স্টাফ রিপোর্টার : নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগে প্রেসিডেন্টের গঠিত ছয় সদস্যের সার্চ কমিটির পাঁচজনই বিতর্কিত উল্লেখ করে এই কমিটি নিরপেক্ষ নয় বলে দাবি করেছে বিএনপি। গতকাল শুক্রবার সকালে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সার্চ কমিটি নিয়ে দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, এই কমিটিতে ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছা পূরণে সহযোগিতায় পুরস্কৃত এবং আওয়ামী পরিবারের বিশ্বস্ত সদস্যদের অন্তভুর্ক্তি একে শুধু বিতর্কিত করেনিÑ এর মাধ্যমে জনমতকে অগ্রাহ্য করার আরেকটি অগণতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। এমন সব ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত, এই কমিটিকে নির্দলীয় কিংবা নিরপেক্ষ বিবেচনা করার কোনোই অবকাশ নেই। আমরা প্রার্থীহীন, ভোটারহীন নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন সরকারের এই স্বৈরাচারী আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
এরকম সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ হবে না দাবি করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা মনে করি, এমন একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, সৎ, সাহসী ও যোগ্য ব্যক্তিগণ আগামী নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান কিংবা সদস্য হবেনÑ এমনটা আশা করাও বাতুলতা মাত্র।
আমরা এই ঘটনার মাধ্যমে আগামী নির্বাচনকে প্রভাবিত করার সরকারি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দেশবাসীকে হুঁশিয়ার হতে এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করার জন্য দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
প্রেসিডেন্টের গঠিত সার্চ কমিটিকে প্রত্যাখান করছেন কি না প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এখানে প্রত্যাখান করা বা না করার কোনো বিষয় নেই। নির্বাচন কমিশন যখন গঠিত হবে, তখন এই প্রশ্ন আসতে পারে। আমরা সার্চ কমিটির বিষয়ে আমাদের মতামত বা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি।
গত বুধবার প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ নতুন নির্বাচন কমিশনের সদস্য বাছাইয়ে ছয় সদস্যের সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির প্রধান করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে। বর্তমান ইসি গঠনে গতবারও একই দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
এ কমিটির অন্যরা হলেনÑ হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) মাসুদ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিরীন আখতার।
গতবার সার্চ কমিটির সুপারিশের পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমানের গঠিত কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন ইসির অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সার্চ কমিটির প্রধান হিসেবে আপীল বিভাগের যে মাননীয় বিচারপতিকে নিয়োগ করা হয়েছে, তিনি ২০১২ সালের গঠিত সার্চ কমিটিরও প্রধান ছিলেন। যে কমিটির প্রস্তাবক্রমে রকিবউদ্দিন কমিশনের মতো একটি অযোগ্য, অনুগত, মেরুদ-হীন ও বিতর্কিত কমিশন নিযুক্ত হয়, সেই কমিটির প্রধানকেই নতুন সার্চ কমিটির প্রধান করার অর্থ হলোÑ সরকার রকিবউদ্দিন কমিশনের মতোই আরেকটা অনুগত ও অযোগ্য নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করতে চায়।
কমিটির পাঁচ সদস্যের মধ্যে চারজনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, কমিটির অন্যতম সদস্য যিনি হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারপতি তিনি ছাত্রলীগের একজন সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবী হিসেবে বহুল পরিচিত ছিলেন। তার পিতা ডা. আখলাকুল হোসাইন ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা এবং নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার ছোটভাই এখন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন।
অপর সদস্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি মহাবিতর্কিত নির্বাচনের সময়ে তিনি নির্বাচন কমিশনের সচিব ছিলেন। নানা অনিয়মের ভরা ওই নির্বাচনকে নিয়মসিদ্ধ করার পুরস্কার হিসেবে অবসর গ্রহণের পর তাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় চুক্তিভিত্তিতে পিএসসি’র চেয়ারম্যান করা হয়েছে। অনুগ্রহভাজন এবং সহকর্মীদের কাছে আওয়ামী ঘরাণার সক্রিয় সমর্থক হিসেবে পরিচিত এই আমলা সরকারের ইচ্ছাপূরণে সচেষ্ট থাকবেনÑ এটাই স্বাভাবিক।
সার্চ কমিটির নারী সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য প্রফেসর শিরীন আখতারও নিরপেক্ষ নন দাবি করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষক হিসেবে ২০১৪ সালের শিক্ষক সমিতির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং তার পিতা মরহুম আফসার কামাল চৌধুরী কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি নিজেও কক্সবাজার মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী ছিলেন। কাজেই কোনো বিবেচনায়ই তাকে নিরপেক্ষ বলা যায় না।
সার্চ কমিটির অপর সদস্য বাংলাদেশের মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক যিনি রাজনৈতিক সরকারেরর অধীনস্থ একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে তিনি সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা রাখেন না। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছা পূরণে তিনিও কোনো বাধা নন।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেননি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণে গত ১৮ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দেয়া প্রস্তাব প্রসঙ্গ টেনে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের মূল কথাই ছিলÑ অবসরপ্রাপ্ত একজন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, অবসরপ্রাপ্ত একজন সচিব, অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষাবিদ কিংবা দলনিরপেক্ষ একজন বিশিষ্ট নাগরিক এবং একজন সিনিয়র নারীর সমন্বয়ে সার্চ কমিটি গঠন করতে হবে। বলা হয়েছিল, বিচারপতি, সচিব, শিক্ষাবিদদের কেউ অবসরগ্রহণের পর কোনো লাভজনক পদে নিযুক্ত হয়ে থাকলে তিনি কমিটির সদস্য হতে পারবেন না।
প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ছিল, সার্চ কমিচির কোনো সদস্য সরকারের অধীনস্থ হবেন না, দায়বদ্ধ থাকবেন না, অনুগ্রহভাজন হবেন না এবং স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যাদেরকে সার্চ কমিটির সদস্য নিযুক্ত করা হয়েছে, এদের দ্বারা কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন হবেÑ এটা কেউ বিশ্বাস করতে পারবে, পারবে না। গতবারও একই রকম দেখেছি। তোফায়েল আহমেদ সাহেব আমাদেরকে অপেক্ষা করার জন্য বলেছেন। আসলে এরকম কথাবার্তা বলে তারা আমাদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করতে চান, সেটা আমরা হচ্ছি নাÑ নিশ্চিত থাকতে পারেন। আমরা মনে করি, এই সার্চ কমিটি কোনো দিনই নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারবে না।
সার্চ কমিটি পুনর্গঠনের কোনো আবেদন প্রেসিডেন্টের কাছে করবেন কি না প্রশ্ন করা হলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, না আমরা কোনো আবেদন করব না।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত মাসাতো ওয়াতানাবির সাথে সচিবালয়ে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তোফায়েল আহমেদ বলেন, এটাকে বিতর্কিত করলে ক্ষতিটা কিন্তু বিএনপিরই হবে। কারণ পরবর্তীকালে দেখা যাবে, যেটাকে বিতর্কিত করেছেন তার কার্যকলাপের অধীনেই তারা নির্বাচনে গেছে।
জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি বলেছেন, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন কমিশনের গঠনের জন্য একটা সমঝোতার উদ্যোগ নিতে চেয়েছিল। যদিও এখন সুযোগ নেইÑ এই ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা জাতিসংঘের সবসময়েই যে কোনো উদ্যাগকে আমরা সমর্থন করেছি, আগেও করেছিলাম। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, জাতিসংঘ যে উদ্যোগ নেয়, এই সরকার তার আশপাশ দিয়েও যায় না। তাদেরকে সেই উদ্যাগ গ্রহণ করতেও বাধা প্রদান করেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি পর তৎকালীন জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্ন্দেজ তারানকো বিষয়টি নিয়ে ঢাকায় আসার চেয়েছিলেন, তাকে আসতে দেয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, প্রফেসর এ জেড এম জাহিদ হোসেন, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন