জুয়েল মাহমুদ : আনন্দ-উচ্ছ্বাসে রঙিন একটি দিন কাটল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের। প্রিয় ক্যাম্পাসে স্মৃতির রোমন্থনে পুরো একটি দিন আনন্দের ভেলায় ভাসলেন দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক-সহপাঠী ও দেশ বরেণ্যদের সঙ্গে মাতলেন ক্ষাণিকটা সময়। প্রাণের বন্ধনে একে অন্যের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে প্রত্যেকেই যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য ফিরে গিয়েছিলেন সেই সব হারানো দিনে। হাতড়ে ফিরেছেন ক্যাম্পাস জীবনের বিগত বছরগুলোর সেই উচ্ছল, বাধাহীন, তারুণ্য ও যৌবনের ছোট গল্পগুলোকে। বর্ণাঢ্য ও আনন্দ-উচ্ছ্বাসেমুখর পরিবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হলো। শনিবার সকাল থেকে সমাবর্তন ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবন থেকে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ছিল বর্ণাঢ্য আয়োজন।
এবারের সমাবর্তনে প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ করেছিল। শনিবার (৪ মার্চ) বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল প্রাঙ্গণ থেকে সমাবর্তনের শোভাযাত্রা শুরু হয়। এরপর সকাল সাড়ে ১১টায় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে শুরু হয় সমাবর্তনের মূল আনুষ্ঠানিকতা। সমাবর্তন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সমাবর্তন বক্তা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট এবং ভিসি অধ্যাপক অমিত চাকমা। সমাবর্তন বক্তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরিন আহমদ, প্রো-ভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এনামউজ্জামান, বিভিন্ন অনুষদের ডিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত রয়েছেন। ৫০ তম সমাবর্তনে ৯৪টি স্বর্ণপদকের জন্য ৮০ জন, পিএইচডি ডিগ্রির জন্য ৬১ জন, এমফিল ৪৩ জন ও ১৭ হাজার ৮৭৫ জন গ্র্যাজুয়েট অংশগ্রহণ করেছেন।
এবার ৫০তম সমাবর্তনে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি পেতে যাচ্ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত বিশিষ্ট রাসায়নিক প্রকৌশলী অধ্যাপক অমিত চাকমা। তার জন্ম ১৯৫৯ সালে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা পরিবারে। তিনি কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও-এর ১০ম প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি আলজেরীয় সরকারের বৃত্তি নিয়ে আলজেরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ইনস্টিটিউট আলজেরিয়ান ডু পেট্রোল এ পড়তে যান। এরপর কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে রাসায়নিক প্রকৌশল বিষয়ে এমএএসসি এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালগারির রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগে অধ্যাপক, ১৯৯৬ সালে ইউনিভার্সিটি অফ রেজিনা-এ রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অমিত চাকমা বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন প্রাকৃতিক গ্যাস প্রকৌশল এবং পেট্রোলিয়াম বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক গবেষণার জন্য।
এদিকে সমাবর্তন উপলক্ষে শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় অনুষ্ঠানস্থলে আসেন। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া কালো গাউন আর সমাবর্তন ক্যাপ পরে এসেছেন। জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দি করছেন তারা। ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী জাহান আরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন দিন। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাওয়ার বেদনার পাশাপাশি গ্র্যাজুয়েট স্বীকৃতির আনন্দ রয়েছে এতে।
সমাবর্তন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনে আলোক সজ্জায় সজ্জিত করা হয়। সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের গ্র্যাজুয়েট শাহিনুর রহমান বলেন, ‘গাউন পড়ে ক্যাম্পাসে ঘুড়তে ভালো লাগছিল। কিন্তু যখন মনে হচ্ছে আজ থেকে প্রাক্তন হয়ে গেলাম তখন মনটা একটু খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পাসের সেই দিনগুলোর কথা আজ খুব মনে পড়ছে’।
শিক্ষাজীবনের বহু কাক্সিক্ষত এই মাহেন্দ্রক্ষণে আনন্দ ভাগাভাগি করতে নতুন-পুরনো শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়েছিলেন দলবেঁধে। অনেকেই ক্যাম্পাস জীবনের ফেলে আসা সেই সোনাঝরা দিনগুলোতে ফিরে যান। শিক্ষক-সহপাঠী ও দেশ বরেণ্য ব্যক্তিদের সংমিশ্রণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি স্থান মহোৎসবে পরিণত হয়। সমাবর্তনে অংশ নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য গ্র্যাজুয়েটদের চোখেমুখে উচ্ছ্বাসে ছাপিয়ে উঠে। অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাস্বর্য, টিএসসি, শহীদ মিনার, মল চত্বর, কার্জন হল, কলা ভবনসহ ক্যাম্পাসের প্রায় প্রতিটি জায়গায় দেখা যায় আড্ডা। ক্যাম্পাস জীবনের প্রাণের সতীর্থদের স্মৃতি ধরে রাখতে ছবি তোলার মহড়া চলে; ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে থেকে ভেসে আসে ক্যামেরার ‘ক্লিক ক্লিক’ শব্দ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সময়ে সমাবর্তনে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বের নামিদামি মানুষরা। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জী, ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি অরগানাইজেশনের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. ফ্রান্সিস গ্যারি, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, ড. মাহাথির মোহাম্মদ, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অধ্যাপক ইউয়ান টি লি, বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক আবুল হুসসাম ও প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ অধ্যাপক রণজিত গুহ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মহাসচিব প্যাসকেল ল্যামি ও ইউনেসকোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকাভো। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ব্রিটিশ আমলে তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রæয়ারি। তখন বাংলার তৎকালীন গভর্নর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড লিটন (রোনাল্ডশে সিআইই) সমাবর্তন ভাষণ দেন। এরপর ১৯২৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই (সর্বমোট ২৪ বার) সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ আমলে শেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালের ২১ নভেম্বর। পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ। ২৪ মার্চের সেই সমাবর্তনে কার্জন হলে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিকে নাকচ করে দিয়ে জঘন্যতম ভাষণ দিয়েছিলেন তার প্রতিবাদে সমাবর্তন স্থলেই তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং ছাত্ররা দাঁড়িয়ে নো নো বলে তীব্র প্রতিবাদ করেন, তারই ধারাবাহিকতায় পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত মোট ১৫ বার সমাবর্তন হয়।
স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো (৪০তম) সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সমাবর্তন উদ্বোধন করার কথা ছিল; কিন্তু তার আগেই ভোররাতে ঘটে যায় সেই নৃশংসতম হত্যাকান্ড, ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডি ফলে তখন সমাবর্তন স্থগিত করা হয়।
এরপর স্বাধীন বংলাদেশে প্রথম সমাবর্তন (৪০তম) অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর যা ছিল দীর্ঘ ২৯ বছর বিরতির পর। এরপর সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ২০০১, ২০০৪, ২০০৭, ২০০৮, ২০০৯ ও ২০১২ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সব থেকে বৃহত্তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ২০১২ সালের মার্চ মাসে (৪৭তম), প্রধান বক্তা ছিলেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন-এর মহাসচিব প্যাসকেল ল্যামি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন