শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ফাস্টফুডে আসক্তি বাড়ছে

| প্রকাশের সময় : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : ফাস্টফুড খাবারের প্রতি আসক্তি বাড়ছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীরা বেশি আসক্ত হচ্ছে এই খাবারের প্রতি। বাজারে নানা ধরনের ফাস্টফুড থাকলেও কোনটাতে কী পরিমাণ খাদ্য ক্যালরি রয়েছে তার উল্লেখ থাকছে না। এ কারণে মানুষ এসব খাবার খেয়ে অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যাচ্ছে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাইপারটেনশন ও শ্বাসকষ্টসহ নানা অসংক্রামণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। এসব খাদ্য তৈরি থেকে শুরু করে বাজারজাতে সরকারের কোনো সংস্থারই নজর নেই। সম্প্রতি শিশু ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় ফাস্ট ফুডের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে এ বিষয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করেন সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য নুরজাহান বেগম। পরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগামী অর্থ-বছরে বাজেট প্রণয়নের সময় অবশ্যই ফাস্ট ফুডের ওপর উচ্চ হারে ফ্ল্যাট ট্যাক্স নির্ধারণে নজর দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর। স্বাস্থ্যের দিক থেকে ফাস্ট ফুড উপাদেয় নয়।  
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজের সামনে ফাস্টফুডের দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে খাবার কিনে খাচ্ছে শিশু ও তাদের অভিভাবকরা। এসব খাবারের গায়ে ক্যালরির পরিমাণ উল্লেখ নেই। এগুলো খেয়ে শিশুসহ সবাই অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যাচ্ছে। ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সারসহ নানা অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের মতে, ফাস্টফুডে আছে স্যাকারিন, টেস্টিং সল্ট, চর্বি ও চিনি। একই সঙ্গে ফাস্টফুডের প্রিজারভেটিভ, কেমিক্যাল, ঘনচিনি ও ক্ষতিকর রং মারাত্মক অসুখ-বিসুখ সৃষ্টি করে শরীরে। এসব খাবারে নষ্ট হয় দাঁত, লিভার, কিডনিসহ মূল্যবান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি শিশু-কিশোরদের ফাস্টফুড খাওয়া নিয়ে একটি বড় ধরনের গবেষণা তথ্য দিয়েছেন। থোরাস্ক জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, যেসব শিশু-কিশোর সপ্তাহে তিন চার বার ফাস্টফুড খায় তাদের চর্মরোগ, একজিমা ও অ্যাজমার ঝুঁকি বেশি। গবেষকরা বিশ্বের ৩১টি দেশের ছয় থেকে সাত বছরের এক লাখ ৮১ হাজার শিশু এবং ১৪/১৫ বছরের তিন লাখ ১৯ বছরের ৫১টি দেশের কিশোর-কিশোরীদের ওপর গবেষণা পরিচালনা করেন। দেখা যায়, যেসব শিশু-কিশোর অধিক পরিমাণ ফাস্টফুড আহারে অভ্যস্ত তাদের অ্যাজমা, একজিমা-এলার্জির ঝুঁকি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৯ ভাগ বেশি। আরো দেখা যায়, অতিরিক্ত ফাস্টফুড আহারের কারণে শিশুদের নাক ও কানের সংক্রমণ হবার ঝুঁকি বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. খুরশীদ জাহান ইনকিলাবকে বলেন, স্কুল-কলেজ ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফাস্টফুডের দোকান গড়ে উঠছে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই এসব দোকানের আধিক্য বাড়ছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরকে মায়েরা বাসা থেকে টিফিন দিলেও তারা প্রতিষ্ঠানের সামনে গড়ে ওঠা ফাস্টফুডের দোকান থেকেই কিনে খাচ্ছে। তিনি বলেন, গত ১ বছর থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেড়েছে।
দিল্লির একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করে ড. খুরশীদ জাহান বলেন, হঠাৎ করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মুটিয়ে যাওয়া এবং ওভার ওয়েটের কারণ জানতে ২০০৯ সালে একটি গবেষণা করা হয়। এতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজ থেকে বাসাÑ এই সময়ে তারা ফাস্টফুড খাচ্ছে। পর্যাপ্ত খেলার জায়গা না থাকায় বাসায় টিভি ও মোবাইলে কথা বলা এবং গেমস খেলেই দিন পার করছে। তারা কায়িক পরিশ্রম এবং খেলাধুলা করে না। একই সঙ্গে ফাস্ট ফুডে আসক্তি বেড়ে যাওয়ায় সবজি ও ফলসহ সুষম খাবারের প্রতি নজর থাকে না। খাবারের প্রোটিন ও ক্যালরির সমন্বয় হয় না। তাই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।  
ড. খুরশীদ জাহান এ থেকে উত্তরণে ফাস্ট ফুড বাদ দিয়ে সুষম খাবারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। একই সঙ্গে এ বিষয়ে এখনই সচেতনতা বাড়াতে হবে বলে উল্লেখ করেন।
ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির খাদ্য ও পুষ্টি ইনস্টিটিউশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. বেলাল হায়দার বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই ফাস্টফুডে হাইপার ও হাইপো নামে দুই ধরনের ক্যালরির কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তা উল্লেখ নেই। এমনকি কোনটি কী পরিমাণ উপাদানে তৈরি করা তাও উল্লেখ থাকে না। এতে গুণাগুণ চিন্তা করার সুযোগ থাকছে না। এ কারণে মানুষ নানা ধরনের অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা জানান, অস্বাভাবিক মোটা হওয়ার কারণে মানুষের শরীরে ইনসুলিন নামক হরমোন ঢুকতে পারছে না। এতে জীবকোষ নষ্ট হয়ে টাইপ-১ ডায়বেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এদের শরীরে ইনসুলিন ব্যবহারের বিকল্প নেই। এই ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের হার কম। টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার অনেক বেশি। খাদ্যাভাস, কায়িক পরিশ্রম, লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করে এই ধরনের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির সভাপতি প্রফেসর ডা. একে আজাদ খান বলেন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে ফাস্টফুডের দোকান রয়েছে। এসব দোকানের খাবারে কোনো ক্যালরির পরিমাণ উল্লেখ নেই। এসব খাবার খেয়ে শিশুরা অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে শিশুদের মধ্যে বাড়ছে নানা অসংক্রামক রোগ।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশনে (বিএসটিআই) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খাবারে ক্যালরির পরিমাণ নির্ণয় কিংবা প্যাকেটের গায়ে লেখার প্রবণতা এখনো দেশে গড়ে ওঠেনি। শুধু ইনফ্যান্ট ফর্মুলায় খাদ্যগুণ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়। খাবারে ক্যালরির পরিমাণ উল্লেখ করার বিষয়টি জাতীয় মানেও উল্লেখ নেই। আর এ কারণে উৎপাদনকারীরা এটি উল্লেখ করছেন না।
দক্ষিণ এশিয়ার অ্যান্ড্রোক্রাইনোলজি সোসাইটির সভাপতি প্রফেসর ডা. ফারুক পাঠান বলেন, অস্বাস্থ্যকর লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করে ৭০ ভাগ টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এক সময় ৫০-৬০ বছরের মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেও বর্তমানে শিশুসহ সব বয়সের মানুষই আক্রান্ত হচ্ছে। এজন্য ৩০-৩৫ বছর বয়সেই মানুষের শরীরে ডায়াবেটিস রয়েছে কীনা তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
বিশিষ্ট পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডা. খুরশীদ তালুকদার ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের দেশের ফাস্টফুডের হাইজিন নিয়ে সমস্যা আছে। কোনো ধরনের স্ট্যান্ডার্ড মানা হয় না। তেল বেশি থাকে। আবার একই তেল দিয়ে দীর্ঘদিন খাবার তৈরি করা হয়। তিনি এ থেকে উত্তরণে বাবা-মাদের প্রতি বাসায় তৈরি খাবারের প্রতি জোর দিতে বলেন। বাসার খাবারের কোনো বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।
২০০৯ এবং ২০১২ সালের দেশের একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, স্কুল-কলেজের বাচ্চাদের অতিরিক্ত মুটিয়ে যাচ্ছে। ৫ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার হার স্বাভাবিকের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি। এসব বাচ্চারা খেলাধুলার সুযোগ না পাওয়ায় শারীরিক এ্যাকটিভিটিস নেই বললেই চলে। তাই বাচ্চারা প্রতিদিন কি খাচ্ছে এদিকে নজর রাখতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
সোনিয়া সুলতানা ১৪ নভেম্বর, ২০২২, ৫:২৭ পিএম says : 0
আমি অনেক উপকৃত হলাম thanks
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন