বরিশাল ব্যুরো : অর্থ সংকটে বরিশাল সিটি করপোরেশন-এর নগর সেবামূলক কার্যক্রমসহ প্রশাসনিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়ছে। নগর ভবনের স্থায়ী প্রায় সাড়ে ৫শ’ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি দৈনিক মজুরীভিত্তিক আরো প্রায় দেড় হাজার পরিচ্ছন্ন কর্মীর বেতন দিতে না পারায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে বিসিসি কর্তৃপক্ষ। নগর প্রশাসনের ঘাড়ের ওপর চেপেবসা প্রায় দেড় হাজার দৈনিক মজুরীভিত্তিক কর্মচারী পুষতে গিয়ে প্রশাসনিক ব্যয় মেটাতে পারছে না এ সিটি করপোরেশন।
স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চেয়ে অস্থায়ী প্রায় দেড় হাজার জনবল পুষতে প্রশাসনিক ব্যয় দ্বিগুণ বেড়েছে নগর ভবনের। ইতোমধ্যে ৫ মাস বেতন-ভাতা বকেয়া পড়েছে নগর ভবনের স্থায়ী কর্মীদের। অস্থায়ী শ্রমিকদের বকেয়াও দু’মাস। নগরীর পরিচ্ছন্নতা সহ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই এ বিশাল শ্রমিক বহর পুষছে নগর ভবন। কিন্তু এ নগরীতে দিন দিন জঞ্জাল ব্যাপ্তি লাভ করছে। সামান্য বৃষ্টিতেই ভেঙে পড়ছে নগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। নগরীর রাস্তাঘাট মেরামত ও উন্নয়নেও বাড়ছে দুর্নীতির অভিযোগ। বকেয়া বেতন-ভাতার দাবীতে বারবারই কর্মকর্তারা পর্যন্ত কর্মচারীদের সাথে নিয়ে আন্দোলনে নামছে। ঘণ্টার পর পর ঘণ্টা কর্মবিরতিও পালন করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ। নগর প্রশাসনের আশ্বাসে সাময়িক আন্দোলন স্থগিত করা হলেও ক্ষোভ আছে আন্দোলনকারীদের মধ্যে।
২০১৩ সালের নির্বাচনে মেয়রসহ দু-তৃতীয়াংশ কাউন্সিলর বিরোধী দলের হওয়ায় আগের মত থোক বরাদ্দ মিলছে না সরকারী কোষাগার থেকে। তবে যে নগর কর দিয়ে প্রশাসনিক ব্যয় মেটানোর কথা, তাও বকেয়া রয়েছে ১০ কোটি টাকার ওপরে। সে কর আদায়ে গতকাল থেকে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে বরিশাল সিটি করপোরেশন।
নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে গতকাল থেকে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। করদাতাদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে তাগিদ প্রদান শুরু হয়েছে। কিন্তু বকেয়ার সিংহভাগই বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে। সেখানে তাগিদ দিয়েও আপাতত কোন অর্থ আদায় হচ্ছে না। ফলে এ অভিযানের ফলাফল কতটুকু আশাব্যঞ্জক হবে তা সময়ই বলতে পারবে বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। ইতোমধ্যে কর খেলাপী সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তাগাদাপত্রসহ ব্যক্তিগত যোগাযোগও শুরু হয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের করার কিছু নেই অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তহবিল না মিললে। তারা নগর কর পরিশোধ করতে পারছে না।
শনিবার থেকে বিসিসি’র ১০ কোটি টাকা বকেয়া আদায়ে তৎপরতার অংশ হিসেবে প্রায় ৫ হাজার হোল্ডিং গ্রহীতাকে তাগিদ পত্র প্রদান করা হয়েছে। তাতেও কাজ না হওয়ায় গতকাল থেকে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে নামছে ৩০টি টিম।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বেতন-ভাতার দাবিতে ৫ঘণ্টা করে টানা ৪ দিন কর্মবিরতি পালন করেছে বরিশাল সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ কর্মবিরতিতে স্থবির হয়ে পড়ে নগর ভবন। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েন নগরীর বাসিন্দারা। পরে চলতি মাসের মধ্যে ৩ মাসের বেতন পরিশোধসহ প্রতি মাসের ৫ তারিখের মধ্যে নিয়মিত বেতন প্রদান, প্রভিডেন্ট ফান্ডের ৩৬ মাসের অর্থ তহবিলে জমা করাসহ বেতন বৈষম্য দূরীকরণ এবং অপ্রয়োজনীয় জনবল বাতিলের আশ্বাসে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হয়। এ অবস্থায় অর্থ সংগ্রহে দিশাহারা হয়ে পড়েছে বিসিসি কর্তৃপক্ষ।
বিসিসি’র কর শাখা সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে ৪৪ হাজারের বেশী হোল্ডিং রয়েছে। যাদের কাছে ১০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বিসিসি’র। যার অর্ধেকই সরকারী প্রতিষ্ঠান। সরকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিভিন্ন বিদ্যালয়সহ শিক্ষা বিভাগের কাছে পাওনা এক কোটি টাকার বেশী। এর মধ্যে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র-টিটিসি’র কাছে ২৬ লাখ টাকা। একই ভাবে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যুবক হাইজিং-এর কাছে পাওনা রয়েছে ১০ লাখ টাকা, হোটেল এ্যারিনার কাছে ২ লাখ টাকা, হোটেল বাহাদুরের কাছে দেড় লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিপুল নগর কর পাওনা রয়েছে। যদিও গত জানুয়ারীতে বিএম কলেজের কাছে পাওনা ৯৫ লাখ টাকার মধ্যে ৮০ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এ জন্যও ড্রেনেজ ব্যবস্থা সহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচী দাবী করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
নগরীর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরগণ নাম প্রকাশ না করা শর্তে জানান, মাঠ পর্যায়ের কিছু কর্মচারী ও কয়েকজন কর্মকর্তা নানা অনৈতিক কাজের সাথে জড়িত। এদের কয়েকজন নিজ দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে কর্মচারীদের আন্দোলনে উসকে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সিটি করপোরেশনের জোরদার মনিটরিং হলে সব দুর্নীতি দূর হবে। এমনকি বকেয়া টাকাও আদায় করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন ঐ সব কাউন্সিলরগণ। বকেয়া কর পরিশোধ না করলে মালামাল ক্রোকের পরোয়ানা জারী করা হবে বলেও জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা। পরোয়ানা জারীর ১৫ দিনের মধ্যে বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হলে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে মালামাল ক্রোক করা হবে। বকেয়া অর্থ আদায়ে তারা কঠোর অবস্থানে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
এব্যাপারে বিসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো: ওয়াহিদুজ্জামান সাংবাদিকদের জানান, বকেয়া অর্থ আদায়ে তারা নানা কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন। টাকা পরিশোধের জন্য নোটিশ দেয়া হয়েছে। পরে তাগিদপত্র প্রদান করা হয়েছে। শনিবার থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বকেয়া অর্থ আদায়ের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তাতেও কাজ না হলে পরে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, বর্তমান নগর প্রশাসন দেড়শতাধিক কোটি টাকার দায়দেনা নিয়ে ২০১৩ সালের অক্টোবরে দায়িত্ব গ্রহণ করে। সে সময় নগর ভবনের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বকেয়া ছিল ৩ মাসের। নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়ন হওয়াসহ ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বর্তমান প্রশাসন আমলে ৫ মাসের বেতন বকেয়া পড়ে। জানুয়ারীতে অবশ্য দু’মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। চলতি মাসে আরো দু’মাসের বেতন প্রদানের কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন