শহীদুল্লাহ ফরায়জী : ২রা মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনে ঐতিহাসিক দিন। এ দিন জাতি তার কাক্সিক্ষত স্বপ্নের পতাকা সর্বপ্রথম উড়তে দেখেছে জমিনের উপরে। স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের নির্দেশে ১লা মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই সময় সিদ্ধান্ত হয় ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র-গণসমাবেশ অনুষ্ঠানের আর এই ছাত্র-গণসমাবেশে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নিউক্লিয়াস। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে স্বাধীনতা উন্মুখ বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে আ স ম আবদুর রব স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। এ সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন নূরে আলম সিদ্দিকী। পতাকা উত্তোলন করার সময় পাশেই ছিলেন শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখনসহ ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
সেদিন সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনি, হাসানুল হক ইনু স্বাধীনতার পতাকা তৈরির পরিকল্পনা করেন। বাংলাদেশের পতাকার পরিকল্পনা হয় ১৯৭০ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন ইকবাল হলের ১১৬ নং কক্ষে। বাংলাদেশের পতাকার পরিকল্পনার পর পরিকল্পনা মোতাবেক লাল সূর্যের বৃত্তের উপর পূর্ব বাংলার মানচিত্র আঁকেন শিব নারায়ণ দাস এবং কাপড় দিয়ে পতাকা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন কামরুল আলম খান খসরুসহ অন্যান্য ব্যক্তিত্বরা। বাংলাদেশ নির্মাণে বহু গোপন সশস্ত্র সংগঠনের কর্মকান্ড ছিলো কিন্তু কারো কোন পতাকার প্রস্তাবনা ছিল না।
১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতার সম্মুখে তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় অনিবার্য করে তোলেন। জাতীয় পতাকা হচ্ছে সার্বভৌমত্বের প্রতীক। ২রা মার্চ পতাকা উত্তোলন ছিলো কার্যত পাকিস্তান রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক মৃত্যু পরোয়ানা। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ পতাকা উত্তোলন করার সময় আ স ম আবদুর রব বলেছেন, ‘আজ থেকে এটাই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা’ যা লাখো জনতা করতালি দিয়ে গ্রহণ করে।
৩রা মার্চ ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। সেটা শাজাহান সিরাজ পাঠ করেন বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পল্টন ময়দানে। ইশতেহারে বলা হয় ৫৪ হাজার ৫শ’ ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশর জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ সংগীতটি গৃহীত হয়। পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার ও উত্তোলনের নির্দেশনা দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। ‘জয় বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় শ্লোগান হিসেবে নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ ২রা মার্চ যে পতাকা উত্তোলিত হলো তাকেই জাতীয় পতাকা হিসেবে ব্যবহার করার নির্দেশনা থাকে ইশতেহারে। এর পর থেকেই সারা দেশে এই পতাকা উত্তোলিত হতে থাকে। ২৩ মার্চ ঢাকার সর্বত্র এই পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৩ মার্চ ‘জয় বাংলা বাহিনী’ সামরিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে পতাকা উত্তোলন করে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ নেতাদের পক্ষে আ স ম আবদুর রব ধানমন্ডি ৩২-এ গিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে সেই পতাকা তুলে দেন; তখনই তিনি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে উড়িয়ে ও গাড়িতে লাগিয়ে দেন। পরবর্তীতে ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগরে প্রবাসী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে এই পতাকাই উত্তোলিত হয়েছিলো এবং গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়েছে। এই পতাকা দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে শহীদদের লাশ জড়িয়ে চিরকালের জন্য চিরদিনের মতো চিরনিদ্রায় শায়িত করা হতো। এই পতাকা দিয়ে ১৬ই ডিসেম্বর দেশবাসী বিজয় উৎসব পালন করে। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর তৎকালীন সরকার লাল বৃত্তের মাঝে বাংলাদেশের সোনালী রংগের মানচিত্র উঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তের সময় বঙ্গবন্ধু শিল্পী কামরুল হাসানের পরামর্শ নেন। এখন কামরুল হাসানকে পতাকার নকশাকারক বলা হচ্ছে- যা একেবারেই অযৌক্তিক ও অনৈতিক।
৫২-এর প্রেরণার পর ২রা মার্চ পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চ ইশতেহার পাঠ, ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সমগ্র জাতিকে সংগ্রামী ও বিপ্লবী আগুনে পুড়িয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পৌঁছে দেয়-জাতির মাঝে রাষ্ট্রের অনিবার্যতা স্পষ্ট হয়-জাতির অন্তরে বিপুল শক্তির জন্ম হয়।
আ স ম আবদুর রব একটি জাতি রাষ্ট্র বিনির্মাণের লক্ষ্যে মুক্তি পাগল মানুষের পক্ষে পতাকা উত্তোলন করেছেন ২রা মার্চ দিন-দুপুরে লক্ষ জনতার সামনে, যে ছবি দৃশ্যমান। অথচ এ স্বাধীনতার পতাক উত্তোলন নিয়ে সরকার বা কারো কারো নীরবতা লক্ষণীয়। নীরবতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর একটি উক্তি যথার্থ উত্তর হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর উক্তিটি হচ্ছে ‘পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে।
আমাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন মুক্তি সংগ্রামের মৌলিক স্বাক্ষর। সত্য কখনও পরিবর্তিত হয় না-সত্য কখনও মরে না। একদিন আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটবে-তখন সর্বত্র সোনা যাবে মুক্তি ও সত্যের বাণী।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পতাকা হচ্ছে একটি জাতি রাষ্ট্রের মুক্তি এবং সার্বভৌমত্বের প্রতীক। এই পতাকা অর্জনের জন্যেই যুগে যুগে আন্দোলন-সংগ্রাম, সশস্ত্র যুদ্ধ, আত্মদান সংঘটিত হয়েছে। পতাকা মুক্তি ও স্বাধীনতার সর্বোচ্চ অহংকার। আর ২রা মার্চ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন দিবস হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অহংকার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন