স্টালিন সরকার : সিনেমার নাম ‘বিসর্জন’। কোলকাতার এই বাংলা সিনেমা নির্মাণ করেছেন কৌশিক গাঙ্গুলি; মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের টিভি নায়িকা জয়া আহসান। সিনেমার গল্প প্রেমনির্ভর হলেও প্রেক্ষাপট এক সময়ের পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) ও ভারত। ছবিতে লোকেশন সীমান্তবর্তী এলাকা ও চেকপোস্টকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ‘বিসর্জন’ সিনেমায় পূর্ব পাকিস্তানের বিধবা নারী পদ্ম চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান; অন্যদিকে ভারতীয় প্রেমিকের ভূমিকায় আবীর চ্যাটার্জি। কিছুদিন আগে ভারতের টিভিগুলোতে বিসর্জন ছবির বিজ্ঞাপন প্রচার হয়। ওই বিজ্ঞাপনে দেখা যায় বিছানার দৃশ্যে অভিনয়ে নায়িকা বিবস্ত্র জয়া আহসান নিজের নারীত্বের বিসর্জন দেন। তার এ দৃশ্য মায়ের জাতি নারী সমাজকে কলঙ্কিত করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই দৃশ্য নিয়ে তীব্র বিতর্ক ও ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠায় বিজ্ঞাপন প্রচারণা বন্ধ হয়। আগামী পহেলা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) বিসর্জন ছবিটি মুক্তির দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ায় গত শুক্রবার অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে ছবিটির ট্রেলার। ছবির শুরুতেই সংবাদভাষ্যে শোনা যায় ‘নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজত কর্মীদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সম্পর্কে সকলেই সতর্ক থাকুন’। সিনেমার পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলি বলেছেন, ‘বিসর্জন নিখাদ বাংলা ছবি। এটি সা¤প্রতিক সময়ের গল্প। কাঁটাতার দিয়ে দুই বাংলাকে আলাদা করা যায় না। বরং প্রেম মিলিয়ে দেয় দুই বাংলাকে সেটাই সিনেমার গল্প। চমৎকার কথা! কথায় বলে শিল্পীদের দেশ-কাল-পাত্রের সীমারেখা থাকতে নেই। কাঁটাতার দিয়ে দুই বাংলাকে আলাদা করা যায় না কাব্যিক পংক্তি। কৌশিক গাঙ্গুলির শিল্পীমন উদ্দেশ্যমূলক ভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের নামের সঙ্গে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ জুড়ে দেন কী বিশ্বাস থেকে? সিনেমার ট্রেইলারের শুরুতেই সকলেই সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন সেলুলয়েড ফিতায়। কিন্তু কুড়িগ্রামের রৌমারীতে কাঁটাতারে ফেলানীর ঝুলে থাকার দৃশ্য তার শিল্পী মন কী আহতবোধ করে না? যদি করতো তাহলে মানবিক কারণে ফেলানী ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করা কী উচিত ছিল না? আর উচিত ছিল বিএসএফের আগ্রাসী মনোভাব বন্ধের দাবিতে শ্লোগান ট্রেইলারে তুলে ধরা। তিনি কী সেটা করেছেন? এ কেমন একচোখা শিল্পীমন?
বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম সিনেমা হলেও সেখানে রাজনীতি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের দেশে ‘আবার তোরা মানুষ হ, ওরা এগার জন, সংগ্রাম, আলোর মিছিল, সূর্য্যস্নান, অরুণোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী, আমার জন্মভূমি, কলমীলতা, মেঘের অনেক রং, এখনো অনেক রাত, আগুনের পরশমণিসহ অনেক কালজয়ী রাজনৈতিক সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এসব সিনেমায় রাজনৈতিক বক্তব্য যেমন ছিল তেমনি শিল্পের উপাদানও ছিল। দেশ-সমাজ-জাতি গঠনে এসব সিনেমার ভূমিকা অপরিসীম। সিনেমার মাধ্যমে একটি জাতির প্রকৃত চরিত্র প্রতিফলিত হয়, জাতি গঠনে দিক-নির্দেশনা পায়। সেই সাথে জাতির চরিত্রের উপরও সিনেমা বিশেষ প্রভাব ফেলে। সিনেমার মাধ্যমেই ধীরে ধীরে দেশে-সমাজে মানুষের আচার-আচরণ, অভ্যাস, মূল্যবোধ তৈরি হয়। সিনেমার প্রতিষ্ঠাতা মার্কিন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন বলেছেন, ‘সিনেমার সাহায্যে মানুষ কীভাবে অজানা ও প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে সরাসরি এবং সুন্দরভাবে শিখছে সেটা দেখাই ছিল আমার স্বপ্ন। কিন্তু যখনি সিনেমা বিনোদন আর প্রচারের মাধ্যমে পরিণত হলো আমি তখনি হাল ছেড়ে দিয়েছি। কেননা এর মাধ্যমে আর আমার স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত হবে না, সেটা আমি বুঝে ফেলেছি’। বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন বেঁচে নেই। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন হয়তো আজকে দেখতেন সিনেমা শুধু বিনোদন নয়; দেশের বিরুদ্ধে দেশ, সমাজের বিরুদ্ধে সমাজ, শিল্পীর বিরুদ্ধে শিল্পীর বিদ্বেষ ছড়ানোর ‘মাধ্যমে’ পরিণত হয়েছে সিনেমা। রাজনীতির কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি হচ্ছে। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোয় সিনেমা অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে।
সিনেমার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব যেমন সৃষ্টি হয়; ঠিক তেমনি নেতিবাচক প্রভাবও পড়ে। বর্তমানে নাটক, সিনেমায় শিক্ষণীয় যেমন কিছু পাওয়া যায়; তেমনি অসত্য, অশ্লীল, বিদ্বেষমূলক কিছু কার্যক্রম সমাজে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক ফেলছে। মানুষের মন বিষিয়ে তুলছে। চতুর কিছু মানুষ এই শিল্পকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করে সিনেমাকে সমাজ ও ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। ইসলাম ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো এবং আলেম ওলামাদের কটূক্তি করা যেন এখন প্রগতিশীল উচ্চমার্গের বিকল্প ধারার সিনেমার নামান্তর। অস্বীকার করার উপায় নেই সিনেমা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিনোদনের প্রয়োজন মেটায়। তথ্য, শিক্ষা আর আনন্দ বিতরণের মধ্য দিয়ে সিনেমা কার্যত সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালন করে। যাঁরা সমাজের কর্ণধার, সামাজিক বিবর্তনকে যাঁরা বিশেষ একটি নির্ধারিত পথে সমাজ পরিচালিত করতে চান তাঁদের কেউ কেউ সিনেমা মাধ্যমকে নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। নিজেদের ইচ্ছা, রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আকাক্সক্ষাকে সুকৌশলে সিনেমার ফ্রেমে ধারণ করে দর্শকদের মাঝে ছড়িয়ে সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করছেন। যা শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ-উন্নতির চেয়ে উল্টো সমাজকে করছে দূষিত। অথচ কিছু বোকা দর্শক ও মানুষ বলছেন সিনেমা শুধুই বিনোদন। বাস্তবে দেখা যায় ধুরন্ধর কিছু ইসলাম বিদ্বেষী বুদ্ধিজীবী, শিল্পের ক্রিয়াশীল ব্যক্তি সংস্কৃতি সেবার নামে বিনোদনের মাধ্যম সিনেমাকে বেছে নিয়েছেন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। তারা সুকৌশলে সিনেমার মাধ্যমে আলেম ও মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, ইসলাম বিদ্বেষী অপপ্রচার চালাচ্ছেন। প্রগতিশীলতার নামে আলেম-ওলামা-পীর-মাশায়েখদের নতুন প্রজন্মের সামনে ‘বিতর্কিত’ চরিত্র প্রমাণের চেষ্টা করছেন। সিনেমায় এই ইসলাম বিদ্বেষ পশ্চিমা বিশ্বের পাশাপাশি ভারত ও বাংলাদেশে সমান তালে চলছে। যখন একটি সিনেমা তৈরী হয় তখন সেটা বিশেষ ভাষা বা জাতির সীমানায় আবদ্ধ থাকে না। বিজ্ঞানের বদৌলতে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ওই শিল্পকর্ম সিনেমার মাধ্যমে শিল্পী তার আনন্দকে অন্য মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। জীবনের আনন্দকে উপলব্ধি করার। শিল্পী কাজের মধ্য দিয়ে অন্যদের আমন্ত্রণ জানান তার কর্মযজ্ঞের আঙিনায়। তারই ফলে দেখা যাচ্ছে কিছু শিল্পী সিনেমার নামে নিজ নিজ বিশ্বাসকে অন্যের দিকে ছড়িয়ে দিয়েই ক্ষ্যান্ত হচ্ছেন না; পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসলাম বিদ্বেষীদের খুশি করতে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে অব্যাহত ভাবে বিয়োদগার করেই চলছেন। নিজেদের রাজনৈতিক বিশ্বাস উপরে তুলে ধরতে অন্যের বিশ্বাসের উপর অনৈতিক আঘাত হানছেন গল্পের কাল্পনিক চরিত্রের মাধ্যমে। তাদের গল্প আলেম ওলামা মানেই খারাপ; আর তথাকথিত প্রগতিশীল এবং ইসলাম বিদ্বেষ মানেই সমৃদ্ধ শিল্প!
শুধু রাজনৈতিক ভাবেই নয়; অপ্রিয় হলেও সত্য যে শিল্প সমৃদ্ধির চেয়েও ইসলামকে টার্গেট করে এখন দেদারসে সিনেমা তৈরি হচ্ছে। পশ্চিমাদের অর্থে ‘উসামা’ নামের একটি সিনেমা তৈরি হয়েছিল কার্যত আফগানিস্তানের তালেবানদের কর্মকাÐ বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে। সেখানে তালেবানদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও আমেরিকার জুলুম-নির্যাতনের চিত্র উপস্থাপিত হয়নি। ২০০৯ সালে ব্যাপক আলোচিত হিন্দী সিনেমা ‘সøাম মিলেনিয়াম’-এ যেমন সুকৌশলে তুলে ধরা হয় ভারতীয় মুসলমানদের সøাম চরিত্রের মাধ্যমে আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশন। জামালের ভাই সেলিম আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন। সেলিম নামাজ শেষ করে পিস্তল নিয়ে বের হয় এবং খুন করে। অমিতাভ বচ্চন ও অভিষেক বচ্চন অভিনীত রাম গোপাল ভার্মা পরিচালিত ‘সরকার’ সিনেমায়ও মুসলিম বিদ্বেষ চিত্রিত হয়। বিধর্মীরা ইসলাম বিদ্বেষী এমন অসংখ্য সিনেমা তৈরি করেছে। হিন্দুত্ববাদী ভারতে সে ধারার সর্বশেষ সংযোজন ‘বিসর্জন’। শুধু কি ভারতের সিনেমায় মুসলিম বিদ্বেষ! বাংলাদেশের সিনেমা এ দায় থেকে মুক্ত নয়। তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ ছবিটি দেখেছেন? অনু চরিত্রকে কিভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে? সেখানে ইসলাম ধর্ম, পবিত্র কোরআন পাঠ, মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে কি ধরনের ‘তামাশা’ করা হয়েছে। তাঁর নির্মিত ‘রানওয়ে’ সিনেমায় মাদ্রাসায় পড়–য়া রুহুলকে কীভাবে জঙ্গিবাদে সাথে সম্পৃক্ত হয়, তার জঙ্গি শিবিরে শরিক হওয়া এবং সিনেমা হলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো দেখানো হয়েছে। জঙ্গী আরিফের সঙ্গে রুহুলের মিলে যাওয়া এবং তাদের কর্মকান্ড যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে সেটা কি সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দেয় না? গ্যারিলা সিনেমায় মসজিদের ইমামকে দিয়ে মানুষকে জবাই করানো দেখানো হয়। নামাজি দাড়ি টুপিওয়ালা লোক গুলি সকল অপরাধের সাথে জড়িত। নায়িকা জয়া আহসানের শরীর থেকে ঘৃণার সাথে বোরকা খুলে ফেলার দৃশ্যে বুঝা যায় সিনেমা কী বার্তা দর্শকদের দিতে নির্মিত হয়েছে। আবু সাঈদের ‘অপেক্ষা’ সিনেমায় কী আছে? ইসলাম এমন একটি ধর্ম যে ধর্মের ছোঁয়ায় এলে আধুনিক মনস্ক তরুণরাও পাইকারী হারে মানুষ হত্যাকে সওয়াবের বিষয় হিসেবে মনে করেন। এই হলো ‘অপেক্ষা’ সিনেমার বার্তা! এসব সিনেমায় সমাজ গঠনের কী বার্তা দেয়া হয়েছে?
কোলকাতার বিসর্জন সিনেমায় বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে কিছু দলের নাম অনাকাক্সিক্ষত ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু যে কাঁটাতারের বেড়ার বিরুদ্ধে সিনেমার গল্প সেই কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানির কাহিনী উপেক্ষিত কেন হলো সেটাই প্রশ্ন। যদি ফেলানীর দৃশ্য দেখিয়ে বা সেøাগানে কাঁটাতারের এই চিত্রের বিরুদ্ধে সেøাগান দেখানো হতো তাহলে না হয় বোঝা যেত শিল্পীর কোনো নিজস্ব ঘর-বাড়ি নেই; পক্ষপাতিত্ব নেই। তিনি মানুষের জীবনের সমসাময়িক গল্প নিয়ে ছবি নির্মাণ করেছেন। কিন্তু কাঁটাতারে ফেলানীকে ঝুলে রেখে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে নৈরাজ্য জুড়ে দেয়ার গল্প ফাঁদলেন! এর নেপথ্যের রহস্য কী? সিনেমার অনাকাক্সিক্ষত দৃশ্য সম্পর্কে নায়িকা জয়া আহসানকে কোলকাতার সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন সিনেমায় আপনি কি ব্যক্তিগত বিসর্জনের কথা বলছেন? ‘দেখুন কারো জীবনই পরিপূর্ণ নয়। কাজের ইঁদুর দৌড়ে হয়তো আমরা নিজের সত্তা বিসর্জন দিয়ে ফেলি। হয়তো অজান্তেই দিয়ে ফেলি। বলতে পারি না, বুঝতেও পারি না। জীবন যুদ্ধে হয়তো অনেক বিসর্জন থাকে। তাই কী হারিয়েছি তা বুঝতে পারি না’ জবাব দেন জয়া। তবে নায়ক আবীরকে তাচ্ছিলের ভঙ্গিতে সিগারেট হাতে জয়ার ওই সংলাপ রহস্যের ইঙ্গিত দেয়; ‘সকালের বিধবার লগে রাইতের ছিনালের কোনো মিল নাই নাই ----’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন