আফতাব হোসেন হৃদয় খান : ইসলাম মানবতার কল্যাণে নিবেদিত একটি পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যমূলক জীবনব্যবস্থা। মানব জীবনের প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর সার্বিক বিষয়ে ইসলাম চমৎকার দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। মানব সভ্যতার রূপায়ণে কবি ও কবিতা এক অবিচ্ছেদ অংশ। কবি ও কবিতা কালের মহান এক সাক্ষী। মানব মনন, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। ইসলামের দৃষ্টিতে কবিতা দু’ধরনের-একটি সত্য ও সুন্দরের পথ প্রদর্শক, অপরটি মানব সভ্যতার জন্য ধ্বংসাত্মক, অকল্যাণকর, কুরুচিপূর্ণ বিভ্রান্ত চিন্তার ধারক। ইসলাম একদিকে যেমন কল্যাণকর সাহিত্যের সৃষ্টিতে উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়েছে ঠিক তেমনি সভ্যতার জন্য ক্ষতিকারক ও অশ্লীল সাহিত্য তৈরিতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। পবিত্র কোরআনুল কারীমে কবিদের নামে সুনিপুণ বর্ণনাসমৃদ্ধ ‘আশ-শুয়ারা’ নামক পূর্ণাঙ্গ একটি সূরা রয়েছে। উক্ত সূরায় আল্লাহ বলেন:- এবং কবিদের যারা অনুসরণ করে তারা বিভ্রান্ত। আপনি কি দেখেন না যে তারা প্রতি ময়দানেই উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন কথা বলে যা তারা করে না। তবে তাদের কথা ভিন্ন যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে এবং অত্যাচারিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। অত্যাচারীরা অচিরেই জানিবে কোন স্থানে তারা ফিরে আসবে। (সূরা-আশশুয়ারা, আয়াত ২২৪-২২৭)
এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর হযরত আব্দল্লাহ বিন রাওয়াহা, হাসসান বিন সাবিত, কা’ব ইবনে মালিক প্রমুখ সাহাবী কবি কাঁদতে কাঁদতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খেদমতে হাজির হন এবং আরজ করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহ তা’য়ালা এই আয়াত নাযিল করেছেন। আমরাওতো কবিতা রচনা করি, এখন আমাদের উপায় কী? রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন আয়াতের শেষাংশ পাঠ কর। এ আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, তোমাদের কবিতা যেন অনর্থক ও ভ্রান্ত উদ্দেশ্যে প্রণোদিত না হয়। কাজেই তোমরা আয়াতের শেষাংশে উল্লিখিত কবিদের শামিল, (ফতহুল বারী) আলোচ্য আয়াতের একদিকে বিপথগামী মুশরিক কবিদের চিহ্নিত করা হয়েছে এবং অপর দিকে তুলনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে সত্য ও সুন্দরের পতাকাবাহী ঈমানদার কবিদের শ্রেষ্ঠত্ব নিরুপন করে তাদেরকে উৎসাহিত করা হয়েছে। যারা কবি তারা প্রাকৃতিকভাবেই কিছুটা ভাবুক, কল্পনাপ্রবণ ও আবেগী। এটা তাদের স্বভাব ধর্ম। এ কল্পনাপ্রবণ ও আবেগী না হলে কাব্য সৃষ্টি করা যায় না। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে কবিদের প্রতি বিশেষ এক নেয়ামত। যে কারণে সাধারণ মানুষ যা পারে না তারা পারেন, আর পারেন বলেই তারা কবি। কবিদের এ ভাবের জগৎ থেকে, কল্পনাপ্রবণতা থেকে দূরে রাখা আল্লাহর ইচ্ছা নয়। তবে তারা যেন এ ভাবের জগতে বিচরণ করতে গিয়ে বিপথগামী না হয় এ জন্য আল্লাহ্তা’য়ালা কয়েকটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন: ১। একজন কবিকে ঈমানদার হতে হবে। ২। ঈমান আনার সাথে সাথে অসৎ কর্ম বর্জন করে সত্য ও সুন্দরের অনুসারী হতে হবে। ৩। এ ভাব প্রবণতা ও আবেগী বিচরণ যাতে তাকে সৎ পথ থেকে বিচ্যুত করতে না পারে সে জন্য আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে সদা সর্বদা তার সাহায্য চাইতে হবে। ৪। আর যখনি মানবতা বিপন্ন হবে, নিপীড়িত, নির্যাতিত হবে তখনি কবি তার সর্ব শক্তি নিয়োগ করে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করবেন। মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার সচেতন করে তোলার জন্য, নিপীড়ন ও নির্যাতনের ব্যাপারে জনগণকে একত্র করার জন্য, কিসে এবং কিভাবে মানবতা বিপন্ন হচ্ছে তা স্পষ্ট করার জন্য সভ্যতার স্বপক্ষে বিপ্লবের বাণী উচ্চকিত করার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে কবিদের।
কবি ও কবিতার এক উর্বর জনপদে জন্মগ্রহণ করে ছিলেন রাসূলে আরাবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুয়াত প্রাপ্তির আগেই রাসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মধ্যে আরবী ভাষা ও সাহিত্যর ওপর একটি অসাধারণ দখল এসে গিয়েছিল প্রকৃতিগতভাবে একজন আরব হবার কারণে। এছাড়া কবি ও কবিতার প্রতি তার একটি স্বভাবসুলভ আগ্রহ ও কৌত‚হল ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে যেমন কবিতা শুনতে ভালবাসতেন ঠিক তেমনি অন্যদের ও তিনি কবিতার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্যে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বলেছেন ‘যে দু’টো মনোরম আবরণে আল্লাহ তা’য়ালা বিশ্বকে সাজিয়ে থাকেন, কবিতা তার একটি’। রাসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেছেন ‘নিঃসন্দেহে কোন কোন কবিতায় রয়েছে প্রকৃতি জ্ঞানের কথা,’ তিনি সাহাবীদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন ‘তোমরা তোমাদের সন্তনদেরকে কবিতা শেখাও, এতে তার কথা মিষ্টি ও সুরেলা হবে’। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন