বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শিক্ষাঙ্গন

বর্জ্যজীবী শিশু স্কুল গ্রামবাংলা

| প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শাহনাজ বেগম : দেয়ালে দেয়ালে আটকানো শিশুদের জন্য ছোট বড় রঙিন অনেকগুলো শিক্ষণীয় পোস্টার। এটা বিশাল বর্জ্যস্তূপের খুব কাছে বর্জ্যজীবী পরিবারের শিশুদের জন্য গড়ে ওঠা গ্রামবাংলা স্কুলের চিত্র। চাইল্ড হোপ, ইউ কে/ বিগ লটারি ফান্ডের সহায়তায় গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির বাস্তবায়নের পরিচালিত এটি বর্জ্যজীবী শিশুদের স্কুল। শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার পাশে রয়েছে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষাব্যবস্থা। রয়েছে বর্জ্যজীবী মায়েদের আরো ছোট শিশুদের যতœ সহকারে রাখার জন্য ডে কেয়ার সেন্টার। কিশোরীদের জন্য রয়েছে সেলাই, রান্না ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে অনেকেই।
রাজধানী ঢাকার অদূরে ডেমরা থানার মাতুয়াইলে ডাম্পিং সাইটের বর্জ্যজীবী পরিবারের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে এসব শিশুর বসবাস। কিন্তু স্কুলে পড়াশুনার পাশাপাশি শিখেছে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ভাত খাওয়া। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাসহ সুস্থভাবে বাঁচার নানা কৌশল।
মনি, রাফিয়া, গোলাপিরা স্কুলের বিভিন্ন ক্লাসের শিক্ষার্থী। কিন্তু রবিউলের চিত্র ভিন্ন। তার স্কুলে যেতে ভালো লাগে না। মায়ের সাথে সে বর্জ্যস্তূপের ময়লা-আবর্জনা ঘেঁটে দিন পার করছে। রোগা-পাতলা চেহারার রবিউলের কোন স্বপ্ন নেই। বর্জ্যজীবী জরিনা বানুর স্বপ্ন থাকলেও সাধ্য নেই। গত বছরে গ্রামবাংলা স্কুল থেকে দুই মেয়ে ৫ম শ্রেণি পাস করেছে বিনা বেতনে। কিন্তু মাধ্যমিক স্কুলের ভর্তি আর বইপত্র কেনার চিন্তায় এখন দিশেহারা। অন্যদিকে সীমা, স্বপ্না, বাবু ওদের স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া। কেউ ডাক্তার, কেই পুলিশ অফিসার হতে চায়। স্কুলের কৌতূহলি শিশুদের ছবির মতো মুখগুলো দেখে নিজের মধ্যে এক আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এদের মুখের মধ্যে যেন আগামী সুন্দর জীবন খেলা করে। এরা সবাই স্কুলে যায়। পড়াশনা করে, স্কুলে ভাল রেজাল্ট করে। এসব শিশুদের জন্মনিবন্ধন করা হয়েছে। এবারে পিইসি পরীক্ষায় শতভাগ পাস করেছে। পরবর্তী বছরে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্লাসের অন্য বন্ধুদের সাথে বেবি নাজনীন আক্তার। গোলগাল ফর্সা হাতে পায়ের গড়নে চোখে পড়ার মত বেবি চিকিৎসক হতে চায়। বেবির বাবা নেই। মা ডাম্পিং সাইটে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করে। বেবির মাকে সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। সন্তানের দেখভাল করার সাধ্য নেই। খুব দ্রুত পাত্রস্থ করতে চাই। কিন্তু স্কুলের পক্ষ থেকে থাকে শিশু বিবাহ আইনের জটিলতার পরামর্শ দিয়ে বেবির পড়াশুনা চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করছে।
 ক্লাসে ক্লাসে ছোটবড় শিশুদের কলকাকলীতে মুখরিত গ্রামবাংলা স্কুলটি। স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২২৭ জন। এদের জন্য রয়েছে ১০ জন শিক্ষক। চরম দারিদ্র্যের পাশাপাশি জ্ঞান ও সচেতনতার অভাবে তাদেরকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাকসুদ। ছোট ছোট শিশুরা মায়ের সাথে বর্জ্যস্তূপে থাকার বিরূপ প্রতিক্রিয়া তিনি ভালভাবে উপলব্ধি করেন। শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যতের চিন্তায় কয়েকদফা গ্রুপ মিটিং করেন বর্জ্যজীবীদের সাথে। সিটি কর্পোরেশনের সহায়তায় বর্জ্যজীবীদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে সক্ষম হন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে গ্রামবাংলা স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষার্থীদের জন্মনিবন্ধনের পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদের সহযোগিতায় কম মূল্যে তাদের পরিবারের অন্য সদস্য যেমন বাবা, মা, ভাই, বোনদেরকে নিয়ে ৫৭৩ জনের জন্মনিবন্ধন তৈরি করে দেন। সেগুলো সংরক্ষণের জন্য নিজেদের ফান্ড থেকে লেমিনেটিং করে দিয়েছেন।
সাধারণত ‘বর্জ্যজীবী’ বা (ধিংঃব ঢ়রপশবৎ) হলো শহরের একটি অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা রাস্তা, ডাস্টবিন বা বর্জ্য ডাম্পসাইট থেকে বর্জ্য সংগ্রহ ও তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। ময়লাস্তূপে শিশুরা দীর্ঘক্ষণ খেলাধুলা করে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠে এসব শিশুরা। এদের মধ্যে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যাই বেশি। এছাড়াও প্রায়শই টাইফয়েড, জ্বর, অমাশয়, যক্ষা, চর্মরোগ, হেটাচাইটিস, দুর্ঘটনাজনিত ক্ষত বা অঙ্গহানী ইত্যাদি বিভিন্ন সংক্রামণ বা অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা, দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ ও শিশুদের ন্যূনতম শিক্ষার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত। সাধারণত শিশুদের জন্য সরকারি বা বেসরকারি স্কুলগুলো শুরু হয় সকালে। যে সময়ে সিটি কর্পোরেশনের আবর্জনার ট্রাকগুলো বর্জ্য ফেলতে থাকে। সেসময় শত শত শিশু-নারী-পুরুষের ট্রাক ও বুলডোজারের ঝুঁকি উপেক্ষা করে বর্জ্য সংগ্রহের ধুম পড়ে যায়। এই ব্যস্ত সময়ে শিশুদের স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ আর মায়েদের থাকে না। তাছাড়া ৩-৪ জন বাচ্চা নিয়ে কোন মালিকের অধীনে কাজও করার সুযোগ পায় না। আবার অনেক মা-বাবাও চায় তার সন্তান স্কুলে না যেয়ে বর্জ্য সংগ্রহে সাহায্য করবে।
গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির হিসেবে দেশে আনুমানিক নারী ও শিশুসহ ৪ লাখ লোক ‘বর্জ্যজীবী’ পেশার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তাদের জীবন ও জীবিকা টিকিয়ে রেখে চলেছে। ২০০৯ সালের পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী শুধু ঢাকা শহরেরই ১ লাখ ২০ হাজার দরিদ্র মানুষ ফেলে দেয়া বর্জ্যসামগ্রী পুনঃচক্রায়ন ও পুনঃব্যবহারের ব্যবসার সাথে জড়িত। তারা ঢাকা শহরের মোট বর্জ্যরে শতকরা ১৫ ভাগ পুনঃচক্রায়ন ও পুনঃব্যবহার করে থাকে যার মূল্য বছরে প্রায় ১ হাজার ৭১ কোটি টাকার মতো।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন