শীতের সকাল হওয়ায় ১০টা বাজেও চারপাশের কুয়াশার আবেশ তখনো কমেনি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেলেও ১৬ জানুয়ারি সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ‘গণ পাঠশালা’-এর চিত্র ছিল একটু ভিন্ন। উৎসবের আমেজে পরিপাটি ড্রেসে সকাল থেকেই স্কুলে আসতে শুরু করে শিশুরা। একটু দূরের নবীনগরের পাশের নিরিবিলি বস্তির সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুল ‘অ আ ক খ’-তেও চলছিল একই প্রস্তুতি।
একে একে জড়ো হয়ে প্রায় দুই শতাধিক শিশু শিক্ষার্থী আসতে শুরু করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পিএইচএ মিলনায়তনে। চেঁচামিচিতে ততক্ষণে কুয়াশা কেটে গিয়ে সূর্যের তাপটা অনুভূত হতে লাগলো। আর তাদের স্বাগত জানাতে মিলনায়তনের প্রধান ফটকে তখন গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (গবিসাস)-এর সম্পূর্ণ টিম। টিকিট দেখিয়ে একে একে সবাই প্রবেশ করলো মিলনায়তনে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় পর্দায় শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র ‘আমার বন্ধু রাশেদ’। এরই সাথে তুমুল হাততালির মাধ্যমে শুভ উদ্বোধন হলো অফ ট্র্যাক মিউজিক ক্যাফে পরিবেশিত ‘গণ বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম ফেস্ট-২০১৭’-এর। গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (গবিসাস) আয়োজনে এই উৎসবে দুই শতাধিক শিশু শিক্ষার্থীর পাশাপাশি উপস্থিত ছিল গণ বিশ্ববিদ্যালয় ও গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের প্রায় পনেরো শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী। তিন পর্বের প্রদর্শনীতে ছিল বাংলা চলচ্চিত্র ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘গেরিলা’ এবং মনপুরা।
বিভিন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীর পুতুল, ছবি, ব্যানার, প্যাস্টুনে বিচিত্র সাজে সেদিন সেজেছিল পিএইচএ মিলনায়তন। আড্ডা দিয়ে মোড়া বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সবাই একসাথে চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ অনেক থাকলেও, নিজ ক্যাম্পাসে এমন আয়োজন যেমন উৎসবের রূপ নেয়, তেমনি স্মৃতির পাতা উল্টাতেও ভূমিকা রাখে। “ছোটবেলায় প্রতি শুক্রবার আব্বুর পকেট থেকে ২ টাকা সরিয়ে রাখতাম। দুপুরে না ঘুমিয়ে চা দোকানের কোনো এক কোণায় বসে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম বাংলা ছবি। আজ এমন আয়োজন দেখে সেই দিনের কথা মনে পরছে।” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলছিল বন্ধুদের কাছে বিভিন্ন নামে পরিচিত এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাশেদুল ইসলাম। দলবল নিয়ে সেও এই উৎসবে এসেছে দুপুর পর্বের ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্র দেখতে।
‘আমার বন্ধু রাশেদ’ চলচ্চিত্রের চা বিরতিতে এমন আয়োজনের জন্য সাধুবাদ জানান আমন্ত্রিত অতিথিরা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ডাঃ এনামুর রহমান এমপি বলেন, “সন্ত্রাসবাদ আর নৈরাজ্যের বিপরীতে মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সৃষ্টিতে চলচ্চিত্র বরাবরের ন্যায় একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করতে সাংস্কৃতিক পদযাত্রাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
গণ পাঠশালার প্রধান শিক্ষিকা কৃষ্ণা সাহা বলেন, “উচ্চতায় বাড়ানোর প্রচেষ্টার বদলে প্রস্থে স্ফীত হওয়ার দিকে আমাদের আকাক্সক্ষা কমিয়ে সৃষ্টিশীল সৃজনশীলতার দিকে নজর দিতে হবে। কারণ, সৃষ্টিহীন সৃজনশীলতার মাধ্যমে সৃষ্টিশীল প্রজন্ম পাওয়া সম্ভব না।”
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি মুক্তির আন্দোলনে সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমরা যারা যুদ্ধ দেখিনি, শুধু স্বাধীনতা ভোগ করছি, সেই নতুন প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র একটি অমূল্য সম্পদ। সীমিত জানার মধ্যে অর্জিত স্বাধীনতার সত্যিকারের মূল্য বুঝাতে দেশের নির্মাতাদের আবার মুক্তিযুদ্ধের দিকে ফিরতে হবে। নতুন প্রজন্ম ভুলে যাওয়ার পূর্বেই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভীত মজবুত করণে সৃষ্টিশীল লেখালেখির পাশাপাশি এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগের অনেক বেশি প্রয়োজন।
ষ মনির হোসেন শিমুল
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন