কথা ছিল আমি যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার থেকে উঠব, ওরা গাড়ি ছাড়বে সাড়ে ছয়টায়। কথামত নিজেকে প্রস্তত করে চৌরাস্তা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠি, ফোন দেই, আপডেট জানতে থাকি। মিনিট দশেকের ব্যবধানে আমার সাথে যোগ দেয় রাফি আর তৌহিদ। আগে শনিরআখড়া থেকে উঠবে বলে জানিয়েছিল, কে জানে কেন চৌরাস্তায় যোগ দিল পাঁচ-পাঁচ দশ টাকা খরচ করে?
ডিউ টাইমে ক্যাম্পাস ছাড়ার সৌভাগ্য ওদের হয়নি যদিও এ ব্যাপারে বন্ধুরা বড় গলায় দৃঢ় ছিল, আমিও কম করে হলেও আধাঘণ্টা যাবৎ বিভিন্ন গাড়ির নাম মুখস্থ করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে ছিলাম। পরিকল্পনা ছিল অনেক দিনের। একবার মোহসিনা ম্যাম পরিকল্পনা করে কেনই যেন আমাদের নিয়ে পেরে উঠতে পারেননি তবে এবার বাস্তব রূপখানা দিয়েই ফেলেন মুমু ম্যাম। কখন, কিভাবে, কোথায়, কী কী করতে হবে সবই আমাদের এই প্রিয় ম্যামের পরিকল্পনা মত হয়েছে। কিছুটা দূর থেকেই খেয়াল করলাম ক্যাম্পাসের একটি গাড়ি, তাৎক্ষণিকভাবে একটু কৌত‚হলী হয়ে যাই।
থার্ড রো’র ফার্স্ট সিটটিতে বসি আমি, পাশের সিট দুটোর নিয়মিত দখলদার নেই। বসার পরে খেয়াল করলাম আমার ঠিক সামনের দুপাশে বসা আমার প্রিয়শিক্ষকরা। তারা তিন জন- রঞ্জিত স্যার, রিয়াদ স্যার আর আমার নেমসেক মিজান স্যার। আমাদের সকলের সাথেই রয়েছে তাঁদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যদিও বয়সের পাল্লায় তাদেরটা আমাদের থেকে তিনগুণ। সামনে ফ্লাইওভারের টোল বক্স কিন্তু টোল আমরা দেব না। সিগন্যাল পড়ল, বাস দাঁড়াল, কয়েকজন নেমে পড়ল একটা কাগজ নিয়ে, যে কাগজ আমাদের ভ্রমণের অফিসিয়াল দলিল। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর একটি লিখিত দেয়ার বিপরীতে আমাদের ছেড়ে দেয়া হয়। ধন্যবাদ দিলাম দায়িত্বরত টোল আদায়কারীকে, তিনিও হাত নেড়ে জবাব দিলেন। মেঘনা ব্রিজেও ঠিক আগের ঘটনাটিরই নকল।
শনিরআখড়া পেছনে ফেলতেই মিজান স্যার মাইক্রোফোনটি নিয়ে নির্দেশনা বা যেখানে যাচ্ছি সেখানটার কিছু বর্ণনা দিলেন যদিও এসবের প্রায় তথ্যেই সকলে অবগত, তবে ফরমালিটি বলে কথা। শেষে জানালেন, তার বাড়ি কুমিল্লাতেই। এটা শুনতে না শুনতেই পুরো বাস উল্লাশে ফাটে।
কাঁচপুর পেরুলেই কয়েকজন বাদে বাকিরা ড্যান্সে পাগলু হয়, গোমতী ব্রিজ পার হওয়ার কয়েক মিনিট আগে হঠাৎ গাড়িটিকে রাস্তার পাশে রাখেন, অবাক চোখে এপাশ ওপাশ তাকালাম, মুশকিলটা কী? দেখছি রঞ্জিত স্যার হাতে মাইক্রোফোন তুলে নিলেন। একজন বলল- সবাই থাম, স্যার কিছু বলবেন। স্যার শান্ত গলায় বললেন, আনন্দ কর কিন্তু সিট ছেড়ে লাফালাফি করনা, গাড়িটা খুবই হালকা, সারা গায়ে শুধু প্লাস্টিক, ড্রাইভারের সমস্যা হচ্ছে। সবাই তাঁর কথাকে সম্মান জানালাম।
শুরু হতেই সবথেকে ইনোসেন্ট ও ফ্রেশ লুকের অধিকারী বাবন একেক সময় একেক কৌতুক নিয়ে সবাইকে একটু বিনোদিত করার চেষ্টা করল। বেলুন ফাটিয়ে নিয়ে, বোতল নিয়ে, চকলেট নিয়ে আবার কখনও ব্যবহৃত মোবাইল স্ক্রাচ কার্ড নিয়ে। দেখতে দেখতে মেঘনা ব্রিজও পার হয়ে এলাম, কথায় আছেনা, চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। ওদের কাছে এটা মজা, মাস্তি আর আমাদের কাছে বিপদের কারণ। অবশ্য বিজয়টা ওদেরই হয়েছে আর আমরা বলি- সাবধানের মার নেই।
আনুমানিক ৩ ঘণ্টা পর ময়নামতি (কমনওয়েলথ) ওয়ার সিমেট্রিতে পা রাখলাম, গুরুরা বললেন- কোন রকম হৈ হুল্লোড় এখানে করা যাবেনা। মিজান স্যার ছোট একটা কাজ দিলেন, খুঁজে বের করতে হবে এখানে সমাধিস্থ সবচে কম বয়সী যোদ্ধার নাম, ঠিকানা এবং সমাধিটি। ব্যর্থ হলাম, অন্য কেউ পেরেছে কিনা বা চেষ্টা করেছে কিনা জানিনা। সবাই যে যার মত পোজ দিয়ে ছবি ওঠাতে ব্যস্ত, আমি বললাম- “এই, তোমরা এসেছ সমাধিস্থলে, মনে থাকবে শ্রদ্ধা, সমবেদনা, একটু ভয়। আর সবাই খিটখিট করছো?” মাসুদ, নজরুল আর আমি সেমট্রি স্থলটির চ‚ড়ায় উঠে কয়েকটা সেলফি নেই। গাছগাছালির অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য ঘিরে রেখেছে এটি।
ষ মু. মিজানুর রহমান মিজান
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন