শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

ইসলামী ইবাদতের চতুর্থ রোকন : হজ

সত্যালোকের সন্ধানে

| প্রকাশের সময় : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এ, কে, এম, ফজলুর রহমান মুন্শী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ইব্রাহীম (আ.)-এর দোয়া :
‘মিল্লাতে ইব্রাহীমের’ জন্য দোয়ায়ে ইব্রাহীমি এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। কোরআনুল কারীমের এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে : “স্মরণ কর, ইব্রাহীম (আ.) বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! এই নগরীকে নিরাপদ কর এবং আমাকে ও আমার পুত্রগণকে মূর্তিপূজা হতে দূরে রেখ। হে আমার প্রতিপালক! এ সকল প্রতিমা বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে, সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার দলভুক্ত, কিন্তু কেউ আমার অবাধ্য হলে তুমিই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরদিগের কতককে তোমার গৃহের নিকট অনুর্বর উপত্যকায় আবাদ করলাম, হে আমাদের প্রতিপালক! এ জন্য যে তারা যেন সালাত কায়েম করে। সুতরাং তুমি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দাও এবং ফল-ফলারী দ্বারা তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করে দাও, যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি অবশ্যই জান, যা আমরা গোপন করি ও যা প্রকাশ করি, আকাশম-ল ও পৃথিবীর কিছুই আল্লাহর নিকট গোপন থাকে না।” (সূরা ইব্রাহীম : রুকু-৬)
অপর এক স্থানে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন : “বল, আল্লাহ সত্য বলেছেন, সুতরাং তোমরা একনিষ্ঠ ইব্রাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর, সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নয়।”
মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা ‘বাক্কায়’ উহা বরকতময় ও বিশ্ব জগতের দিশারী। এতে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে, যেমন মাকামে ইব্রাহীম এবং যে কেউ সেথায় প্রবেশ করে সে নিরাপদ। মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর  উদ্দেশ্যে ঐ গৃহে হজ করা তার অবশ্য কর্তব্য। এবং কেউ প্রত্যাখ্যান করলে সে জেনে রাখুক, “আল্লাহ বিশ্বগজতের মুখাপেক্ষী নন”। (সূরা আলে-ইমরান : রুকু-১০) এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, উপরোল্লিখিত দুটি আয়াত মূল বিষয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এতে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, “আমি ইব্রাহীম (আ.)-কে মূর্তি পূজারি ও নক্ষত্র পূজারির দেশ হতে যেখানে বিরুদ্ধাবাদী বেদুইনরা বসবাস করত, এমন এক নিরবচ্ছিন্ন শান্তিময় স্থানে নিয়ে গেলাম যার তালাশে তিনি উদ্বেল ছিলেন। যাতে করে তিনি এক আল্লাহর উপাসনার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ করতে পারেন। ফলে আমি তাকে সেই ঠিকানা বলে দিলাম, যা প্রথম থেকেই এ কাজের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। যেন তিনি আল্লাহর গৃহের চারটি দেয়াল সমুচ্চ করতে সক্ষম হন এবং একে তাওহীদের প্রাণকেন্দ্র এবং ইবাদত-বন্দেগীর শান্তিময় নিবাস করতে প্রয়াস পান।”
বস্তুত এই স্থানটি ছিল বিরান এবং অনুর্বর ও অনুৎপাদনশীল। এ জন্য হযরত ইব্রাহীম (আ.) দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ! এখানে তোমার পবিত্র গৃহের পাশে আমার কিছু সন্তান-সন্ততি আবাদ করলাম। তাদেরকে তুমি রুজি দান কর এবং মানুষের মনকে এর প্রতি আকর্ষিত করে দাও, যেন তারা এদিক দিয়ে আসা-যাওয়া করে। আর তাদেরকে এ জন্যই আমি এখানে আবাদ করছি, যেন তারা আশেপাশের মূর্তি পূজারি গোত্রগুলোর সংস্পর্শ হতে নিরাপদ থাকতে পারে এবং তোমার ইবাদত খালেসভাবে সম্পন্ন করতে পারে। তবে এদের মাঝে যারা পুণ্যবান, তারা আমারই দলভুক্ত। আর যারা বদকার ও পথভ্রষ্ট হবে, তবে তাদের মালিক একমাত্র তুমিই। প্রকৃতই তুমি ক্ষমাশীল ও দয়াময়। হে আল্লাহ! আমার সন্তান-সন্ততির মাঝে এমন এক রাসূল প্রেরণ কর, যিনি তাদেরকে নেক শিক্ষা প্রদান করবেন।”
আল কোরআনের দাবি হচ্ছে এই যে, এই স্থান এবং এই কাবা গৃহে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর বহু স্মৃতি বিজড়িত আছে। এই স্থান হচ্ছে পুণ্যবানদের দাঁড়ানোর স্থল, নামাজ আদায়ের স্থান এবং কোরবানির মোকাম। এ জন্য দূর-দূরান্ত হতে লোকজনের এখানে আগমন করা উচিত এবং দ্বীন ও দুনিয়ার ফায়দা হাসিল করা বাঞ্ছনীয়। এই প্রাচীন গৃহকে তাওয়াফ করা এবং এখানে হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর স্মরণে কোরবানি করে তা গরিবদের মাঝে বিতরণ করা এবং নিজেদের নিয়ত ও উদ্দেশ্যসমূহ পূরণ করা খুবই দরকারি।
এ অনুষ্ঠান পালনে এমন শান্ত ও একনিষ্ঠ হওয়া খুবই প্রয়োজন, যাতে করে কাহারো ওপর অস্ত্রাঘাত করতে না হয়, না একটা ক্ষুদ্র পিপীলিকাকেও হত্যা করতে হয় এবং একই সাথে বাহ্যিক আড়ম্বর, জৌলুস ও আরাম-আয়েশপূর্ণ কৃত্রিম জীবন হতেও নিজেকে বিমুক্ত রাখতে হবে।
বরং এই পবিত্র কর্মানুষ্ঠানে কিছু দিন নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে ইব্রাহীম  (আ.)-এর স্মৃতিসমূহের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে এবং তারই মতো জীবন-যাপনে তৎপর হবে এবং তারই মতো আল্লাহপাকের স্মরণে নিমগ্ন থাকবে।
তৌরিতের ভাষা অনুসারে জানা যায় যে, হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর সন্তান-সন্ততিদের মাঝে এই নিয়ম চালু ছিল যে, তারা যেখানেই আল্লাহ প্রদত্ত নিদর্শনের সন্ধান পেত, সভ্যতার সেই বিকাশ লগ্নে কোনো বৃহত্তর নির্মাণশৈলীর পরিবর্তে তারা পতিত পাথরগুলোকে জড়ো করে আল্লাহর ঘর নির্মাণ করত। সেখানে কোরবানি করত এবং আল্লাহর ইবাদত করত। খানায়ে কাবা ছিল এ শ্রেণিরই একটি গৃহ মাত্র।
তৌরিতের বিবরণে এটাও জানা যায় যে, আল্লাহর ঘরের খেদমত ও ইবাদতের জন্য যে ব্যক্তিকে উৎসর্গ করা হতো সে ইবাদতগুজারির দিনগুলোতে মাথার চুল মুড়াত না। উৎসর্গের দিন অতিবাহিত হওয়ার পর তার মাথার চুল মোড়ানো হতো। আর তৌরিতের বিবরণে এ কথা জানা যায় যে, এই গৃহের ছাদের ওপর আরোহণ কর না, যেন তোমার দেহের নগ্নতা প্রকাশ পেতে না পারে। এতে বোঝা যায় যে, এই ইবাদতের সময়ে তারা সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করত এবং কোমরে তহবন্দ পেঁচিয়ে রাখত। (প্রস্থান ২০-২৬) তৌরিতের ফার্সি অনুবাদ হতে জানা যায় যে, আল্লাহপাক যখন হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর কোরবানির জন্য আওয়াজ দিলেন, তখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) উত্তর
করলেন, ‘লাব্বাইক’ অর্থাৎ আমি উপস্থিত আর এই প্রত্যুত্তর ধ্বনিই “লাব্বাইকা আল্লাহুমা লাব্বাইকা” ইসলামী হজের চলাফেরা, উঠাবসা সর্বত্র গুঞ্জরিত হয়।
তৌরিতের বর্ণনা অনুসারে আরো জানা যায় যে, যে ব্যক্তি বা বস্তুকে কুরবানীর জন্য উৎসর্গ করা হত অথবা কুরবানী করা হত, তাকে কুরবানগাহের চতুষ্পার্শ্বে প্রদক্ষিণ করানো হত। এই প্রদক্ষিণকে হজের সময়ে তাওয়াফ বলা হয়। এই তাওয়াফও হজের একটি বিশেষ করণীয় কাজ। মোটকথা, হজের যাবতীয় কর্মকা-ে হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর স্মৃতি জড়িত আছে। আর এই স্মৃতিগুলোর সমষ্টিগত বাস্তবায়নকেই ইসলামে ‘হজ’রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং তা নিষ্ঠার সাথে আবহমানকাল ধরে পালিত হয়ে আসছে।
যিয়ারতে কা’বার হাকীকত :
এই পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুর মাঝেই রয়েছে বিশেষ হেকমত ও বৈশিষ্ট্যাবলী। তাই যিয়ারতে কা’বা ও হজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আল্লাহ পাকের রতমত ও বরকতের কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থিত হওয়া এবং হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর মত আল্লাহ পাকের আহ্বানে লাব্বাইক বা হাজির বলে জবাব দেয়া। এতে করেই এই মর্যাদাশীল কুরবানী ও আত্মত্যাগের প্রতি দেহ-মন উদ্বেল হয়ে উঠে এবং নতুন প্রাণ বন্যার জোয়ার বইতে থাকে।
মোটকথা, আল্লাহ পাকের দু’জন পিয়ারা বান্দাহর অনুসরণে মহান রাব্বুল আলামীনের নির্দেশের সামনে সার্বিক আনুগত্য, রেজামন্দি, ফরমাবরদারী ও অত্মোৎসর্গের সাথে স্বীয় গর্দান অবনমিত করা এবং তাঁর প্রদত্ত অঙ্গীকারকেও তাঁর আনুগত্য প্রকাশকে এমনিভাবে আদায় করা। যেভাবে তাঁরা আজ হতে হাজার হাজার বছর পূর্বে আদায় করেছিলেন এবং আল্লাহ পাকের অনুকম্পা ও ক্ষমার দ্বারা সৌভাগ্যশালী হয়েছিলেন। এটাই হচ্ছে প্রকৃত মিল্লাতে ইব্রাহিমী এবং ইসলামের আসল প্রাণবন্ত রূপ। এই প্রাণবন্যা, এই অভ্যন্তরীণ অনুভূতি ও উদ্দীপনা যেগুলোকে হজ আদায়কারী সে বুযুর্গ সত্তাদের পবিত্র কর্মকা- এবং প্রাচীন  দস্তর মোতাবেক হজ আদায়কালে স্বীয় কাজ ও কর্তব্য নিষ্ঠার ভিতর দিয়ে বাস্তবে প্রতিফলিত করেন। তারা সভ্যতার শুভ সূচনালগ্নের মতো এ সময়েও সেলাইবিহীন দু’প্রস্থ সাদা কাপড় পরিধান করেন। একই সাথে নিজেদেরকে হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর মত আল্লাহর সন্নিধানে উৎসর্গ করতে থাকেন। এ কারণেই তারা দিনগুলোতে নিজেদের মাথার চুল মুড়ান না। এমনকি ছেঁটে ছোটও করেন না। শুধু তাই নয়, দুনিয়ার আরাম-আয়েশ এবং প্রাচুর্যময় জিন্দেগী থেকেও দূরে থাকেন। কোনরকম সুগন্ধি ব্যবহার করেন না, রঙ্গিন কাপড় পরিধান করেন না, মাথা আচ্ছাদিত করেন না এবং এমন আগ্রহপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে অগ্রসর হন, যেভাবে হযরত ইব্রাহীম ও হযরত ইসমাঈল (আ:) তিন দিনের দূরত্ব অতিক্রম করে, ধূলিবালি বিমলিন অবস্থায় আল্লাহর গৃহে দৌড়ে চলে আসতেন। যেভাবে হযরত ইব্রাহীম (আ:) আল্লাহর আহ্বানে ‘লাব্বাইক’ বলেছিলেন, ঠিক তেমনি সেই  চার হাজার বছর পূর্বেকার ধ্বনি তাদের জবানেও ধ্বনিত হতে থাকে, “হে আল্লাহ! আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির! আমি হাজির থেকে ঘোষণা করছি, তোমার কোনই শরীক নেইÑ হে আল্লাহ!
আমি আছি। আমি একথার স্বীকৃতিও দিচ্ছি যে, সকল প্রশংসা এবং সকল সাজ ও নিয়ামত কেবলমাত্র তোমারই জন্য, যাবতীয় সা¤্রাজ্য কেবল তোমারই নিমিত্ত। হে আল্লাহ! তোমার কোনই অংশী নেই।” (সহীহ মুসলিম : হজ অধ্যায়)
এই খেদমতের অনুপ্রেরণা সুলভ তান এবং তাওহীদের ধ্বনি ঐ সকল স্থানেই বুলন্দ করে ফিরতে থাকেন, যেখানে সেই দু’জন মহাত্মার কদম পড়েছে আর যেহেতু যিয়ারতকারী স্বয়ং নিজেকে রূহানীভাবে আল্লাহর কুরবানগাহে উৎসর্গ করার জন্য বহির্গত হন, এজন্য নিজেকে সাতবার ‘বাইতে ঈল’ বা ‘আল্লাহর গৃহের’ চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করিয়ে উৎসর্গ করতে থাকেন। তারপর সেখান হতে (সাফা হতে মারওয়া) যেখান পর্যন্ত হযরত ইব্রাহীম (আ:) দৌড়ে ফিরেছিলেন, এই উদ্দেশ্যে যে মারওয়া পৌঁছার পর ছেলেকে কুরবানী করবেন, সে সকল স্থানে আমরাও দৌড়াই এবং দোয়া করি এবং অপরাধসমূহের মার্জনাকল্পে প্রার্থনা জানাই।
এমনিভাবে আরাফাতের সুবিশাল মাঠে সমবেত হয়ে নিজের অতীত জীবনের গোনাহ ও অপরাধসমূহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং আল্লাহর সামনে নিতান্ত দৈন্যতাসহ ক্ষমা ভিক্ষা করি। এরই সাথে বয়ে চলে আমাদের অশ্রুর বন্যা, মার্জনা করা হয় অপরাধসমূহ। আর অনাগত জীবনের জন্য আল্লাহর কাছে স্বীয় দাসত্ব, বন্দেগী এবং আনুগত্যের নতুন শপথ ও অঙ্গীকার গ্রহণ করি। আর এখানেই হজ ও যিয়ারতের মূল স্তম্ভ নিহিত রয়েছে। (জামে তিরমিজী: কিতাবুল হজ)
এই ঐতিহাসিক ময়দান এবং এই ঐতিহাসিক অঙ্গীকারের স্মরণ, সেই বুযুর্গদের পদাঙ্ক অনুসরণ এবং তাদের দোয়া ও মোনাজাতের অধিষ্ঠানসমূহ, ঐশীতাজাল্লী সমৃদ্ধ দৃশ্যাবলী দূর-দূরান্তের এই সফর নানা প্রকার কষ্টসহ্য করার প্রবণতা, অধিকাংশ লোকের জীবনে অন্তত একবার এই স্থানে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ লাভ করা, লাখো আল্লাহর বান্দাহর একই রংয়ে, একই লেবাস-পোশাকে, একই আকার-আকৃতিতে, একই স্থানে, একই হালতে এবং প্রেম ও ভালোবাসায় উদ্বেল হয়ে, এক মরুময় বিশুষ্ক ময়দানে সমবেত হওয়া এবং অগ্নিক্ষরা খরতাপে উত্তপ্ত পাহাড়ের কোলে সমবেত হয়ে উচ্চঃস্বরে দোয়া ও মোনাজাত করা এবং অতীত জীবনের বরবাদী ও গোনাহসমূহ থেকে মুক্তির প্রয়াসে রোদন করা এবং স্বীয় অপরাধের স্বীকৃতিসহ এক অভূতপূর্ব অনুভূতি নিয়ে মনের একান্ত কামনা প্রকাশ করার মাঝে হজ ও যিয়ারতের এক অনন্য আকর্ষণ নিহিত রয়েছে।
কারণ, এখানে উপস্থিত হলে স্বভাবতই মনে পড়ে যে, এটা ঐ স্থান যেখানে হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ (আ:) হতে শুরু করে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:) পর্যন্ত বহু আম্বিয়া একই হালতে, একই সুরতে, একই কাপড় পরিধান করেছিলেন। এমন এক রূহানী দৃশ্য, এমন এক পরিবেশ, এমন এক প্রভাব-প্রতিক্রিয়া, এমন এক আকর্ষণ এত সব অবশ্যই এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মাঝে এমন এক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, যার স্বাদ সারা জীবনেও বিস্মৃত হওয়া যায় না।
তারপর নির্দিষ্ট দিনগুলো পুরো করে নিজের তরফ হতে একটি পশু কুরবানী এবং হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর পায়রবী ও স্বীয় রূহানী কুরবানীর উদাহরণস্বরূপ অপর একটি পশু কুরবানী করতে হয়। সুতরাং তখনকার এই আনুগত্য, এই আত্মনিবেদন, এই আত্মবিস্মৃতি এবং এই কুরবানীকে মুখে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। যা বহুকাল পূর্বে এই ময়দানে, এই পরিবেশে, এই হালতে এবং এই আকৃতিতে দুনিয়ার সর্বপ্রথম তাওহীদের আহ্বানকারী নিজের কাজ ও জবানের দ্বারা প্রকাশ করেছিলেন। ঠিক একই অনুপ্রেরণা হাজী ও যিয়ারতকারীদের মাঝে প্রভঞ্জন তুলতে থাকে এবং তাদের জবান হতে হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর ভাষায় উচ্চারিত আরতি ধ্বনিত হতে থাকে। (সহীহ মুসলিম : কিতাবুল হজ)
আল কুরআনে এর স্বীকৃতি এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে :
“আমি সকল দিক হতে মুখে ফিরিয়ে নিয়ে ঐ সত্তার দিকে নিজের মুখম-ল উপস্থাপিত করলাম, যিনি নভোম-ল ও ভুম-ল পয়দা করেছেন এবং একনিষ্ঠ একেশ্বরবাদী হয়ে অঙ্গীকার করছি যে, আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই।” (সূরা আনয়াম : রুকু-৯)
অপর এক আয়াতে এই স্বীকৃতির বিকাশ এভাবে ফুটে উঠেছে : “অবশ্যই আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ কেবলমাত্র বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য, যাঁর কোন শরিক নেই এবং এ নির্দেশই আমাকে প্রদান করা হয়েছে এবং সর্বপ্রথমে আমিই আনুগত্যের ও ফরমাবর্দারীর (ইসলামের) একরার করছি।” (সূরা আনয়াম: রুকু-২০)
সুতরাং এ সকল দিক-দর্শনের মাঝেই প্রচ্ছন্ন রয়েছে হজের মূল হাকীকত এবং এসবের মাঝেই বিকশিত হয়ে উঠেছে এই মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতের নিয়ম-নীতি ও অপরিহার্য স্তম্ভসমূহ।
তাই একথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, হজ ও যিয়ারত শুধু কেবল বাহ্যিক অনুষ্ঠান আড়ম্বরপূর্ণ ক্রিয়াকর্মেরই সমাহার নয়; বরং এতে রয়েছে আত্মিক ও রূহানী পবিত্রতা অর্জনের এক সুবর্ণ সুযোগ। যে সুযোগ নাগালের ভিতরে এসে গেলে অযথা বিলম্ব না করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা:) বার বার সুতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন