আফতাব চৌধুরী : এক সময় আরব দেশে লণ্ঠন, নরহত্যা, ব্যভিচার, জুয়াখেলা, শরাবপান ইত্যাদি নৈতিকতা বিবর্জিত কার্যকলাপ আরববাসীদের জীবন-যাপনকে করেছিল বিপর্যস্ত। শুধু আরব মুলুকেই নয় সমগ্র বিশ্বের মানব সমাজে বিরাজ করছিল এক চরম নৈরাজ্য। নারী নির্যাতন ছাড়িয়ে গিয়েছিল সকল বর্বরতা ও নৃশংসতাকে। সমাজে নারীরা ছিল অপাংক্তেয়। তারা মানুষরূপেই বিবেচিত হতো না। নারী ছিল পুরুষের লালসার শিকার, ভোগের সামগ্রী। ভোগ্য পণ্য হিসাবেই তাদেরকে ক্রয়-বিক্রয় করা হতো। কন্যা-সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে তাকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। ঘোড়ার লেজের অগ্রভাগে নারীর চুল বেঁধে তাকে টেনে-হিঁচড়ে ঘোড়া দৌড়ের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হতো।
মানবজাতির এ ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয়ের যুগে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুক্তির দিশারী ও শান্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সা.) মুস্তফাকে। সকল মানবিক গুণাবলীর নিপুণ উৎকর্ষতায় বিভ‚ষিত সর্বকালের সর্বযুগের এ আদর্শ মহামানবকে ওহীর মাধ্যমে মহান আল্লাহতায়ালা নাযিল করেছিলেন সমগ্র মানবজাতির জন্য এক অমূল্য সম্পদ আর পরিপূর্ণ জীবনবিধান মহাগ্রন্থ আল কোরআন। এ পবিত্র আল কোরআনের বাণীই ইসলামের বাণী। এ পবিত্র আল কোরআন সকল পারিবারিক সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান যেমন দিয়েছে তেমনি নিষ্পেষিত নারী জাতিকে অন্ধকারের অতল গহŸর থেকে তুলে এনে বিশেষ মর্যাদায় আসীন করেছে। নারী জাতিকে শোচনীয় ও অমর্যাদাকর অবস্থান থেকে পরিত্রাণ দানের উদ্দেশ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমাজে নারী জাতির অবস্থান নিরূপনের জন্য পবিত্র কোরআন নাযিল করেছেন। একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা-সূরা আননিজ যে সরার ১নং আয়াতে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন- হে মানবগণ! তোমরা তোমাদের প্রভুকে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার সঙ্গিনীকে এবং এ দুই থেকে বিস্তৃত করেছেন বহু নর নারীকে। এভাবে জন্মগতভাবেই ইসলামে নারী এবং পরলোকেও তাদের মর্যাদা অভিন্ন সৎকাজের প্রতিদান নারী পুরুষের জন্য সমান। পবিত্র ক্বোরআনের সুরা আল ইমরানের ২৮৫ নং আয়াতে আল্লাহপাক এরশাদ করেছেন “যে ব্যক্তি নেক আমল করবে, সে পুরুষ হোক কিংবা নারী- হোক তার কোন কাজ বিনষ্ট হতে দিই না” অর্থাৎ নেক ব্যক্তি সে পুরুষ হোক বা নারী হোক অবশ্যই পরকালে আল্লাহর নিকট থেকে সে পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। ইসলাম এমন একটি জীবন ব্যবস্থা যেখানে নারীকে সমাজের অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে, স্ত্রী, কন্যা, মাতা ও ভগ্নী হিসাবে তার ব্যক্তিগত মর্যাদা অধিকার ও স^াধীনতার সাথে সামগ্রিক বিষয়াবলীতে তাকে তার মতামত প্রকাশের অধিকার দেয়া হয়েছে। শিক্ষা গ্রহণ ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় ইসলাম পুুরুষের পাশাপাশি নারীকেও উৎসাহিত করেছে। মহানবী (সা.) দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন-“জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য ফরজ। মা, হিসেবে ইসলাম নারীকে যে মহান মর্যাদায় আসীন করেছে, তার নজীর নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন-“আল জান্নাতা তাহতা আকদামিল উম্মাহাত”- মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত। তিনি আরও বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই উত্তম, যিনি তাঁর স্ত্রীর নিকট উত্তম।” ঐতিহাসিক বিদায় হজ্বের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “ভ্রাতৃগণ শ্রবণ কর ইসলামে নারী-পুরুষে কোন ভেদাভেদ নেই। নারীদের প্রতি তোমরা সদ্ব্যবহার করবে। তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি তোমরা অন্যায় আচরণ করবে না। মনে রাখবে- তাদের ওপর তোমাদের যে অধিকার রয়েছে, তোমাদের ওপরও তাদের সেরূপ অধিকার রয়েছে। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাদেরকে কলুষিত করবে না, মিথ্যা অপবাদ দেয়ার শাস্তি অবশ্যই আল্লাহতায়ালা নির্ধারিত করে রেখেছেন। আল্লাহপাক সূরা আন নিজায় এরশাদ করেছেন-“আর স্ত্রীগণ তোমাদের ভ‚ষণ আর তোমরা তাদের ভ‚ষণ।” ইসলামই প্রথম নারীর স^াধীন অর্থনৈতিক সত্তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সম্পত্তির মালিকানা এবং ভোগ দখলের অখÐ অধিকার দিয়েছে নারীকে, নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক অধিকার জীবনের জন্যে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে ইসলামের অবদান সত্যিই বিস্ময়কর। কন্যা, স্ত্রী, বোন ও মাতা হিসাবে মুসলিম নারীর মীরাস বা উত্তরাধিকার প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিক পিতা ও স^ামী উভয়দিক থেকে উত্তরাধিকার লাভ করে তারা পেয়েছে মালিকানা স্বত্ব এবং তা স^াধীনভাবে ব্যয় করার পূর্ণ অধিকার। সূরা আন নিজার ৭নং আয়াতে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন-“পিতামাতা এবং আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের যেমন অংশ রয়েছে তেমনি নারীরও অংশ রয়েছে তা অল্পই হোক আর বেশি হোক এক নির্ধারিত অংশ আর এ নির্ধারিত অংশও পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসলামের বণ্টন ব্যবস্থায় রয়েছে স্ত্রীর জন্য মোহরানার ব্যবস্থা। এ মোহরানা বিবাহকালীন সময়ে স্ত্রী তার স্বামীর নিকট থেকে পেয়ে থাকেন। মোহরানা আদায় করা স^ামীর জন্য ফরজ। মোহরানা অর্থে স্বামীর হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার নেই। নিঃসন্দেহে নারীজাতির জন্য এটি একটি অর্থনৈতিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। ইসলাম আরও বলেছে নারীর ব্যক্তিগত সম্পদ অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োগকৃত সম্পদ এবং লাভ একমাত্র তারই আওতাধীন, স^ামী কিংবা অভিভাবকদের এক্ষেত্রে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ চলবে না, যদি না সে^চ্ছায় তা দান করে। সূরা আন নিজার ৩২নং আয়াতে এ সম্পর্কে পরিষ্কার বর্ণিত হয়েছে-“পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ আর নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন