শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

আল কোরআনে উল্লেখিত বিভিন্ন লোকের দু’আ

দিক দর্শন

| প্রকাশের সময় : ১৬ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
রানী বিলকীসের দুআ : হযরত সুলাইমান (আ.)-এর সাবা বংশীয় রানী বিলকীস বিনতে শারাহীল ইয়ামানের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি প্রভূত বিত্তবৈভবের মালিক ছিলেন। রানীর একটি বিশাল সিংহাসন ছিল, যা স্বর্ণ, রৌপ্য ও বিভিন্ন প্রকার মূল্যবান পাথর দ্বারা সুসজ্জিত ছিল। রানী ও তার সম্প্রদায় ছিল সূর্যপূজারী। হযরত সুলাইমান (আ.) রানীর নিকট এই মর্মে পত্র প্রেরণ করেছিলেন যে, সে যেন কুফর ও শিরক বর্জন করে ‘আল্লাহ এক’ বলে বিশ্বাস করে এবং ক্ষমতার অহমিকা পরিত্যাগ করে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে তার নিকট উপস্থিত হয়। এদিকে হযরত সুলাইমান (আ.) দরবারের লোকদেরকে বলেন, হে পরিষদ বর্গ, ইয়ামানের রানী আত্মসমর্পণ করে আমার নিকট আসার পূর্বে তোমাদের মধ্যে কে তার সিংহাসন আমার নিকট নিয়ে আসতে পারবে? এক শক্তিশালী জ্বীন বলল, আপনার মজলিস শেষ হওয়ার পূর্বেই আমি তা আপনার নিকট এনে দিতে পারব। হযরত সুলাইমান (আ.)-এর একজন নিকটতম সাহাবী ও লেখক বললেন, আপনার চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা আপনার নিকট নিয়ে আসতে পারব। ইনি আসমানী কিতাবের জ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন এবং তাঁর ইসমে আযমও জানা ছিল। মুহূর্তের মধ্যে সে সিংহাসন নিয়ে আসল। রানী বিলকীস হযরত সুলাইমান (আ.)-এর দরবারে উপস্থিত হলেন। তিনি এখানে তার নিজ সিংহাসন দেখে বিস্মিত হলেন এবং এক আল্লাহর প্রতি নিজের ঈমান প্রকাশ করলেন। রানী হযরত সুলাইমানের আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ঐশ্বর্য ও অভূতপূর্ব ক্ষমতার প্রতাপ লক্ষ করে পাঠ করেছিলেন-“হে আমার প্রতিপালক, আমি তো নিজের প্রতি জুলুম করেছিলাম। আমি সুলাইমানের সঙ্গে জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করছি।”-সূরা নামল : ৪৪
হযরত ঈসা (আ.)-এর হাওয়ারীদের দুআ : হযরত ঈসা (আ.) বনী ইসরাঈলের নিকট নবী হিসেবে আগমন করেন। তাদের অধিকাংশ তাঁর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে। উপরন্তু তারা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল। তিনি তা উপলব্ধি করতে পেরে বললেন, আল্লাহর দিকে গমনে কে আমার সাহায্যকারী হবে? হযতর ঈসা (আ.)-এর একান্ত অনুগত হাওয়ারীগণ বললেন, আমরাই আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি। আমরা আত্মসমর্পণকারী, আপনি এর স্বাক্ষী থাকুন। অতঃপর তারা কথাটিকে আরও সুদৃঢ় করার জন্য আল্লাহপাকের নিকট প্রার্থনা করে বললেন, হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি যা অবতীর্ণ করেছেন তাতে আমরা ঈমান এনেছি এবং আমরা এই রাসূলের অনুসরণ করেছি। সুতরাং আপনি আমাদেরকে সাক্ষ্য প্রদানকারীদের তালিকাভুক্ত করুন। -সূরা আল-ইমরান ৫৩
আসহাবে কাহ্ফের দুআ : হযরত ঈসা (আ.)-এর কিছুকাল পর রোম সম্রাজ্যের অন্তর্গত তারাসূস শহরে এক স্বৈরাচারী শাসকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই অত্যাচারী বাদশা সকল মানুষকে মূর্তিপূজার প্রতি আহŸান করত এবং যে সকল মুমিন তার এহেন দুষ্কর্মে সাড়া দিত না তাদেরকে সে হত্যা করত।
ঈমানদার সমাজের জন্য এটি এক গুরুতর সঙ্কটরূপে দেখা দিল। এ পরিস্থিতি দেখে একদল যুবক অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তাদের সংবাদ বাদশাহের সম্মুখে উপস্থিত করা হলে বাদশাহ তাদেরকে মূর্তিপূজা না করলে হত্যার হুমকি দিল। ঈমানদীপ্ত যুবকেরা বাদশাহর মুখোমুখি দÐায়মান হয়ে নিজেদের ঈমান প্রকাশ করে বলল, আকাশমÐলী ও পৃথিবীর অধিপতিই আমাদের রব। আমরা তাঁকে ছাড়া অন্যকে কক্ষনো প্রভু হিসাবে গ্রহণ করব না। অত্যাচারী শাসক তাদেরকে বলল, তোমরা অল্প বয়স্ক যুবক তোমাদেরকে নিজেদের সিদ্ধান্ত প্রকাশের জন্য আগামীকাল পর্যন্ত সুযোগ দেয়া হল। ঈমানদার যুবকের সংখ্যা ভয়ে রাতের বেলায় শহর ছেড়ে পলায়ন করল। ভোরের আলো ফুটতে আরম্ভ করলে তারা পাহাড়ের একটি গুহায় আত্মগোপন করল। তাদেরকেই আসহাবে কাহ্ফ বা গুহাবাসী বলা হয়। বাদশাহ ও তার সেনাবাহিনী তাদের পশ্চাদাবন করেছিল কিন্তু অত্যাচারী গোষ্ঠি গুহামুখে পৌঁছামাত্র ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল এবং গুহায় প্রবেশ করতে পারল না। বাদশাহ বলল, গুহার দরজা বন্ধ করে দাও। তাহলে তরা ক্ষুৎ পিপাসায় মারা যাবে। মুহাম্মদ আলী আসসাবূনী, সাফওয়াতুত তাফাসীর, সূরা কাহ্ফ, পৃ.৩। মুমিন যুবকেরা গুহায় প্রবেশ করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মহান দরবারে প্রার্থনা করেছিলেনÑ“হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি নিজের কাছ থেকে আমাদেরকে অনুগ্রহ দান করুন এবং আমাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালনা ব্যবস্থা করুন।” -সূরা কাহ্ফ-১০। আল্লাহতায়ালা তখন তাদেরকে গুহায় শান্তির নিদ্রা দান করেছিলেন। ফেরেশতাদের দুআ : ফেরেশতা আল্লাহপাকের এক প্রকার সম্মানিত মাখলূক। আল্লাহতায়ালা কোটি কোটি ফেরশতা সৃষ্টি করেছন। তন্মধ্যে চারজনের একটি দল আল্লাহপাকের আরশ বহন করে আছেন। আল বিদায়া, খ১, পৃ:৫৪। আর একদল ফেরেশতা আরশের চতুর্দিকে আরশ ঘিরে আছেন। এ উভয় দল আল্লাহপাকের অত্যন্ত নৈকট্য প্রাপ্ত ফেরেশতা। তাঁরা সর্বদা আল্লাহপাকের প্রশংসা, পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করেন। তাঁরা মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন, “হে আমাদের প্রতিপালক, আপনার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী। অতএব, যারা তওবা করে ও আপনার পথ অবলম্বন করে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।” ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি তাদেরকে দাখিল করুন স্থায়ী জান্নাতে, যার প্রতিশ্রæতি আপনি তাদেরকে দিয়েছেন এবং তাদের পিতামাতা, পতি-পতœী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তাদেরকেও। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আপনি তাদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। সেইদিন আপনি যাকে শাস্তি থেকে রক্ষা করবেন তাকে তো অনুগ্রহই করলেন। এ-ই তো মহাসাফল্য।’ সূরা মুমিন ৭-৯ আ’রাফে অবস্থানকারীদের দুআ : পরকালের হিসাব নিকাশের পর জান্নাতবাসী ও জাহান্নামবাসীদের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করা হবে। জান্নাত ও জাহান্নাম ভিন্ন তৃতীয় একটি স্থান হল আ’রাফ। যাদের নেক আমল ও বদ আমল সমান সমান হবে তাদেরকে প্রাথমিকভাবে আ’রাফে রাখা হবে। আ’রাফের অধিবাসীগণ নিজেদের স্থান থেকে জান্নাতী ও জাহান্নামী উভয় দলকে দেখতে পাবে। তারা জান্নাত লাভের আকাক্সক্ষায় থাকবে। এক পর্যায়ে তাদেরকে জান্নাতে পৌঁছানো হবে। আ’রাফ থেকে তাদের দৃষ্টি যখন জাহান্নামীদের ওপর পতিত হবে তখর তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বলবে, “হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে জালিম সম্প্রদায়ের সঙ্গী করবেন না।” (সূরা- আ’রাফ : ৪৭)
জান্নাত লাভের পর মুমিনদের দু’আ : মুমিনদের জন্য আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরষ্কার হল জান্নাত। জান্নাত চিরস্তায়ী শান্তির নিবাস। পরকালের হিসাব-নিকাশ ও মহাবিচারের পর মুমিনদেরকে যখন চিরস্থায়ীভাবে শান্তি ও আনন্দের নিবাস জান্নাতে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে তখন তারা সেখানে প্রবেশ করেই পেছনের জীবনের সকল দুঃখ-কষ্ট, ঘাত-প্রতিঘাত ও সংগ্রাম সংকটের কথা ভুলে যাবে। তাদের অন্তর থেকে এ দু’আ উচ্চারিত হবে “সকল প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি আমাদেরকে এর পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহ আমাদেরকে পথ না দেখালে আমরা কখনও পথ পেতাম না। আমাদের প্রতিপালকের রাসূলগণ তো সত্যবাণী এনেছিলেন।” (সূরা-আ’রাফ : ৪৩) মুমিনগণ কখনও এ দু’আ করবে, “সকল প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি আমাদের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রæতি পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে অধিকারী করেছেন এই ভূমির; আমরা জান্নাতে যেথায় ইচ্ছা বসবাস করব। সদাচারীদের পুরস্কার কহত উত্তম।” (সূরা-যুমার:৭৪)। তারা কখনও বলবে, “প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি আমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূরীভূত করেছেন, আমাদের প্রতিপালক তো ক্ষমাশীল, গুণগ্রাহী।’-ফাতির ৩৪। জান্নাতে গিয়ে মুমিনগণ প্রতিটি নেয়ামত ভোগ করার পর প্রতি নিশ্বাসে নিশ্বাসে আল্লাহপাকের শ্রেষ্ঠত্ব, সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করবে। শ্রেষ্ঠত্ব, পবিত্রতা ও মহিমা ষোষণা করবে। শ্রেষ্ঠত্ব, পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং প্রশংসা করে পরম তৃপ্তি লাভ করবে। জান্নাতে তাদের প্রধান ও শেষ কথা ও দুআ হবেÑ“প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই প্রাপ্য।”-সূরা ইউনুস: ১০।
‘আলহামদুলিল্লাহ’ শুধু জান্নাতীদের প্রধান ও শেষ দুআই নয়, বরং দুনিয়ায়ও সকল মুমিনের সর্ব অবস্থায় শ্রেষ্ঠ দুআ।
যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সর্বশ্রেষ্ঠ দুআ হল, আলহামদুলিল্লাহ। জালালুদ্দীন সুয়ূতী, আদদুররুল মানছুর, খ১, সূরা ফাতিহা, পৃ: ৩১ (ইবনে মাজা, বায়হাকী) হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহপাক কোনো বান্দাকে কোনো নেয়ামত দেয়ার পর সে যদি আলহামদুলিল্লাহ বলে, তবে সে যা গ্রহণ করল আল্লাহপাক তাকে এর চেয়ে অধিক দান করুন। সহীহ মুসলিম, খ১, কিতাবুল তাহারাত, পৃ:১১৮। হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপর এক হাদীসে রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপর একখানি হাদীসে এরশাদ করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ মীযানকে ভরে দেয়। তাফসীরে কুরতুরী, খ১, সূরা ফাতিহা, পৃ: ৯২। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত অপর এক হাদীসে রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘আমার কোনো উম্মতের হাতে যদি সমগ্র পৃথিবী উঠিয়ে দেয়া হয় এবং সে আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করে, তবে আলহামদুলিল্লাহ মর্যাদা পৃথিবী ও এর সমগ্র বস্তু থেকে উত্তম।’ ইমাম কুরতুবী বলেন, এর কারণ হল দুনিয়ার সকল নেয়ামত একসময় নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ’র সওয়াব কখনো খতম হবে না।
এ জন্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা পবিত্র কোরআনের প্রথম সূরার প্রথম আয়াতে ইরশাদ করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ রাব্বিল আলামীন। যেন আমরা এ দুআ করি-আমাদের জীবনের প্রতি দিবসে নিশীথে, প্রভাতে সন্ধ্যায়। শুধু তাই নয়, আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতের প্রতি রাকাতে আমরা যেন পাঠ করি, আলহামদুলিল্লাহহি রাব্বিল আলামীন। সুতরাং সকল প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার। তিনি চির প্রশংসিত। প্রারম্ভে, সমাপ্তিলগ্নে, ইহকালে, পরকালে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
SAIF ১৬ মার্চ, ২০১৭, ১১:০১ এএম says : 0
আলহামদুলিল্লাহ্‌ প্রকাশক এবং প্রবন্ধককে অনেক ধন্যবাদ, আল্লাহ তায়ালা আপনাদের সকলকে এর উত্তম যাজা প্রধান করুন,
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন