শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী বিশ্ব

ট্রাম্পের পদক্ষেপ আইএসের জন্য শক্তি অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে

| প্রকাশের সময় : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিডল ইস্ট মনিটর : ইতোমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়া দায়েশকে (ইসলামিক স্টেট বা আইএস’র সংক্ষিপ্ত আরবি নাম) নির্মূল করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে ইসলামপন্থী ও বিশ্লেষকরা বলেছেন, ট্রাম্পের এ পদক্ষেপ উগ্র-কট্টরপন্থী গ্রুপটিকে নতুন যোদ্ধা সংগ্রহ করে শক্তিশালী করে তুলতে ও যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে হামলা চালাতে উৎসাহিত করতে পারে।
যুদ্ধে পরাজয়, ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ায় এলাকা হারানো, অর্থাগম হ্রাস এবং যোদ্ধাদের সংখ্যা কমে আসায় সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দায়েশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইসলামী উগ্রবাদ নির্মূলে ট্রাম্পের অঙ্গীকার প্রাথমিক দৃষ্টিতে দায়েশের সাফল্য লাভের সম্ভাবনার প্রতি আরেকটি আঘাত হয়ে এসেছে। তবে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ও দায়েশ সমর্থকরা বলছেন, ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজয় দায়েশের সৌভাগ্য পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। তারা মনে করেন, সাতটি মুসলিম দেশের উদ্বাস্তু ও নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা দায়েশের পক্ষে কাজ করতে পারে।
ইতোমধ্যে ট্রাম্পের এ নির্বাহী আদেশ একজন মার্কিন বিচারক বাতিল করে দেয়ায় তা এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ট্রাম্পের এ আদেশের ব্যাপারে দায়েশ নীরব রয়েছে। তবে এ আদেশ পুনর্বহাল হোক আর না হোক, বিশ^ব্যাপী মুসলমানরা তাতে ক্রুদ্ধ হয়েছে যারা ট্রাম্পের অস্বীকৃতি সত্ত্বেও এ আদেশকে তার ও তার প্রশাসনের ইসলাম ভীতির প্রমাণ হিসেবেই দেখছে।
ইসলামোফোবিয়ার অভিযোগ সম্পর্কে মন্তব্য করার জন্য অনুরোধ করা হলে হোয়াইট হাউস তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র শন স্পাইসার গত সপ্তাহে বলেন, প্রেসিডেন্টের এক নম্বর লক্ষ্য হচ্ছে সর্বদাই আমেরিকার নিরাপত্তার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা, ধর্ম নয়। তিনি মনে করেন যে এটা কোনো ধর্মীয় সমস্যা নয়।
ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রকে আরো কম নিরাপদ করবে এ কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের আদেশে কি বলা হয়েছে তা কিছু লোক ঠিকমত পড়েনি এবং বিভ্রান্তিকর সংবাদ মাধ্যমের খবরে তা পড়েছে।
তবে এ ধরনের মন্তব্য সমালোচনা বন্ধ করতে পারেনি।
ইসলামী উগ্রবাদ বিষয়ক লেখক ও ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘আইসিসঃ ইনসাইড দি আর্মি অব টেরর’ গ্রন্থের লেখক হাসান বলেন, মুসলিম দেশগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা উগ্রবাদীদের দমনে বৈশি^ক প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করবে।
৫৭ দেশের সংগঠন ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) বলেছে, এ ধরনের নির্বাচিত ও বৈষম্যমূলক কর্মকা- শুধু উগ্রপন্থীদের উগ্রবাদী কার্যকলাপকেই আরো শক্তিশালী করবে।
জিহাদিরা অনলাইন ফোরামগুলোতে এখনো ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজয় উদযাপন করছে। তারা বলছে, এটা তাদের যুক্তিকেই শক্তিশালী করেছে যে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গী যুক্তরাষ্ট্রের আসল চেহারা প্রদর্শন করছে এবং তার নীতি সম্প্রদায়গুলোর মেরুকরণ করবে যা জঙ্গিদের অন্যতম লক্ষ্য।
এক জিহাদি ইসলামী ওয়েবসাইট আল মিনবার-এ বলে, এটা হচ্ছে আল্লাহর তরফ থেকে সে সব মুসলিমের জন্য প্রদত্ত যারা তাদের আনুগত্য ও বিশ^স্ততা হারিয়েছে এবং বিধর্মীদের দেশে বিরাজিত বিলাসের সাথে দুনিয়াবি জীবন বেছে নেয়াকে পছন্দ করেছে।
দুর্বল দায়েশ
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দায়েশ বহু ফ্রন্টেই তাৎপর্যপূর্ণভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইরাক ও সিরিয়ায় তাদের সৃষ্ট খিলাফত এখন অস্তিত্ব সংকটে। তারা সেখানে অধিবাসীদের উপর যে উগ্র-কট্টরপন্থা চাপিয়ে দিয়েছিল তা এখন বিলীয়মান।
মার্কিন সমর্থিত ইরাকি বাহিনী অক্টোবরে মসুল অভিযান শুরুর পর গ্রুপটি ইরাকের উত্তরাঞ্চলে তাদের শক্তঘাঁটি মসুল ও তার চারপাশে এলাকা হারিয়েছে। ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় ইরাকি সুন্নীরা ইরাকি সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতা করছে। তারা দায়েশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের সাহায্য করছে। আইএসের আর্থিক সম্পদ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তুরস্ক তার সীমান্ত সিল করে দিয়েছে যার ফলে বিদেশী যোদ্ধা আসা ও অন্যান্য সামগ্রীর সরবরাহ আনার পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
ইরাকে দায়েশের উপস্থিতি ছিল মূলত উত্তরাঞ্চলে। তবে মসুলের পশ্চিমে যেমন তাল আফার এবং সিরীয় সীমান্তে আল কায়েমের মত শক্ত ঘাঁটিগুলো এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তা সত্ত্বেও ইরাকি প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল এবাদি বলেছেন, এপ্রিল নাগাদ দায়েশ ইরাক থেকে বিতাড়িত হবে।
দায়েশ সিরিয়ায় এখনো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এলাকা দখল করে আছে এবং পূর্ব সিরিয়ায় তাদের রাজধানী রাক্কায় প্রচ- প্রতিরোধ করে চলেছে। তারা রাক্কা বরাবর এলাকা, ইরাক সীমান্তের কাছে দেইর এজ-জর প্রদেশের শতকরা ৯০ শতাংশ এবং উত্তর সিরিয়ায় আলেপ্পোর পূর্বাঞ্চলীয় গ্রামীণ এলাকার কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। পালমিরা ও দক্ষিণে দেরার ক্ষুদ্র কিছু অংশও তাদের দখলে রয়েছে।
সিরিয়ায় দায়েশের প্রতিপক্ষের মধ্যে রয়েছে তুর্কি সেনাবাহিনী ও আলেপ্পোর উত্তর পূর্বে সিরিয়ার বিদ্রোহী গ্রুপগুলো। বেশ কয়েকটি ফ্রন্টে তারা রুশ বিমান বাহিনী সমর্থিত সিরীয় সরকারী বাহিনী ও ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়াদের সাথে লড়াই করছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ আভাস দিয়েছেন যে তিনি দায়েশের প্রতি ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গিকে আশাব্যঞ্জক বলে মনে করছেন।
লিবিয়ায় মার্কিন বিমান বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট লিবীয় বাহিনীর কাছে দায়েশ ভূমধ্যসাগরীয় বন্দর শহর সিরতের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এ পরাজয়ের ফলে গ্রুপটি উত্তর আফ্রিকায় তাদের প্রধান শক্ত ঘাঁটি হারিয়েছে যদিও লিবিয়ার অন্যান্য স্থানে তাদের সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে।
বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরাক ও সিরিয়ায় দায়েশের যোদ্ধাদের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে ২০ হাজারে নেমে এসেছে যা ২০১৪ সালে ছিল ৩৬ হাজার। যোদ্ধা ও নেতাদের বিপুলসংখ্যক নিহত হয়েছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান হামলায়, বাকিরা ইরাকি বাহিনীর হাতে ধৃত হয়েছে অথবা দেশ থেকে পালিয়েছে।
পাল্টা আঘাত  
পরাজয়ের শিকার হওয়া সত্ত্বেও দায়েশ প্রচ-ভাবে প্রতিরোধ করে চলেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের জন্য ভয়ঙ্কর শত্রু।
দায়েশ তার খিলাফতের ক্ষেত্রে মারাত্মক বিকল্প তৈরি শুরু করেছে যার মধ্যে রয়েছে সিরিয়া ও ইরাকে গ্রাম এলাকায় বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ইউরোপে হামলা এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে তুরস্ক হয়ে মিসর বরাবর পশ্চিমা মিত্রদের লক্ষ্যবস্তু করা।
কিছু ইসলামী বিশেষজ্ঞের বিশ^াস যে দায়েশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে তাদের আঘাত হানার চেষ্টা দ্বিগুণ করতে এবং গত দেড় বছরে প্যারিস, ব্রাসেলস, নিস, বার্লিন ও ইস্তাম্বুলে চালানো প্রাণঘাতী হামলার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে।
পর্বসূরী আল কায়েদার মত দায়েশ অনেকদিন ধরে বলে আসছে যে মুসলিমদের প্রতি পাশ্চাত্যের গভীর বৈরী মনোভাব রয়েছে। গত এক দশক ধরে এ বিষয়টি মধ্যপ্রাচ্য ও তার বাইরে উগ্রপন্থী শ্রোতা বৃদ্ধিতে একটি কারণ হিসেবে কাজ করেছে।  
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ^বিদ্যালয়ে প্রোগ্রাম অন এক্সট্রিমিজমের রিসার্চ ফেলো মোখতার আওয়াদ বলেন, ট্রাম্পের নীতি জিহাদিদের কাজ আরো সহজ করে দেবে। তারা শুধু তাদের হামলার কৌশল দ্বিগুণ করবে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিনিয়োগের বদলে তারা মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে তাদের সেলগুলো সক্রিয় করার যে চেষ্টা করছে তা আরো জোরদার করবে।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে একটি হামলা, যত ভয়ঙ্করভাবে তা করা সম্ভব, করা গেলে তা এটা প্রদর্শনের পক্ষে কাজ করবে যে ট্রাম্প দুর্বল এবং মার্কিন প্রশাসনের কিছ লোক যে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে সেই বর্জন ও বিদেশী ভীতির মনোভাবকে আরো জোরদার করবে।
সম্প্রদায়গত অবিশ^াস সৃষ্টি    
দায়েশের কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সমাজসমূহের মেরুকরণ এবং মুসলিমদের প্রতিবেশীদের অবিশ^াসের কারণ হওয়া। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দায়েশ মনে করে যে কোনো মুসলিম যদি তাদের সাথে যোগ নাও দেয়, সমাজের মেরুকরণ হলে সেই নারী বা পুরুষ জঙ্গিদের অনেক কম বিরোধিতা করবে।
বহু বিশ্লেষকই বলেন, দায়েশের বিরোধীদের জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক লড়াইÑ যারা গ্রুপটিকে সমর্থন করে তাদের সাথে কিভাবে গ্রুপটির সম্পর্ক বিনষ্ট করা যায়।
ট্রাম্পের আমলে ওয়াশিংটন ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা দায়েশকে দমনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে অংশীদার খুঁজছে।
ইরাকে মসুল অভিযানের সম্মুখভাগে রয়েছে মার্কিন বাহিনী। তারা ইরানের সাথে যুক্ত, জোটবদ্ধ নয়। যুক্তরাষ্ট্র যদি মুসলিম দেশগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখে বা পুনর্বহাল করার মত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে বাগদাদের শিয়া প্রধান সরকারের উপর তাদের প্রভাব আরো বৃদ্ধি পাবে।
সিরিয়ায় রাক্কা ঘিরে ফেলার জন্য মার্কিন বাহিনী সিরীয় কুর্দি যোদ্ধাদের উপর নির্ভর করছে। তবে তা ন্যাটো মিত্র তুরস্ককে উদ্বেগে ফেলেছে। তুরস্ক সিরীয় কুর্দিদের তুরস্কের কুর্দি বিদ্রোহীদের সাথে অভিন্ন বলে মনে করে যাদের তারা সন্ত্রাসী বলে গণ্য করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদের সন্ত্রাসী গ্রুপ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রতি ট্রাম্পের কথাবার্তা থেকে মনে হয় রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দায়েশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঘনিষ্ঠ হতে পারে যদিও তাদের লক্ষ্য ও মিত্রদের অনেকেই আলাদা।
এ সম্ভাব্য বিকাশমান সম্পর্ক দায়েশের জন্য একটি সুযোগ হতে পারে। বিশ্লেষকরা বলেন, তারা রাশিয়ার সাথে ইরানের সম্পর্ককে যোদ্ধা নিয়োগের সহায়ক হিসেবে দেখছে। কারণ, কিছু মুসলিমের মধ্যে তা ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন