গত শনিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে একটি মসজিদ আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার একদিন পরেই কানাডার কুইবেকে মসজিদে ঢুকে গুলি চালাল ইসলামবিদ্বেষী বন্দুকধারী দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে ৬ জন নিহত ও আরো কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে দাবি করা হলেও পুলিশের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি। নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি সংকীর্ণ ও উগ্র জাতীয়তাবাদী মেনিফেস্টো গ্রহণ করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান এবং বহুত্ববাদি সংস্কৃতির মূল স্পিরিটের পরিপন্থী এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এখন পুরো পশ্চিমা সমাজকেই অনেক বেশি অস্থিতিশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র বর্ণবাদি চিন্তার প্রথম ও প্রধান টার্গেট হয়ে উঠেছে মুসলমানরা। দায়িত্ব গ্রহণের পর পর ট্রাম্প টিপিপি থেকে সরে গিয়ে আগের সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ধারাবাহিকতায় বড় ধরনের ছেদ ঘটান। টিপিপি এখনো পূর্ণমাত্রায় কার্যকর না হওয়ায় টিপিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে বড় ধরনের পরিবর্তন না ঘটলেও ৭টি মুসলিম প্রধান দেশের নাগরিকদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বন্ধ রাখা এবং ডিপোর্টেশনের সিদ্ধান্ত সারা বিশ্বে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন তৎপরতা, প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ও সামরিক আগ্রাসনে লন্ডভন্ড ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, ইরান ও সুদানের মতো দেশের নাগরিক ও শরণার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের উপর নতুন করে বৈষম্যনীতি ও হয়রানির খড়গ ঝুলিয়ে দেয়ার বিরূপ প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে।
মূলত, নাইন-ইলেভেনের রহস্যজনক বিমান হামলার ঘটনার পর থেকেই তৎকালীন রিপাবলিকান বুশ প্রশাসন পশ্চিমা বিশ্বের ইসলাম-বিদ্বেষী অবস্থানকে সংহত করার সুযোগ গ্রহণ করে। ইহুদি জায়নবাদ প্রভাবিত মিডিয়া ও থিঙ্কট্যাংকগুলো ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে মুসলমানদের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়ার কৌশল গ্রহণ করে। তবে এ সময়ের ডেমোগ্রাফিক পরিসংখ্যান বলছে, ইসলামোফোবিয়া তাদের জন্য বুমেরাং হয়েছে। এ সময়ে পশ্চিমা সমাজের হাজার হাজার তরুণ-তরুণী ইসলাম গ্রহণ করার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের প্রায় প্রতিটি শহরেই মুসলমানরা সবচেয়ে দ্রæত বর্ধিষ্ণু ও প্রভাব সৃষ্টিকারী সম্প্রদায় হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতে মুসলমান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপোড়েন কমিয়ে আনার প্রতিশ্রæতি দিলেও মার্কিনীদের পররাষ্ট্রনীতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। তবে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাল্টিকালচারালিজম বা বহুত্ববাদি সংস্কৃতির পক্ষে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম দফায় ৭টি মুসলিম প্রধান দেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ব্যাপক বিক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির পর তিনি ধর্মকে টার্গেট করে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছেন না বলে বিবৃতি দিলেও তার সমর্থক ও ঘাপটি মেরে থাকা ইসলাম-বিদ্বেষিরা এখন মূলত মসজিদগুলোকেই তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের জন্য অভিবাসন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর কানাডা সরকার এসব দেশের অভিবাসীদের আমন্ত্রণ জানানোর পর সংঘটিত কুইবেক মসজিদে রক্তাক্ত হামলার ঘটনা বড় ধরনের তাৎপর্য বহন করে। ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম বিদ্বেষী এজেন্ডার আওতায় বছরের পর বছর ধরে একতরফা মুসলিমবিদ্বেষী প্রোপাগান্ড কার্যত ব্যর্থ হওয়ার পর তারা এখন মসজিদে আগুন দিয়ে এবং গুলি করে হতাহত করে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করতে চাচ্ছে। ঐতিহাসিক নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে খ্রিস্টান, ইহুদি ও মুসলমানরা হাজার বছর ধরে সহাবস্থান করে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকশ’ বছরের ইতিহাসের সাথেও এশীয় ও আফ্রো-আমেরিকান মুসলমানরা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মাল্টি কালচারালিজমের ধ্বজাধারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে মুসলমানদের উপর বৈষম্যমূলক আইন এবং একের পর এক মসজিদে নাশকতার ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই বৈষম্যনীতি এবং মুসলিম বিদ্বেষ কানাডা ও ইউরোপেও বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে। কুইবেক মসজিদে হামলার ঘটনায় আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। তবে আশার কথা হচ্ছে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং কুইবেক প্রাদেশিক সরকারের প্রধান ফিলিপ কুইলা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তারা মসজিদে হামলার ঘটনাকে মুসলিমবিদ্বেষী সন্ত্রাসী হামলা বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে টেক্সাসে আগুনে পুড়ে যাওয়া মসজিদটির পুনঃনির্মাণের জন্য ৮ লাখ ডলার সংগ্রহের জন্য মসজিদ কমিটির আহ্বানে সাড়া দিয়ে মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ৬ লাখ ডলার সংগৃহীত হয়েছে বলে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। ইসলামবিদ্বেষী জায়নবাদিরা এতদিন একতরফা প্রোপাগান্ড করে যেমন সফল হয়নি, এখন সরাসরি মসজিদে আক্রমণ করে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা ও বিকাশ রুদ্ধ করে দিতে চাইছে। এখানেও তারা চরমভাবে ব্যর্থ হবে- ইনশাআল্লাহ্। মসজিদে হামলায় শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। সেই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপসহ সারাবিশ্বের নিপীড়িত মুসলমানদের প্রতি সংহতি ও সমবেদনা জানাচ্ছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন