গত শনিবার ছয় সদস্যের একটি সার্চ কমিটি (অনুসন্ধান কমিটি) গঠন করেছেন রাষ্ট্রপতি। আপিল বিভাগের বিচারক বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এই সার্চ কমিটির সভাপতি। তিনি আগের সার্চ কমিটির সদস্য ছিলেন। এছাড়া সার্চ কমিটিতে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে আছেন বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান। মহা হিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক (সিএজি) মুসলিম চৌধুরী এবং সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন। এই কমিটিতে সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর প্রধানদের পাশাপাশি বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে আছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও লেখক-অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক। এই সার্চ কমিটি সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনার পদে যোগ্যদের অনুসন্ধানের জন্য রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে। নামের সুপারিশ চূড়ান্ত করে কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করতে এই কমিটি সময় পাবে ১৫ দিন। তাদের সুপারিশকৃত নামগুলো থেকে ইসি ও কমিশনার নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। নিয়োগপ্রাপ্ত এই সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনারাই পরিচালনা করবেন পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনসহ সকল প্রকার নির্বাচন।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন হয় ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ওইদিন রাতেই প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার নেতৃত্বে কমিশনের অপর চার সদস্য রয়েছেন: সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, সাবেক সচিব রফিকুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ কবিতা খানম এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী। মেয়াদের ৫ বছরে তারা ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াও ৬০ হাজারের বেশি স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনা করেছেন। এই নির্বাচন কমিশন ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘সব স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজন’ করার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের শপথগ্রহণ করেছিল। কিন্তু নুরুল হুদা কমিশন ৫ বছর ‘সব স্বার্থের ঊর্ধ্বে’ থেকে কয়টি নির্বাচন করেছেন, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।
সব ঠিক থাকলে তাদের মেয়াদ শেষ হবে ১৪ ফেব্রুয়ারি। আর বিদায়ের এ সন্ধিক্ষণে নতুন করে নিজেকে সাবজেক্ট-অবজেক্ট দুটাতেই গেঁথেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। সম্প্রতি রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসির (আরএফইডি) এক অনুষ্ঠানে তিনি তার সমালোচনা করায় এক হাত নিয়েছেন বিশেষ কয়েকজনের ওপর। একদম নাম ধরে-ধরে। নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সঙ্গে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদাকেও ছাড়েননি। নতুন কিছু তথ্য দিয়ে ধরেছেন তার সহকর্মী কমিশনার মাহবুব তালুকদারকেও। ভাষা কেবল আক্রমণাত্মক নয়, সঙ্গে ছিল টাটকা তথ্যও। এতোদিন অপ্রকাশিত বা লুকানো থাকলেও, পুরনো হলেও ভালো রসদ দিয়েছেন গণমাধ্যমকে।
তিনি ‘বর্তমান ইসির ভালো নির্বাচনের সদিচ্ছাই ছিল না, তারা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে, কেবল বিতর্ক সৃষ্টি করেছে’Ñ সাবেক সিইসি ড. এটিএম শামসুল হুদার এ মন্তব্যের জবাব দিয়েছেন এভাবে, শামসুল হুদা আমিত্বে ভুগছেন। এরপর বলেছেন, ২০০৭-০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে সিইসি হিসেবে শামসুল হুদা ‘বিরাজনীতির পরিবেশে সাংবিধানিক ব্যত্যয়’ ঘটিয়েছেন। ৯০ দিনের মধ্যে করার বিধান থাকলেও নির্বাচন করেছেন ৬৯০ দিন পর। এ সাংবিধানিক ব্যত্যয় ঘটানোর অধিকার তাকে কে দিয়েছে, এ প্রশ্নও ছুড়েছেন। তিনি এইসঙ্গে যোগ করেছেন, নবম সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনকে কীভাবে প্রার্থীদের হলফনামা প্রচারের কাজ দিয়েছেন। উনি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কোনো বিশেষজ্ঞ নন। সংবিধান বিশেষজ্ঞও নন। সংবাদ সম্মেলন করার বিশেষজ্ঞ।
শৈত্য প্রবাহের এই মাঘে আরো গরম তথ্য রয়েছে বিদায়ী সিইসির বক্তব্যে। সহকর্মী মাহবুব তালুকদার সম্পর্কে কিছু প্রতিক্রিয়া তিনি আগেও দিয়েছেন। এবার তাকে ‘রোগাক্রান্ত’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ইসিতে তিনি ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। এই রোগাক্রান্ত মাহবুব কখনো আইসিইউতে, কখনো সিসিইউতে ছিলেন। সিঙ্গাপুর- ভারতেও চিকিৎসা নিয়েছেন। এসব চিকিৎসার ব্যয় কমিশন থেকে করা হয়। এ অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা।
মাহবুব তালুকদার বা বদিউল আলম মজুমদার সম্পর্কে নুরুল হুদার দেয়া তথ্যের সত্যতা যাচাই অবশ্যই সময় সাপেক্ষ। কিন্তু এতো তথ্য আগে জানা ছিল না অনেকেরই। তবে, কেঁচোর গর্তে টোকা দিয়ে সাপ-বেজিসুদ্ধ বেরিয়ে আসার দশা হয়েছে। জবাবে বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, এসব অভিযোগ ডাহা মিথ্যা। সত্য হয়ে থাকলে সিইসি এতোদিন কেন এগুলো বলেননিÑ এ প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। আর মাহবুব তালুকদার জবাব দিয়েছেন লাইন ধরে ধরে। বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, নির্বাচন কমিশনার হিসেবে অসুখের যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া তার মৌলিক অধিকার। চিকিৎসার কারণেই তিনি এখন পর্যন্ত বেঁচে আছেন। নির্বাচন বিষয়ে তার ভিন্নধর্মী অবস্থান বলতে গিয়ে সিইসি তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে চিকিৎসার মতো বিষয় টেনে আনার নিকৃষ্ট পথ বেছে নিয়েছেন। তাকে রোগাক্রান্ত ব্যক্তি বলে উল্লেখের নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ইচ্ছা করলেই কেউ আইসিইউ বা সিসিইউতে থাকতে পারে না। নির্বাচন কমিশনার হওয়ার সময় থেকেই প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত জানিয়ে সিঙ্গাপুর ও ভারতের চেন্নাইতে চিকিৎসা নেয়ার কথা স্বীকার করেন। নিজ খরচে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার কথাও জানান। সেইসঙ্গে এও জানান, বর্তমানে কর্মরত অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার এবং অবসরপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনার সকলেই প্রাপ্যতা ও বিধি অনুযায়ী কমিশন থেকে চিকিৎসার খরচ নিয়ে থাকেন। কে এম নুরুল হুদা নিজেও নির্বাচন কমিশন থেকে চিকিৎসার জন্য টাকা নিয়েছেন। নুরুল হুদা ও মাহবুব তালুকদারের এসব বাৎচিতের মধ্য দিয়ে মানুষের বাড়তি কিছু তথ্য জানা হয়েছে। আরো জানার ইচ্ছাও জাগছে।
এখন জাতি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মতো আগামীর প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারগণও কি তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন নাকি ‘সব স্বার্থের ঊর্ধ্বে’ উঠে সরকারের আজ্ঞাবহ না হয়ে জনগণের সত্যিকারের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করবেন?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন