রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

জাতীয় পতাকা উত্তোলন দিবস

প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান
মার্চ আমাদের স্বাধীনতার মাস। এ মাসেই অকুতোভয় ছাত্র-জনতা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, নিপীড়ন আর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিশ্বের মানচিত্রে আমাদের জাতীয় পতাকাকে দাঁড় করাতে। ঐতিহাসিক পতাকা উত্তোলন দিবস ২ মার্চ। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এই পতাকা আমাদের স্বাধীনতার চেতনার প্রতীক। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, অন্যায়, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে তৎকালীন ডাকসু নেতাদের উদ্যোগে ২ মার্চ সাড়া দিয়েছিল আমজনতা। প্রকৃতপক্ষে সেদিনের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হয় এবং স্বাধীনতা অর্জনের পথে যাত্রা শুরু করে। পতাকা উত্তোলনই জানান দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের বিকল্প নেই।
এই পতাকা উত্তোলন আমাদের ভূখ- ছাড়িয়ে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে একটি শোষিত ও বঞ্চিত দেশের অধিকার এবং স্বাধিকার আদায়ের বিপ্লবের সূচনা বার্তা। দীর্ঘ ৯ মাসের বহু ত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ৯ মাস এই পতাকাই বিবেচিত হয় আমাদের জাতীয় পতাকা হিসেবে।
২ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ায় সকাল থেকেই দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ ঢাকার রাজপথে অবস্থান নেয়, ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জুলুম, নিগ্রহ, শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে তৎকালীন ডাকসু নেতাদের উদ্যোগের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ জড়ো হতে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। অকুতোভয় ছাত্রসমাজ ও জনতা পাকিস্তানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জানিয়ে দেয় বাঙালিরা মাথা নত করবে না।
এক টুকরো লাল-সবুজের মাঝেই বাংলাদেশের পরিচিতি। জাতিসংঘ সদর দফতর অথবা বিশ্বকাপ ক্রিকেট, অলিম্পিক কিংবা কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে লাল-সবুজ বাংলাদেশকেই ধারণ করে। বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত ওই পতাকা সর্বপ্রথম উত্তোলন করেছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতা আ স ম আব্দুর রব। তখন ছাত্র সমাবেশের নেতৃত্বে ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব প্রমুখ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম নিজ হাতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ২৩ মার্চ ১৯৭১ সালে ধানম-িতে তার নিজ বাসভবনে। এছাড়া একাত্তরের এই দিনেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক জনসভার ঘোষণাও দেয়া হয় এই দিনে।
লাল-সবুজ বাংলাদেশের প্রতীক। যে সবুজ ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের মাতৃভূমির পুরোটা জুড়েই। আর লাল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীকী রং। এই পতাকাই বিশ্বের দরবারে পরিচয় করায় লাল-সবুজে ঘেরা প্রিয় বাংলাদেশকে। লাল রঙের ভরাট বৃত্তটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনা স্বাধীনতার নতুন সূর্যের প্রতীক।
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল কলকাতাস্থ পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনের প্রধান এম হোসেন আলী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এটিই বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে বর্তমান মুজিব নগরের আম্রকাননে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সাথে সাথে সর্বপ্রথম জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে পতাকার মাঝের লাল বৃত্তের ভেতর হলুদ রঙের মানচিত্রটি বাদ দিয়ে লালবৃত্ত সংযোজন করা হয়, যা উদীয়মান সূর্যের প্রতীক ও স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারীদের রক্তের স্মৃতি বহন করে। মানচিত্রটি পতাকার উভয় পাশে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলার সমস্যার কারণে পতাকা থেকে মানচিত্রটি সরিয়ে ফেলা হয়। পতাকার মাপ, রং ও তার ব্যাখ্যাসম্বলিত একটি প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয় চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানকে। কামরুল হাসানের ডিজাইনে পরিমার্জিত রূপটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
তখন পতাকার আকার ও রং কী হবে, তা ছাত্রনেতাদের মতামতের ভিত্তিতেই করা হয়। শাজাহান সিরাজের প্রস্তাবে পতাকার মধ্যে লাল রং, আ স ম আবদুর রবের মতামতে জমিন সবুজ, মার্শাল মণির মতে গাঢ় সবুজ রং ও কাজী আরেফ আহমেদের প্রস্তাবে বাংলাদেশের মানচিত্র বসানো হয়। শিবনারায়ণ দাস পতাকার ডিজাইন তৈরি করেন। ছাত্রনেতা খসরু নিউমার্কেট থেকে কালি, তুলি ও কাপড় কিনে আনেন। পতাকাটি সেদিন পেঁচিয়ে রেখে দেয়া হয় নিরাপত্তাজনিত কারণে। এই পতাকাটিই ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওড়ানো হয়েছিল।
বাংলাদেশের পতাকা সকল দিবসে সাধারণ মানুষের উত্তোলন করা আইনত অপরাধ। তবে জাতীয় পতাকা যে সকল দিবসে উত্তোলন করা যাবে তা হলো স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, বিজয় দিবসসহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত অন্য যে কোনো দিবসে। এছাড়া যে কোনো দিবসে এই প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা যে ১৫টি বাসভবনে উত্তোলন করা যাবে তা হলো Ñ প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা, মন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, বিদেশে বাংলাদেশের কূটনীতিক এবং তিন পার্বত্য জেলাপরিষদ চেয়ারম্যান।
ব্যক্তিগত গাড়ি, জলোযান ও বিমানে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে পারবেন যারা তারা হলেনÑ প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা, মন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি ও বিদেশে নিযুক্ত কূটনীতিকরা।
জাতীয় পতাকা যে সকল দিবসে অর্ধনমিত থাকে তা হলোÑ ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস অথবা সরকার কর্তৃক অন্য যে কোনো দিবসে।
আমাদের মনে রাখা আবশ্যক, জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও সরকারি বিধিমালা অনুসারে জাতীয় পতাকা উত্তোলন আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব।
abunoman72@ymail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Pulak mitra ১১ ডিসেম্বর, ২০১৭, ৬:২৮ পিএম says : 0
রাজবাড়ী জেলায় প্রথম পতাকা উত্তলন করা হয় কবে?
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন