মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
১. যদি খৃস্টানরা হজরত ঈসা (আ.)কে ‘খোদা’ কিংবা খোদাপুত্র সাব্যস্ত করে, সেটা বাড়াবাড়ির কারণেই করে থাকে।
২. যদি ইহুদিরা হজরত উজায়ের (আ.)কে খোদাপুত্র স্থির করে, সেটা বাড়াবাড়ির ফলেই করে থাকে।
৩. যদি আরবের মুশরিকদল কিংবা অন্যান্য কাফের, মুশরিকেরা মূর্তি পূজোর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে থাকে, সেটা বাড়াবাড়ির ফলেই করেছিল।
৪. যদি কতক দল হজরত আলী (রা.)-এর ব্যক্তিত্বকে আল্লাহর সমমর্যাদার মনে করে থাকে, সেটা বাড়াবাড়ির ফলেই করে থাকে।
৫. যদি মানুষ আউলিয়ায়ে কেরাম, শহিদানকে প্রয়োজন পূরণকারী ও আপদ থেকে উদ্ধারকারী মনে করে, তাদের কাছে নিজেদের প্রয়োজনের ব্যাপারে তলব করে, বিপদাপদ থেকে মুক্তির দরখাস্ত করে, তাহলে সেটা বাড়াবাড়ি ধরনের একপ্রকার ব্যাধির প্রভাবেই করে থাকে।
৬. যদি আল্লাহঅলাদের মাজারে তওয়াফ কিংবা সেজদা করা হয়, তাহলে সেটা দীনের মাঝে বাড়াবাড়ি করার কারণেই করা হচ্ছে।
৭. যদি খাওয়ারিজ সম্প্রদায় হজরত আলী (রা.)-সহ বহুসংখ্যক সাহাবায়ে কেরামকে কাফের সাব্যস্ত করে, তাহলে সেটা বাড়াবাড়ির ফলেই করে থাকে।
৮. যদি কাদরিয়্যা, জাবরিয়্যা সম্প্রদায় তাকদির তথা ভাগ্য বিষয়ে বান্দার শক্তি থাকা না থাকার ব্যাপারে দুটো ভিন্ন ভিন্ন পথপন্থা অবলম্বন করে থাকে, সেটা বাড়াবাড়ির ফলেই করে থাকে।
৯. যদি মুজাসসামা, মুয়াত্তিলা সম্প্রদায় আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে শরীর থাকা বা তার বেকার বসে থাকা বিষয়ে দুটো ভিন্ন ভিন্ন পথপন্থা অবলম্বন করে থাকে, সেটাও বাড়াবাড়ির ফলেই করে থাকে।
১০. রাসূল (সা.)-এর পরিবার ও আইম্মায়ে কেরামের ব্যাপারে তাশঈ সম্প্রদায়ের গোঁড়াধরনের বিশ্বাস; আর তাদের ব্যাপারে নাসিব সম্প্রদায়ের কাফের ও পাপাচারী হবার ফতোয়া যদি দেয়া হয়, তাহলে সেটা বাড়াবাড়ির ফলেই দিয়ে থাকে।
সারকথা, এ যুগের সবধরনের বেদাত, গোমরাহি, কু-আকিদা, বদআমলের পেছনে চিন্তাভাবনা করলে তার মূল কারণ হিসেবে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িটাই অনায়েসে বেরিয়ে আসে। অথচ ইসলাম ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটাকে বিল্কুল পছন্দ করে না। বরং এ বিষয়ে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।
বাড়াবাড়িগুলি যদিও প্রথমে অতি স্বাভাবিক বোধ হয় এবং মানুষ তাতে খুব বেশি গুরুত্ব না দেয়, কিন্থ এগুলোই একদিন ধীরে ধীরে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, জাতিকে সিরাতে মুস্তাকিম তথা দীনের মধ্যমপন্থা থেকে দূরে সরিয়ে ফেলে।
ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা আসলে কী?
কোনো নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করাকে আরবি ভাষায় ‘গুলু’ তথা বাড়াবাড়ি বলা হয়। আর শরিয়তে যে জিনিসের যেই সীমা নির্ধারিত রয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে যাওয়াকে শরিয়তের পরিভাষায় গুলু তথা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা বলে।
আইম্মায়ে লোগাতের মতে ‘গুলু’ শব্দের পরিচয়
১. ইমামুল লোগাত হজরত আল্লামা ইবনে ফারিস (রহ.) বলেন, ‘গুলু শব্দের গাইন, লাম ও হরফে ইল্লত ওয়াও বর্ণ আরবিভাষায় আসল, সহিহ। যা উঁচু ও নির্ধারিত স্থান অতিক্রম করার ওপর বোঝানো অর্থে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং বলা হয় ‘গালাস সা’রু গুলুওয়ান’ অর্থাৎ দাম বেড়ে যাওয়া বা ঊর্ধ্বমূল্যের হওয়া। আরও বলা হয় ‘গালার রজুলু গুলুওয়ান’ অর্থাৎ লোকটি তার লেনদেনে সামনে বেড়ে গেলো। এটা তখনই বলা হয়, যখন সে তার স্বাভাবিক সীমা অতিক্রম করে ফেলে। আরও বলা হয় ‘গলা বিসাহমিহি গুলুওয়ান’ অর্থাৎ সে তার তীর বহুদূরে মেরেছে। এটা তখন বলা হয়, যখন সে তার তীর বহুদূরে নিক্ষেপ করে।’ (মাকায়িসুল লুগাত : ৪/৩৮৭)।
২. ইমাম আবুবকর আল জাসসাস রাজি (রহ.) বলেন, ‘যে জিনিসের যে নির্ধারিত সীমা, তা থেকে বেরিয়ে যাওয়া হলো ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি।’ (আহকামুল কোরআন : ৩/২৮২)।
৩. ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.) বলেন, ‘গুলু হচ্ছে সীমাতিক্রম করার নাম। আর সেটা এভাবে, কারোর প্রশংসা বা নিন্দায় তার প্রাপ্য থেকে বৃদ্ধি করা।’ (ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম : ১/২৮৯)।
৪. হজরত মাওলানা আবদুল মাজিদ দরিয়াবাদি (রহ.) বলেন, ‘আকাইদ ও মাসাইলের মাঝে নিজের পক্ষ থেকে কমবেশি করাকে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা বলে।’ (তাফসিরে মাজিদি : ১/৮৩৮)।
৫. মুফাসসিরে কোরআন হজরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) বলেন, ‘সীমা থেকে বেরিয়ে যাওয়াকে গুলু তথা বাড়াবাড়ি বলা হয়। আর ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার অর্থ হলো, আকিদা-বিশ্বাস ও আমলের ক্ষেত্রে ইসলাম যেই সীমা নির্ধারণ করেছে, তা থেকে কোনো কিছুকে বৃদ্ধি করা। যেমন আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.)-কে সম্মান প্রদর্শনের সীমারেখা হলো, তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্টিকুলের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করা। সুতরাং এই সীমারেখাকে আরও বৃদ্ধি করে তাদেরকেই আল্লাহ অথবা তার পুত্র বলা ইতিকাদি গুলু তথা আকিদা-বিশ্বাসগত বাড়াবাড়ি।’ (মাআরিফুল কোরআন : ৩/২১০-২১১)। সারকথা, শরিয়ত যে জিনিসের যেই সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা থেকে বৃদ্ধি করা এবং শরিয়তের ঐ সীমা অতিক্রম করা গুলু ফিদ্দিন তথা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি। চাই সেটি আকাইদ বা শাখাগত মাসাইলের যে কোনো বিষয়ে হোক না কেন। আর এই মাসাইল চাই ইবাদতের সঙ্গে সম্পর্কিত হোক বা মুয়াশারা তথা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকের সঙ্গে সম্পর্কিত হোক, আখলাক তথা চারিত্রিক বিষয়ে হোক বা লেনদেনের সঙ্গে সম্পর্কিত হোক, রাজনীতি ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে হোক কিংবা সীমা ও শরয়ি দ-বিধির ক্ষেত্রে হোক; কোনো অধ্যায়েই শরয়ি সীমা থেকে আগে বেড়ে যাওয়াই হলো গুলু ফিদ্দিন তথা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি।
এ কথা জানা উচিত, ইসলাম এমন একটি মাজহাব তথা ধর্ম, যার মাঝে প্রতিটা জিনিসেরই সীমা নির্ধারিত। চাই তা আকিদা-বিশ্বাস হোক, ইবাদত হোক, হুকুক তথা অধিকার হোক, আদব তথা শিষ্টাচার হোক, মুয়াশারা তথা সামাজিকতা ও তাহজিব তথা সংস্কৃতি হোক, আখলাক তথা চারিত্রিক বিষয় হোক; সমস্ত বিষয়েই আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর বয়ান করা সীমা নির্ধারিত। যা অতিক্রম করা অবৈধ। এরশাদ হচ্ছে ‘এটা আল্লাহ নির্ধারিত সীমারেখা। সুতরাং এর থেকে বৃদ্ধি কোরো না। যে-ই আল্লাহর এই নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করবে, সে-ই জালেম।’ (সুরা বাকারা : ২২৯)।
মোটকথা, ইসলাম ধর্মে প্রতিটা জিনিসের প্রতিটা হুকুম-কানুন একটি নির্ধারিত সীমা ও মাপকাঠির সঙ্গে রয়েছে। আর সেটা প্রকৃতপক্ষে ইসলামেরই সৌন্দর্য ও পূর্ণতা। ইসলামে কোনো কথা বা বিষয় বেমানান, অশ্লীল, অমার্জিত, গায়রে মুতাদিল তথা ভারসাম্যহীন পর্যায়ের নেই। বরং একটু মাথা খাটালেই এ কথা স্পষ্ট হয়, ইসলামের প্রতিটা জিনিসই একটি নির্ধারিত সীমারেখা ও মূলনীতির সঙ্গে বহাল রয়েছে। যেন ইসলামের সৌন্দর্য ও পূর্ণতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবশিষ্ট থাকে এবং এই সৌন্দর্যের ওপর কোনো ধরনের প্রশ্ন না ওঠে, সে জন্য এই সীমারেখা ও বেষ্টনীকে অবশিষ্ট রাখাও অপরিহার্য। তাই ইসলামের এই সীমারেখা ও বেষ্টনীকে এর যাবতীয় শর্ত ও পন্থাসহ হুবহু বহাল না রাখা এবং এ থেকে অতিক্রম করা হারাম ও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আর এই সীমাতিক্রমটাকেই ‘গুলু ফিদ্দিন’ তথা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা বলে।
মধ্যমপন্থা ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম উম্মাহর অনন্য বৈশিষ্ট্য
গুলু ফিদ্দিন তথা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা ইসলামের স্বভাববিরুদ্ধ। কেননা ইসলাম এমন একটি মাজহাব বা ধর্ম, যা প্রতিটা বিষয়ে নিজের সমস্ত শিক্ষা, বিধিবিধানে ইতিদাল তথা মধ্যমপন্থায় রেখেছে। এতে না ইফরাত তথা বাড়াবাড়ি রয়েছে, আর না তাফরিত তথা কম রয়েছে। বরং ইসলাম সেসব বেইতিদালি তথা ভারসাম্যহীনতা থেকে মুক্ত ভারসাম্যপূর্ণ একটি মাজহাব। এজন্যই ইসলামকে সিরাতে মুস্তাকিম তথা সরল সঠিক পথপন্থা বলা হয়। আর এই সিরাতে মুস্তাকিমের ওপর অটল অবিচল থাকবার প্রার্থনাও আমাদের শেখানো হয়েছে। সুরা ফাতিহা, যা মূলত প্রার্থনাই শেখায়। তাতে এই প্রার্থনা রয়েছে ‘হে আল্লাহ, আমাদেরকে সরল সঠিক পথে পরিচালিত করো। তাদের পথে, যাদের ওপর তুমি খুশি হয়েছো; তাদের পথে নয়, যাদের ওপর তুমি অখুশি হয়েছো; আর তাদের পথেও নয়, যারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে।’ (সুরা ফাতিহা : ৬-৭)।
সিরাতে মুস্তাকিম তথা সরল পথই হলো ধর্মের পথ; আয়াতে যার প্রার্থনা রয়েছে। এরপর এই সিরাতে মুস্তাকিমকে দু’ভাবে বয়ান করা হয়েছে : ১. পুরস্কারপ্রাপ্ত বান্দাদের পথের ধরনে করা হয়েছে। ২. মাগযুব (রব গোস্বা হয়েছেন যাদের ওপর) এবং যাল্লিন (পথভ্রষ্ট)-দের পথ থেকে ভিন্ন পথ সাব্যস্ত করা হয়েছে। মাগযুব হচ্ছে ইহুদি; যারা দীনের মাঝে তাফরিত ও কম করবার কাজে লিপ্ত থাকতো। আর যাল্লিন দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, খৃস্টানজাতি। যারা ধর্মের মাঝে বৃদ্ধিকরণে সদা লিপ্ত থাকতো। এই আলোচনায় সিরাতে মুস্তাকিম এভাবেই নির্দিষ্ট হচ্ছে, সেটি পুরস্কারপ্রাপ্ত লোক তথা আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.), আউলিয়ায়ে কেরাম, সিদ্দিকিন, সালেহিন, মুজাহিদিন, শহিদানের পথ। না ইহুদি (যাদের পথপন্থায় রয়েছে দীনের মাঝে তাফরিত তথা কম করবার বিষয়) আর না খৃস্টানদের পথ (যাতে ইফরাত তথা দীনের মাঝে বৃদ্ধিকরণের বিষয় রয়েছে)। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন