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যোগ্য, দক্ষ, অভিজ্ঞ, মেধাবী, দূরদৃষ্টি ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অধ্যক্ষের সুষ্ঠু পরিচালনায় জামেয়ার সার্বিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন দেশবরেণ্য শাইখুল হাদীস আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ সোলাইমান আনসারী। অন্যদিকে নবীণ ও প্রবীণ মিলে জামেয়ায় আছেন প্রতিভাবান ও ধীশক্তিসম্পন্ন মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, ফক্বীহ্, আলিমে দীন-শিক্ষক। যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতি বছর জামেয়ার শিক্ষা বাগানে ফুটে অসংখ্য গোলাপ। আর জামেয়ার এ বিশাল কর্মযজ্ঞের সার্বিক সহযোগিতায় নিবেদিত প্রাণ একঝাঁক কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ।
জামেয়ার অবকাঠামো : জামেয়ায় রয়েছে অত্যন্ত সুন্দর ও মনমুগ্ধকর পাঁচটি বহুতলবিশিষ্ট বিশাল ভবন। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর সরকারি অনুদান ও বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতায় এ সকল ভবন নির্মিতি হয়েছে।
মডেল মাদরাসা : জামেয়া গভর্নিংবডির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, শিক্ষকম-লীর পাঠদান ও শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় গুণগত মান বৃদ্ধি এবং প্রশাসনিক শৃঙ্খলাসহ সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জামেয়াকে ‘মডেল মাদরাসা’র স্বীকৃতি প্রদান করে এবং এসইএসডিপি’র অধীনে ২০১১ সালে মডেল মাদরাসার আওতায় ৫ তলাবিশিষ্ট নতুন একাডেমিক ভবন নির্মিত হয়।
সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া : ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখায় ২০০১ সালে জাতীয় পর্যায়ে সরকারি শিক্ষা জরিপে জামেয়া ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ এবং জামেয়ার তৎকালীন অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মাওলানা মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আল্ক্বাদেরী (রহ.) ‘শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ’ ও জামেয়ার ফক্বীহ্ আলহাজ্ব মাওলানা মুফতী সৈয়্যদ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান ‘শ্রেষ্ঠ শ্রেণী শিক্ষক’ নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে জামেয়ার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মাওলানা মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আল্ ক্বাদেরী ‘শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ’ এবং প্রধান ফক্বীহ্ আলহাজ্ব মাওলানা মুফতী সৈয়্যদ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান ‘শ্রেষ্ঠ শ্রেণী শিক্ষক’ নির্বাচিত হয়ে সম্মাননা সনদ ও স্বর্ণপদক লাভ করেন। এ দ্বারা দেশ-বিদেশে জামেয়ার গৌরব ও খ্যাতি বৃদ্ধি পায়।
অনার্স কোর্স: মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সরকার ফাযিল স্তরে অনার্স কোর্স চালুর অনুমোদন দেয়ার পর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া কর্তৃক জামেয়ার তৎকালীন অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মাওলানা মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আল্ক্বাদেরী (রহ.) ৫ বিষয়ে অনার্স কোর্স চালুর আবেদন করেন এবং ২০-০৩-২০১০ তারিখে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি ড. মুহাম্মদ আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দল জামেয়া পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে তারা পরিচালনা কমিটির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও অধ্যক্ষের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে শিক্ষার সুষ্ঠু ও শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশে সন্তোষ প্রকাশ করে চট্টগ্রামে শুধু জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ায় আল কোরআন ও আল হাদীস ২ বিষয়ে অনার্স কোর্স অনুমোদন প্রদান করেন।
বিজ্ঞান বিভাগ : বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এ যুগে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মডেল মাদরাসা হিসাবে জামেয়ায় ২০১৪ সাল থেকে দাখিল স্তরে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করা হয়েছে।
ছাত্র ও সেকশন : বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সাধারণ শিক্ষার সমন্বয়ে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা অতীব গুরুত্ববহ। আল্লাহ্র অসীম রহমতে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওয়াসীলায়, হুযুর ক্বিবলাহ্র নেগাহ্ করমে জামেয়ায় ভর্তি পরীক্ষার মধ্যদিয়ে মেধাবী ছাত্রদের ভর্তি করানো হয়। ছাত্র বৃদ্ধির কারণে ২০০২ সালে ইবতেদায়ী ৫ম শ্রেণী থেকে ফাযিল পর্যন্ত শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদনে সেকশন চালু করা হয়। ২০১১ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আল্ কোরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ এবং আল্ হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে অনার্স বিভাগ চালু করা হয়। বর্তমানে হিফ্যখানাসহ জামেয়ার ছাত্র সংখ্যা প্রায় ৫০০০।
শিক্ষা পরিবেশ : প্রতিদিন ক্লাশ শুরুর পূর্বে জামেয়া ময়দানে কোরআন তিলাওয়াত, হামদ ও না’ত-এর মাধ্যমে এ্যাসেম্বলী চলাকালে ছাত্র-শিক্ষকের উপস্থিতিতে স্বর্গীয় পরিবেশ-আবহ সৃষ্টি হয়। জামেয়ার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল রাজনীতিমুক্ত পরিবেশ সমুন্নত রাখা। তাই হরতাল, ধর্মঘটেও জামেয়ার প্রশাসনিক ও শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম যথারীতি চলমান থাকে।
বোর্ড পরীক্ষার ফলাফল : যুগোপযোগী ও ফলপ্রসূ শ্রেণি পাঠদানসহ বিশেষ ক্লাস ব্যবস্থার ফলে কেন্দ্রীয় পরীক্ষাসমূহে জামেয়ার ছাত্রদের কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল প্রশংসার দাবিদার। বিগত ১০ বছরের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় প্রতিটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় জামেয়ার পাসের হার শতভাগ।
বৃত্তি : জামেয়ার ইবতেদায়ী, দাখিল, আলিম, ফাযিল, কামিল শিক্ষার্থীরা বোর্ড পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণের জন্য সরকারি শিক্ষা বৃত্তিসহ বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ট্রাস্ট কর্তৃক প্রতিযোগিতায় মেধা ও সাধারণ বৃত্তি লাভ করে জামেয়ার ভাবমর্যাদা সমুজ্জ্বল করে রেখেছে।
লাইব্রেরী : লাইব্রেরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হৃদপি-। আন্জুমান ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা, অধ্যক্ষের প্রচেষ্টা ও মুহাদ্দিস, মুফ্তী, মোদার্রেছীনে কেরামের চাহিদার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে জামেয়ায় গড়ে উঠেছে বিশাল লাইব্রেরী। এতে দেশ-বিদেশের বিখ্যাত গ্রন্থ, তাফসীর, ফিক্বহ্ ও ফাতাওয়ার দুর্লভ কিতাব, দুষ্প্র্রাপ্য রেফারেন্স বুক, এনসাইক্লোপেডিয়া ও জার্নাল সংগৃহীত আছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স চালু হওয়ায় লাইব্রেরীতে যুগোপযোগি কিতাব ও গ্রন্থাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। এম ফিল ও পিএইচডি গবেষণারত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জামেয়া লাইব্রেরীর উপর নির্ভর করে থাকেন। লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত গ্রন্থাবলীর সংখ্যা ১৩২৫০টি।
আইসিটি ল্যাব ও কম্পিউটার সায়েন্স : শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য জামেয়ার দাখিল স্তরে ‘কম্পিউটার শিক্ষা’কে সিলেবাসভুক্ত করা হয়েছে। দক্ষ কম্পিউটার শিক্ষক নিয়মিতভাবে কম্পিউটার শিক্ষা প্রদান করে আসছেন। মডেল মাদ্রাসার আওতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক শাখা উন্নয়ন প্রকল্প ২০টি কম্পিউটার সেট প্রদান করে। এ ছাড়াও শিক্ষানুরাগী মহান ব্যক্তিদের সহায়তায় জামেয়ার কম্পিউটার ল্যাব সমৃদ্ধ করা হয়েছে।
ক্বিরাত, হাম্দ ও না‘আত রাসূল (দ.) প্রশিক্ষণ : বিশুদ্ধ ও সুললিত কণ্ঠে পবিত্র কোরআন মাজীদ তিলাওয়াত শিক্ষার জন্য দক্ষ ক্বারী শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত ক্বিরাত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। ফলে জামেয়ার হিফ্যখানাহ্ ও কিতাবখানাহ্র ছাত্ররা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এবং সরকারিভাবে ক্বিরাত, হাম্দ, না‘আত ও আযান প্রতিযোগিতায় কৃতিত্ব অর্জন করে আসছে।
হিফ্যখানা : জামেয়ার শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে ‘হিফ্যখানা’ চালু রয়েছে। অভিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল হিফ্য শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী পবিত্র কোরআনুল কারীম শিক্ষা গ্রহণ করছে। হিফ্য সমাপ্ত শেষে ছাত্রদের দস্তারে ফযীলত প্রদান করা হয়।
প্রকাশনা : সাহিত্যের মাধ্যমে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আদর্শ বিকাশ ও বিস্তারে ছাত্রদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অনুপ্রাণিত করার লক্ষে ‘আল্ বশীর’ নামে দেয়ালিকা প্রকাশ করা হয়। প্রতি বছর কামিল স্তরের বিদায়ী ছাত্ররা ‘আত্ তৈয়ব’ স্মরণিকা প্রকাশ করে আসছে। দেশ-বিদেশের দৈনিক ও জাতীয় পত্রিকা, আরবী ইংরেজী উর্দূ ও বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সাময়িকী, সুভিন্যির, ম্যাগাজিন, জার্নালে জামেয়ার স্কলার ছাত্রদের প্রবন্ধ ও কলাম প্রকাশিত হয়ে আসছে। জামেয়ার ক্বারী ও শায়ির ছাত্রদের ক্বিরাত, হাম্দ ও না‘আত রাসূল (দ.)-এর ক্যাসেট প্রকাশিত হয়। এ দ্বারা জামেয়ার ভাবমূর্তি বিকশিত হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন