শামীম চৌধুরী, কলম্বো (শ্রীলঙ্কা) থেকে : কলম্বোবাসীদের অনেকের কাছেই পি.সারা ওভাল অচেনা। টুক টুক ড্রাইভারদের গুগল ম্যাপ দেখিয়ে চিনিয়ে নিতে হয় ভেন্যুটিকে। তামিল ক্রিকেট ইউনিয়ন অ্যান্ড অ্যাথলেটিক ক্লাবের এই মাঠটি কালের সাক্ষী, অজি লিজেন্ডারি ডন ব্রাডম্যানের পায়ের স্পর্শ পেয়েছে ভেন্যুটি। শ্রীলঙ্কার অভিষেক টেস্টের ৩৫ বছর পূর্তি হয়ে গেছে ২৮ দিন আগে, এই ভেন্যুতেই বাংলাদেশ খেলতে যাচ্ছে শততম টেস্ট-অথচ এমন একটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা ভেন্যুটির কোথাও নেই বাংলাদেশের শততম টেস্ট উদযাপনের আবহ! নেই কোথাও পোস্টার, বিলবোর্ডে এমন কিছু’র বার্তা! বাংলাদেশ দলের আবাসনের জন্য হোটেল তাজ সমুদ্র কমপ্লেক্সে পর্যন্ত বাংলাদেশের এমন মাইলস্টোনের বার্তা নেই!
২০০০ সালের ১০ নভেম্বরে টেস্ট এরিনায় পা দেয়ার শুভক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখতে আয়োজনের পর আয়োজন, দেশের বাইরে শততম টেস্টে তার ছিটে-ফোটাও নেই। তারপরও মাইলস্টোন টেস্টের সামনে দাঁড়িয়ে রোমাঞ্চিত বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা। সেই শৈশবে, দুর্জয়, আকরাম, বুলবুল, রফিক, হাবিবুলদের অভিষেক টেস্টে দেখে মনের ভেতরে যা লালন করেছেন, দুর্জয়দের সেই উত্তরসূরিরদের হাত ধরে ১৬ বছর ৪ মাস ৫ দিনের মাথায় এসে শততম টেস্টের মাইলফলকে পা রাখছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এমন একটি দিনে শততম টেস্ট উদযাপন করতে যাচ্ছে, যে দিনটি ক্রিকেট বিশ্ব উদযাপন করবে টেস্ট ইতিহাসের ১৪০ তম বার্ষিকী!
এমন এক মাইলস্টোনের সামনে দাঁড়িয়ে অন্য এক শিহরণ অনুভব করছে ক্রিকেটারদের সবার। ১১ জন হয়ে যাবেন বিশেষ ফ্রেমে বন্দি। তাতেই আগে-ভাগে অন্য এক উত্তাপ, শিহরণ, রোমাঞ্চ। টেস্ট ইতিহাসের এমন একটি মাইলস্টোনের ম্যাচে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে মুশফিকও হয়ে যাবেন ইতিহাসের অংশ। তাই অবচেতন মনে অন্য এক ভালোলাগা অনুভব করছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
শততম টেস্টে বাংলাদেশের জন্য যে ভেন্যু প্রস্তুত, সেই ভেন্যুতে বাংলাদেশ দলের অতীত মোটেও সুখকর নয়। তিন ম্যাচের তিনটিতেই ইনিংস ব্যবধানে হার। দেশের মাটিতে শততম টেস্ট খেলতে পারলে তা অন্যভাবে দেশবাসীও পারতো উদযাপন করতে। তবে এ নিয়ে আক্ষেপ নিশ্চয়ই থাকার কথা নয় মুশফিকের। হবার কথাও নয়। কেননা, দেশের মাটিতে শততম টেস্ট খেলতে পেরেছে ৫টি দেশÑইংল্যান্ড (১৯০৯ সালে হেডিংলিতে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে), দ.আফ্রিকা (১৯৪৯ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পোর্ট এলিজাবেথে), শ্রীলঙ্কা (২০০২ সালে সিংহলীজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে পাকিস্তানের বিপক্ষে), ওয়েস্ট ইন্ডিজ (জ্যামাইকার স্যাবাইনা পার্কে, ১৯৬৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে), জিম্বাবুয়ে (২০১৬ সালে হারারে ক্রিকেট গ্রাউন্ডে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে)।
জয় দিয়ে শততম টেস্ট উদযাপনের অতীত সেখানে অস্ট্রেলিয়ার (১৯১২ সালে ওল্ড ট্রাফোর্ডে দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে ইনিংস এবং ৮৮ রানে জয়), পাকিস্তানের (১৯৭৯ সালে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৭১ রানে জয়), ওয়েস্ট ইন্ডিজের (১৯৬৫ সালে স্যাবাইনা পার্কে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৭৯ রানে জয়)। দেশবাসীকে দেয়া কথা রাখতে পারলে এই তালিকায় যুক্ত হবে বাংলাদেশেরও নাম। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে রাখবে বিশেষ এই মাইলস্টোন।
তবে সবকিছু বাদ দিলে একদিক থেকে সবার চাইতে এগিয়েই আছে বাংলাদেশ। টেস্ট ম্যাচের দ্রæততম সেঞ্চুরিটি বাংরাদেশের দখলেই! মুশফিকুরের ১ বছর পর টেস্ট অভিষেক হয়ে বাংলাদেশ অধিনায়কের (৫৩) প্রায় তিনগুণ বেশি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন ইংল্যান্ডের অ্যালিস্টার কুক (১৪০)। মুশফিকুরের ২ বছর পর টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু করে তার প্রায় দ্বিগুণ ম্যাচ বেশি খেলে ফেলেছেন ইংল্যান্ড পেস বোলার স্টুয়ার্ট ব্রড। অথচ, যেখানে অ্যালিস্টার কুক ১১ বছরে খেলেছেন ১৪০টি টেস্ট, সেখানে বাংলাদেশকে ১০০ টেস্ট এর মাইলস্টোনে পা দিতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ১৬ বছর ৪ মাস ৫ দিন! ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ টেস্ট অভিষেকের পর আইসিসি’র রক্তচক্ষু, আর নানা অজুহাতে ফিউচার ট্যুর প্রজেক্টে (এফটিপি) পায়নি টেস্টে খুব একটা সøট। টেস্ট আঙিনায় পা দিয়ে ১৬ বছর ৪ মাস ৫ দিনে বাংলাদেশ যেখানে ৯৯টি টেস্ট দিয়েছে পাড়ি, সেখানে এই সময়ে ইংল্যান্ড খেলেছে সর্বাধিক ২১০টি টেস্ট, অস্ট্রেলিয়া সেখানে ১৯৩টি, নিউজিল্যান্ড ১৭৯টি, ভারত ১৭৭টি, দ.আফ্রিকা ১৬৪টি, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৫৬টি, শ্রীলঙ্কা ১৫২টি, পাকিস্তান ১৩৭টি টেস্ট করেছে পার। ২০০৬ থেকে ২০১১Ñএই পাঁচ বছর স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকায় জিম্বাবুয়েকে ৫৬ টেস্টে থাকতে হয়েছে সীমাবদ্ধ।
তারপরও অদ্ভুত তথ্য আছে। রেকর্ডস বলছে শততম টেস্টের মাইলফলকে বাংলাদেশকেই সবচেয়ে কম সময় অতিবাহিত করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের আগে শততম টেস্ট খেলতে সবচেয়ে কম সময় নিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। তাদের সময় লেগেছে ১৮ বছর ৩ মাস ২৯ দিন। বাংলাদেশের চেয়ে ২ বছর বেশি। টেস্ট ইতিহাসে তিন অংকের কোটা স্পর্শ করতে সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে দক্ষিণ আফ্রিকার। সময়ের হিসেবে ৫৯ বছর ১১ মাস ২২দিন। দক্ষিণ আফ্রিকার পর বেশি সময় লেগেছে নিউজিল্যান্ডের, ৪২ বছর ২ মাস ১৪দিন। গত বছরের অক্টোবরে সেঞ্চুরি পূর্ণ করতে জিম্বাবুয়ের সময় লেগেছে ২৪ বছর ১২দিন। ১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ টেস্ট ইতিহাস রচিত হয়েছে যাদের হাত ধরে, সেই প্রথম টেস্ট খেলা দুই দল অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের শততম টেস্ট খেলতে সময় লেগেছে যথাক্রমে ৩৫ বছর ২ মাস ১৩দিন এবং ৩৫ বছর ৩ মাস ১৭দিন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সময় লেগেছে ৩৬ বছর ৮ মাস ৫৯ দিন। শততম টেস্ট খেলতে ভারতের সময় লেগেছিল ৩৫ বছর ১৯দিন। পাকিস্তানের লেগেছিল ২৬ বছর ৪ মাস ২৩দিন। ১৪০ বছর আগে যে দিনে মেলবোর্নে প্রবর্তিত হয়েছে টেস্ট, মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের সেই টেস্টের ১৪০তম বর্ষে শ্রীলঙ্কার পি. সারায় বাংলাদেশ উদযাপন করবে শততম টেস্ট।
তবে সেঞ্চুরি টেস্টের সামনে দাঁড়িয়ে টেস্টে সাফল্যাঙ্কে কিন্তু অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। দেশের পক্ষে প্রথম ১০০ টেস্টে ১০টি টেস্ট প্লেইং দেশের মধ্যে বাংলাদেশের বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ যেখানে ৯৯টি টেস্টে জিতেছে ৮টি ম্যাচ, সেখানে ১০০ টেস্টে জিতে ফেলেছে, সেখানে নিউজিল্যান্ডের জয় ৬টি। তবে ১০০ টেস্টে হারের সংখ্যাগত দিক থেকে নিউজিল্যান্ডের চেয়ে অনেক পিছিয়ে বংলাদেশ। ১০০ টেস্টের মধ্যে ৭টি জয়ের পাশে নিউজিল্যান্ড যেখানে ড্র’ করেছে ৪৬টিতে,সেখানে বাংলাদেশের ড্র’র সংখ্যা ১৫টি। প্রথম ১০০ টেস্টে সর্বাধিক ৪৫টি জয় ইংল্যান্ডের, অস্ট্রেলিয়া ৪২, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩৪, শ্রীলঙ্কা ১৮, পাকিস্তান ১৬, দ.আফ্রিকা ১৩, জিম্বাবুয়ে ১১ ও ভারত ১০টিতে পেয়েছে জয়। দেশের মাটিতে শততম টেস্ট খেলতে পেরেছে ইংল্যান্ড (১৯০৯ সালে হেডিংলিতে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে), দ.আফ্রিকা (১৯৪৯ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পোর্ট এলিজাবেথে), শ্রীলঙ্কা (২০০২ সালে সিংহলীজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে পাকিস্তানের বিপক্ষে), ওয়েস্ট ইন্ডিজ (জ্যামাইকার স্যাবাইনা পার্কে, ১৯৬৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে), জিম্বাবুয়ে (২০১৬ সালে হারারে ক্রিকেট গ্রাউন্ডে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে)। জয় দিয়ে শততম টেস্ট উদযাপনের অতীত সেখানে অস্ট্রেলিয়ার (১৯১২ সালে ওল্ড ট্রাফোর্ডে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ইনিংস এবং ৮৮ রানে জয়), পাকিস্তানের (১৯৭৯ সালে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৭১ রানে জয়), ওয়েস্ট ইন্ডিজের (১৯৬৫ সালে স্যাবাইনা পার্কে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৭৯ রানে জয়)।
১শ’ টেস্টে সময়ের হিসেবে দ্রæততম বাংলাদেশ এই মাইলস্টোনে ব্যক্তিগত পারফরমেন্সেও করেছে রেকর্ড। দেশের হয়ে শততম টেস্টের দিনে টেস্টে শ্রীলঙ্কার মুরালীধরন, জিম্বাবুয়ের হিথ স্ট্রিকের পরই ভালো বোলিংয়ের রেকর্ড সাকিব আল হাসানের। লঙ্কান স্পিন লিজেন্ডারী নিজ দেশের একই মাইলফলকের ম্যাচে ৫১ ম্যাচে নামের পাশে শিকার সংখ্যা উন্নীত করেছেন ২৫৩টি, জিম্বাবুয়ের হিথ স্ট্রিকই দেশের হয়ে ১০০তম টেস্টে যেদিন করেছেন প্রতিনিধিত্ব, সেদিন তার নামের পাশে ৬৫ টেস্ট শিকার সংখ্যা ২১৬ উইকেট। সাকিব আল হাসানের সেখানে শিকার সংখ্যা দেশের ৯৯টি ম্যাচ শেষে ১৭৯ উইকেট। নিজ দেশের ১০০ টেস্টে এসে সবচেয়ে বেশি রানের মালিক শ্রীলঙ্কার অরবিন্দ ডি সিলভা। শ্রীলঙ্কার প্রথম ১০০ টেস্টের মধ্যে ৮১টি খেলা এই মিডল অর্ডার করেছেন ৫৬১৯। জিম্বাবুয়ের অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ৪৭৯৪ এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের এভার্টন উইকস ৪৪৫৫ রান করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছেন। এই রেকর্ডে আছেন বাংলাদেশের তামীম ইকবালও। বাংলাদেশ যেদিন ১০০তম টেস্টের টস করেছে, তখন তার নামের পাশে ৩৫৪৬ রান।
শততম টেস্টের সাফল্যাঙ্ক
দেশ জয় হার সময়কাল
অস্ট্রেলিয়া ৪১ ৪০ ৩৫ বছর ২ মাস ১৩ দিন
ইংল্যান্ড ৪৫ ৩৭ ৩২ বছর ৩ মাস ১৭দিন
দ.আফ্রিকা ১৫ ৫১ ৫৯ বছর ১১ মাস ২২ দিন
উইন্ডিজ ৩৪ ৩৩ ৩৬ বছর ৮ মাস ৯ দিন
নিউজিল্যান্ড ৭ ৪৬ ৪২ বছর ২ মাস ১৪ দিন
ভারত ১০ ৩৯ ৩৫ বছর ১৯ দিন
পাকিস্তান ১৮ ২৬ ২৬ বছর ৪ মাস ২৩ দিন
শ্রীলংকা ১৮ ৩৯ ১৮ বছর ৩ মাস ২৯ দিন
জিম্বাবুয়ে ১১ ৬২ ২৪ বছর ১২ দিন
বাংলাদেশ ৮ ৭৬ ১৬ বছর ৪ মাস ৫ দিন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন