জুয়েল মাহমুদ : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সরকারি কলেজগুলোকে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়া শুরু হয়েছে। প্রথম দফায় গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে। কলেজগুলো হলো- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। এখন থেকে এসব কলেজে ভর্তি পরীক্ষা, পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হবে। এতদিন দেশের অন্যসব সরকারি-বেসরকারি কলেজের মতো এগুলোর ভর্তি পরীক্ষা ও শিক্ষা কার্যক্রম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো।
এদিকে ঢাকার ৭টি কলেজ ঢাবির অধিভুক্ত নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকে পক্ষে ও অনেকে বিপক্ষে মত দিচ্ছেন। তবে বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী। তবে কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা উল্লসিত। তারা সরকারের এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন।
রাজধানীর এই সাত কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাকি সরকারি কলেজগুলোও পর্যায়ক্রমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়া হবে বলে জানা গেছে। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলো সাতটি কলেজ। এসব কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বর্তমানে এক লাখ ৬৭ হাজার ২৩৬ জন শিক্ষার্থী এবং এক হাজার ১৪৯ জন শিক্ষক রয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হিসাবে ঢাকার সরকারি কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হলো। ধীরে ধীরে অন্যান্য জেলায়ও এধরনের উদ্যোগ নেয়া হবে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সকালে ভিসি দফতর সংলগ্ন লাউঞ্জে ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে সাতটি সরকারি কলেজের প্রিন্সিপালদের নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভিসি উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সরকারি কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি আরো বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ অনুযায়ী তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেব। এখন থেকে এই অধিভুক্ত কলেজগুলোর ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি প্রক্রিয়া, পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুযায়ী বিদ্যায়তনিক কার্যক্রমও পরিচালনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।” ভিসি এ বিষয়ে উপস্থিত অধ্যক্ষদের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন।
সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ, ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক মোয়াজ্জাম হোসেন মোল্লাহ, ইডেন মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল গায়ত্রী চ্যাটার্জি, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রিন্সিপাল শেখ আব্দুল কুদ্দুস, কবি নজরুল সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল (ভারপ্রাপ্ত) মুক্তি রাণী সাহা, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল (ভারপ্রাপ্ত) ড. দীপিকা দেওয়ান, মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজের প্রিন্সিপাল মো. ইমাম হোসেন এবং সরকারি তিতুমীর কলেজের প্রিন্সিপাল আবু হায়দার আহমেদ নাছের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মো. এনামউজ্জামান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. বাহালুল হক চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে দেশের সব ডিগ্রি কলেজ ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো। ১৯৯২ সালে সরকারি কলেজগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়।
২০১৪ সালের শেষদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ২৭৯টি সরকারি কলেজকে বিভাগীয় পর্যায়ের পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।
পরের বছর ৫ অগাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে এক বৈঠকে সরকারি কলেজকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আনার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। তবে বেসরকারি কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই থাকবে বলে সে সময় জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেশনজট কমাতে ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ ঘোষণা করে। কিন্তু এই ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রামের’ মাধ্যমে দ্রুত পরীক্ষা হলেও ঠিকমতো ক্লাস না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’সহ বিভিন্ন কারণে সরকারি কলেজগুলোকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়ার কাজের গতি কমে যায়। এর মধ্যে গত বছরের জুলাইয়ে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তাগিদ দেয়।
বর্তমানে দেশে স্নাতক পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দুই হাজারের বেশি কলেজে পড়ছেন। এগুলোতে মোট শিক্ষার্থী প্রায় ২১ লাখ। সরকারি প্রায় ২০০ ও বেসরকারি প্রায় ৫০০ কলেজে স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট যেখানে চরম পর্যায়ে, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা যেখানে নেই বললেই চলে, যেখানে শিক্ষার মান দিন দিন শিটনির্ভরে পরিণত হতে যাচ্ছে, যেখানে একজন শিক্ষার্থীর সেমিস্টার ফাইনালের অ্যাডমিট কার্ড উত্তোলন করতেই চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়, সেখানে নিত্যনতুন সান্ধ্যকালীন কোর্স, হোম ইকোনমিক্স কলেজ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কিছু ঢাকাস্থ নতুন কলেজকে ঢাবিতে অধিভুক্ত করা চরম হাস্যকর।
ওয়ালি খান রাজু নামে ঢাবি দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষাগত এবং পরিবেশগত মানোন্নয়নে নজর না দিয়ে ধীরে ধীরে সব ধরনের কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করলে বিশ্বের সেরা ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাতে থাকা দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়টিকেও আর সেই তালিকাতে খ্ুঁজে পাওয়া যাবে না।
সাখওয়াত আলামিন নামে ঢাবির এক সাবেক শিক্ষার্থী বলেন, ঢাবি শিক্ষার্থীদের মধ্যে “মর্যাদাহানির” আশঙ্কায় যারা গেল গেল রব তুলেছেন এটা আপনাদের জানার কিছুটা ঘাটতি। আপনার ভার্সিটির কোনো শিক্ষক গিয়ে ওইসব কলেজে পড়াবেনও না, ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা এসে আপনাদের ক্লাসরুম/হলের সিটও কেড়ে নেবে না। ঢাবি কেবল ওইসব কলেজের পরীক্ষা/ফলাফল/সিলেবাস তদারকি করবে মাত্র। আসমা আহমেদ সিমু বলেন, অধিভুক্ত করারই বা কি দরকার ছিল! যেখানে নিজেদের শিক্ষার মান এখনো প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে এই কলেজগুলোর শিক্ষার মান ঢাবি বাড়াবে কী করে? অধিভুক্ত হওয়া কলেজগুলোতে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। অধিভুক্তির খবর ছরিয়ে পড়লে সবাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সম্পা, আরেফিন, সুজন, লায়লা, সাহানা, নুপুর নামের শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা ভীষণ খুশি এখন থেকে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক কারিকুলামের সাথে পরিচিত হতে পারব এবং লেখাপড়ার মান বৃদ্ধি পাবে বলে তারা মনে করেন। তবে এই প্রক্রিয়া যাতে লেন্দি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য তারা অনুরোধ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাবি’র একজন অধ্যাপক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি করার কারণে প্রশাসনিক কার্যক্রম আরো ধীরগতিতে চলবে। সার্বিক ফলাফল বিশ্লেষণে পিছিয়ে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। বিশ্ব রেঙ্কিন এ আরো পিছিয়ে যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর অবস্থান। হয়তো ভবিষ্যতে বিশ্ব রেঙ্কিন এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ৩০০০-এর মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে আমার মনে হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন