১। মোহাম্মদ ফাহমিদুল বারী রাইয়্যান, রাজামেহার, কুমিল্লা।
জিজ্ঞাসা : আদর্শ জাতি গঠনে আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতখানি?
জবাব : বিশ্ব মানবতার কল্যাণের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মহাগ্রন্থ আল কুরআনকে জীবন বিধানরূপে পাঠিয়েছেন। এই কুরআন পুরো মানবজাতির সমাজ সভ্যতা ও আত্মিক পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধির জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। তাই এই মহাগ্রন্থের প্রতিটি পাতায় ছড়িয়ে আছে ব্যক্তি ও সমাজ সংস্কার-সংশোধনের পন্থা ও পদ্ধতি এবং পবিত্র ও পরিশুদ্ধ জীবনের বাস্তব রূপরেখা। পরিশুদ্ধ ও পবিত্র সভ্যতার অপরিহার্য দাবি হচ্ছে পরিশুদ্ধ ও সৎ খোদাভীরু মানুষ। কেননা আত্মার পরিশুদ্ধি ছাড়া কোনো মানুষ প্রকৃত কল্যাণ বা সফলতা অর্জন করতে পারে না। তাই পবিত্র কুরআনে ব্যক্তির পবিত্রতা ও আত্মার পরিশুদ্ধির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছেÑ ‘যে নিজেকে শুদ্ধ করে সে সফলকাম এবং যে নিজেকে কলুষিত করে সে ব্যর্থ ও মনোরথ হয়। (সূরা : আশ শামস-৯)
উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তায়ালা আত্মশুদ্ধিকে মানবজীবনের সফলতা ও ব্যর্থতার কারণ সাব্যস্ত করেছেন। যার আত্মার পরিশুদ্ধতা আছে সে সফল। আর যার আত্মার পরিশুদ্ধতা নেই সে ব্যর্থ। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা অর্জন করে সে সফলকাম। আর সে ব্যক্তি ব্যর্থ যে নিজের নফসকে পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত করে দেয়। মোটকথা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতার চাবিকাঠি হলো আত্মার পরিশুদ্ধতা ও পবিত্রতা। তাই আল্লাহ তায়ালা রাসূলে কারীম (সা.)কে এই মিশন নিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। রাসূল (সা.) পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মানুষকে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করা। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন : ‘তিনিই নিরক্ষদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন যিনি তাদের কাছে পাঠ করবে তাঁর আয়াতসমূহ। তাদের পবিত্র করবেন এবং শিক্ষা দিবেন কিতাব এবং হিকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত। (সূরা : জুমআ-২) এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসূলে কারীম (সা.)-এর পৃথিবীতে আগমনের চারটি উদ্দেশ্য ও মিশনের কথা উল্লেখ করেন। যার দ্বিতীয়টি হলো যে, তিনি মানুষদের পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করবেন।
মানুষকে আল্লাহ তায়ালা দুটা জিনিস দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আত্মা এবং দেহ। এই দুটি জিনিসের সমন্বয়ে যেহেতু প্রতিটি মানুষের সৃষ্টি। তাই এই দুটি জিনিস তথা দেহ এবং আত্মা উভয়টা সুস্থ থাকলেই একজন মানুষকে পরিপূর্ণ সুস্থ বলা হবে। দেহ সুস্থ থাকে দেহের খোরাকের মাধ্যমে আর আত্মা সুস্থ থাকে তার খোরাকের মাধ্যমে। দেহের সৃষ্টি উপাদান থেকে তাই তার খাদ্যও ব্যবস্থা করেছেন উপাদান থেকে যাতে মানব দেহ ঠিক থাকে। আত্মা যেহেতু অবিনশ্বর তার কোনো মৃত্যু নেই। এজন্য আত্মার খোরাকও সেই ধ্বংসহীন বস্তু। তা হলো নেক আমল। উৎপাদনমূলক খাবারের মাধ্যমে যেমন মানব দেহ ঠিক থাকে, সতেজ থাকে। তেমনি আত্মা সতেজ হয় নেক আমলের মাধ্যমে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো আজ আমরা দেহের সুস্থতা নিয়ে বেশ সচেতন। দেহের সুস্থতার জন্য আমরা সর্বদা সচেষ্ট থাকি, চেষ্টা অব্যাহত রাখি। সামান্য কিছু হলে চিকিৎসার জন্য দেশ-বিদেশের ডাক্তারের কাছে ছুটে যাই। কিন্তু আত্মার সুস্থতার জন্য কোনো আধ্যাত্মিক ডাক্তারের কাছে ছুটে যাই না। অথচ দেহের চেয়ে আত্মার গুরুত্ব বেশি। কেননা এই দেহের মূল্যায়ন তো আত্মাকে দিয়েই। আত্মা আছে বলেইে তো আমাকে আপনাকে মানুষ বলে বা কোনো নাম ধরে সম্বোধন করা হয়। পক্ষান্তরে আত্মা যখন দেহের সঙ্গ ত্যাগ করে তখন আর নাম ধরে সম্বোধন করা হয় না। সেটাকে লাশ বলা হয়। অতএব এর গুরুত্ব দেয়া এবং এটাকে সুস্থ রাখা বেশি প্রয়োজন। আত্মা সুস্থ থাকবে গুনাহমুক্ত থাকার মাধ্যমে। আর যার আত্মা শুদ্ধ থাকে তার সবকিছু ভালো হয়, আর যার আত্মা পরিশুদ্ধ না হয় তার সবকিছু খারাপ হয়ে যায়। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন : ‘জেনে রাখো মানবদেহে এমন একটি গোস্তের টুকরা রয়েছে যা ঠিক হলে পুরো দেহ ঠিক হয়ে যায় এবং তা খারাপ হলে সারা দেহ খারাপ হয়ে যায়। শুনো! তা হচ্ছে ‘কলব’ বা আত্মা’ (বুখারী ৫২, মুসলিম-৩৯৭৩)
এই হাদিসে রাসূলে কারীম (সা.) পুরো দেহের আমলের ইসলাহ ও সংশোধনকে আত্মার সংশোধনের উপর নির্ভরশীল বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যাকে ইসলামের পরিভাষায় ‘তাযকিয়ায়ে নফস’ বা আত্মশুদ্ধি বলা হয়। যার আত্মা পরিশুদ্ধ থাকবে তার দ্বারা কখনো খারাপ ও অন্যায়মূলক কোনো কাজ সংঘটিত হবে না। আর এই আত্মা শুদ্ধ হয় কিছু গুণাবলী অর্জন এবং কিছু বিষয় বর্জন করার মাধ্যমে। আর তা হলো, প্রথমত শিরক ও কুফুরী থেকে বেঁচে থেকে ঈমান ও তাওহীদের নেয়ামত লাভ করা এবং আত্মিক রোগ ব্যাধি থেকে অন্তরকে পবিত্র রাখা। আত্মিক রোগ-ব্যাধি হলো রিয়া, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, অবৈধ যৌনাচার, কুপ্রবৃত্তি, ধন-সম্পদ ও সম্মানের মোহ, লোভ-লালসা ইত্যাদি। পক্ষান্তরে আত্মার গুণাবলী হলো, ইখলাস, খোদাভীতি, তাওয়াক্কুল, সবর, শোকর, আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্টি, আল্লাহর প্রেম, বদান্যতা, ন¤্রতা, ভদ্রতা, সততা ইত্যাদি।
একটি সৎ ও কল্যাণমূলক সমাজ বা রাষ্ট্র গড়ে তোলা কখনই সম্ভব না যদি ঐ সমাজের মানুষগুলো সৎ ও খোদাভীরু না হয় এবং উক্ত গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে তাদের আত্মা পরিশুদ্ধ না থাকে। তাই একটি আদর্শ সমাজ গড়ার জন্য আদর্শ মানুষ তৈরি করা প্রয়োজন। আর আদর্শ মানুষ তৈরি হয় আত্মার সংশোধনের মাধ্যমে। যে সমাজের প্রতিটি জনগণ পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী হবে সে সমাজে কখনো রাষ্ট্রদ্রোহী বা খোদাদ্রোহী কোনো কাজ সংঘটিত হবে না। কারো অধিকার খর্ব হবে না। কোনো অন্যায়, জুলুম-নির্যাতন হবে না। যার স্পষ্ট প্রমাণ রাসূলে কারীম (সা.)-এর যুগ। যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ যুগ। অথচ রাসূলের আগমনের পূর্বে এই যুগটিই ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর ও অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগকে রাসূলে কারীম (সা.) সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ সোনালী ও আদর্শরূপে গঠন করেছেন একমাত্র ব্যক্তির আত্মার সংশোধনের মাধ্যমে। এটিই হচ্ছে কুরআন প্রদর্শিত পথ ও পন্থা। তাই আজকেও নব্য জাহেলিয়তমুক্ত পরিশুদ্ধ ও পবিত্র সমাজ রচনা করতে হলে আমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে পবিত্র কুরআনের নির্দেশিত পথেই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে নিজেদের আত্মা পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে একটি আদর্শ জাতি ও সমাজ গঠন করার তাওফীক দিন। আমীন!!
উত্তর দিচ্ছেন : ইমামুদ্দীন সুলতান
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন