শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

ইসলামীর ইবাদতের চতুর্থ রোকন : হজ

সত্যালোকের সন্ধানে

| প্রকাশের সময় : ২৩ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্্শী
ফল ও ফসলের রিজিক :
এই কেন্দ্রকে কায়েম এবং আবাদ রাখার জন্য এটা প্রয়োজন ছিল যে, এ বিরান উষর এলাকার বাসিন্দাদের জন্য ফল ও ফসলের রিজিকের ব্যবস্থা করা। এজন্য হযরত ইব্রাহীম (আ:) দোয়া করে ছিলেন, “হে আল্লাহ! আমি আমার আওলাদ-ফরজন্দকে পানিহীন বিশুষ্ক মুরুভূমিতে আবাদ করেছি, আপনি মানুষের অন্তরসমূহ তাদের দিকে অনুপ্রাণীত করে দিন এবং তাদের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা করে দিন এবং তাদের ফল ও ফসলের রিজিক প্রদান করুন।” আল্লাহ পাক তাঁর এই দোয়া কবুল করে ছিলেন। এর একটি ব্যবস্থা এই হতে পেরেছিল যে, এখানকার বাসিন্দাদের জন্য যাকাত, খয়রাতের অর্থের একটি অংশ নির্ধারিত করে দেয়া। কিন্তু এটা তাদের নৈতিক অবনতির ও অভাবগ্রস্ততার কারণে মানুষের নজরে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার উপক্রম হত। যা তাদের সম্মান, মর্যাদাও বৈশিষ্ট্যের উপযোগী হত না। এজন্য আল্লাহ পাক এর জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন যে, তাদের অন্তরে ব্যবসায়ের স্পৃহা বাড়িয়ে দিলেন। এবং ব্যবসাকেই তাদের রুজি-রোজগারের উপকরণ বানিয়ে দিলেন।
হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর সন্তানদের কথা অতীত ইতিহাসের যেখানেই পরিদৃষ্ট হয়, সেখানে তাদেরকে সওদাগরের বেশেই বেশী দেখা যায়। হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর ভ্রাতুষ্পুত্র এবং হযরত ইসহাকের (আ:) ছেলে হযরত ইয়াকুব (আ:)-এর জমানায় বনী ইসমাঈল (আ:)-এর তেজারতী কাফেলা আরব হতে মিসর পর্যন্ত গমন করতে দেখা যায়। (তাকবীন-২৭-২৮ হতে ২৬ পর্যন্ত) তৌরাতের বিভিন্ন স্থানে আরব সওদাগর ও ব্যবসায়ীদের উল্লেখ বিশেষভাবে পাওয়া যায়। স্বয়ং কুরাইশরাও সেকালে বড় ব্যবসায়ী ও সওদাগর ছিলেন, যার উল্লেখ সূরা কুরাইশে সুস্পষ্ট পাওয়া যায়। তারা একদিকে ইয়েমেন ও হাবশা পর্যন্ত এবং অপরদিকে সিরিয়া ও মিসর পর্যন্ত গমনাগমন করতেন। কিন্তু এই ব্যবসাও মক্কা মুয়াজ্জমার ছোট বড় সকলের উদরপূর্তির জন্য যথেষ্ট ছিল না। এজন্য স্বয়ং মক্কার ভূখন্ডকে হজের সময়ে ব্যবসায়ী বানানোর প্রয়োজন ছিল। কেননা ইসলামের পূর্বেও হজের মওসুম ছিল আরবদের জন্য বৃহত্তর মেলাস্বরূপ। ওকাজ প্রভৃতি স্থানে বড় মেলার আয়োজন করা হত। ইসলামও হজের মওসুমে মক্কায় ব্যবসা-বাণিজ্যকে জারী রেখেছে। কেননা এ কাজটি ছিল হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর দোয়ার ফলশ্রুতি। এবং এই অনুর্বর মরুসদৃশ্য ভূমির অধিবাসীদের জন্য রুজি-রোজগারের উপায়। ইসলামের বিজয় অর্জিত হওয়ার পর সারা দুনিয়ার মুসলমানগণ এখানে আগমন করতে থাকে। ফলে এখানে দু’তিন মাস অবস্থানকারী ব্যবসায়ীগণ অল্প সময়ে এত অধিক মুনাফা করতে পারেন যে, তারা গোটা বছরের খাওয়া-পরার সংস্থান করতে সক্ষম হন।
পবিত্র মক্কা হতে পবিত্র মদীনায় যে সকল কাফেলা গমন করত, তারা সকল রাস্তায় চলার পথে স্থানীয় বেদুঈন অধিবাসীরা উৎপাদিত পণ্য নিয়ে আসত এবং যাত্রীদের নিকট বিক্রয় করত। এভাবে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে সেখানকার অধিবাসীরা প্রয়োজনীয় প্রচুর মুনাফা অর্জন করত। একই সাথে খাওয়া-পরা, বাসস্থান দেয়া, আরোহীর ব্যবস্থা করা এবং অন্যান্য জরুরী তৈজসপত্র সংগ্রহ করার মাধ্যমে ব্যবসায়ের বাজার গরম হয়ে উঠত। শুধু শহরাঞ্চলই নয়, শহরতলী ও গ্রামীণ এলাকার লোকেরাও নানাভাবে উপকৃত হত। বহিরাগত হাজীগণ নিজেদের প্রয়োজনে মক্কা ও মদীনার অধিবাসীদের দ্বারস্থ হতেন এবং স্থানীয অধিবাসীরা তাদের নিকট হতে বিনিময়স্বরূপ অর্থ-কড়ি ও নানা প্রকার ব্যবহারিক জিনিসপত্র সংগ্রহ করত। এতে করেই মক্কা ও মদীনার অধিবাসীদের মাঝে ব্যবসায়ের ভিত্তিতে জীবন পরিচালনার জোর প্রচেষ্টা আজও অব্যাহত রয়েছে। কুরবানীর অর্থনৈতিক সুফল :
আরব ভূখন্ড বিশেষ করে মক্কার আশপাশে পণ্য উৎপাদন উপযোগী কোনই অঞ্চল ছিল না। সেখানকার উৎপাদন বলতে একমাত্র পশুসম্পদ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এ কারণে কুরবানীর অপরিহার্য কর্মও আরবের অধিবাসীদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার পথ উন্মুক্ত করে দেয়। আরবের বেদুঈন ও গ্রামীণ এলাকার অধিবাসীদের জীবনধারণের একমাত্র অবলম্বন ছিল পশু পালন। পশুসম্পদে সমৃদ্ধ এই লোকজন তাদের পালিত পশুগুলো হজের সময় হাজীগণের নিকট বিক্রয় করার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করত। প্রতি বছর প্রায় এক লাখ লোক হজ করতে মক্কায় আগমন করেন এবং এদের প্রত্যেকেই কুরবানী করেন। এদের মাঝে কেউ একাধিক কুরবানীও আদায় করেন। এই হিসেব অনুসারে প্রতি বছর কুরবানীর জন্য কয়েক লাখ পশুর প্রয়োজন পড়ে। কমের পক্ষে একটি পশুর মূল্য আট টাকা অথবা একটি বরকির মূল্য চার টাকা ধার্য করা হয়। (এই মূল্য বহু আগের। বর্তমানে কুরবানীর মূল্য অনেক বেশী)। তাই সম্ভবত প্রতি বছর দশ লাখ পশুর যোগান দেয়া আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। এভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা পশু ব্যবসায়ীরা এবং বেদুঈনরা অর্জন করতে সক্ষম হয়। তাছাড়া বেদুঈন গোত্রের লোকেরা অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী ও মুরগীর ব্যবস্থাও করত। বিস্তীর্ণ খোলা ময়দানে মুরগী পালন তাদের জন্য খুবই সহজ ছিল। এদিক থেকেও অর্থাগমের ব্যবস্থা ছিল খুবই সহজ। এতে করে পশু বিক্রয়ও খাদ্য সামগ্রী বিক্রয়ের মাধ্যমে পানিশূন্য বিশুষ্ক মুরুবাসীরা এমনকি শহরবাসীরাও লাভবান হত। দারিদ্র্য বিমোচনে এ কুরবানী গোটা-আরবের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার পথ সুগম করার প্রধান উপাত্ত ছিল। লক্ষ করলে দেখা যায় যে, হযরত ইব্রাহীম (সা:)-এর দোয়ার প্রতিফলন মক্কার সর্বত্রই এক বিশিষ্ট মর্যাদার আসন দখল করে আছে। এই দোয়ার ফলেই আরবের অনুর্বর এলাকার লোকেরা বছরের সকল অংশে অভাব অনুভব করার চিন্তাগ্রস্ত হয় না।
দোয়ায়ে ইব্রাহীমীর মাকবুলিয়াত :
হযরত ইব্রাহীম (আ:) স্বীয় দোয়াতে মক্কার অধিবাসীদের জন্য ফলের কথা উল্লেখ করেছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে : “এখানকার অধিবাসীদেরকে ফল দ্বারা রিজিক দান করুন।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৫) এই দোয়ার প্রতিফলন দেখলে অবাক না হয়ে পারা যায় না। লক্ষ করলে দেখা যায় যে, মক্কার বাজারগুলোতে সর্বদাই তরতাজা ফলের সমারোহ থাকে প্রচুর। ফল, তরকারী, সবজির স্ত‚প সর্বত্রই নজরে পড়ে। এর মূলে হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর দোয়াই যে সম্পৃক্ত রয়েছে তা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। এভাবে ব্যবহারিক পণ্যের সম্ভার ও পরিপূর্ণ বিশ্বাসের আস্বাদ সকলের মনকেই আপ্লুত করে তোলে।
ব্যবসা ও তেজারত : কোরআনুল কারীমের পরিভাষায় ‘আল্লাহর ফজল তালাশ’ করার অর্থ হচ্ছে ব্যবসায়, তেজারত ও রুজি হাসিল করা। মহান আল্লাহ পাক হজের একটি প্রকৃষ্ট উদ্দেশ্যে তেজারত ও রিজিক অর্জনের পথকেও নির্ধারিত করেছেন। সূরা মায়িদাতে ইরশাদ হচ্ছে : “এবং তাদেরকে নিগ্রহ করো না, যারা এই মর্যাদাপূর্ণ গৃহের উদ্দেশ্যে গমন করছে এবং যারা স্বীয় প্রতিপালকের ফজল তালাশ করছে।” (সূরা মায়িদাহ : রুকু-১) অর্থাৎ তাদের মাল ও সম্পদ লুণ্ঠন করা জায়েজ নয়। যদি মাল-সম্পদ লুট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে শান্তিপূর্ণভাবে হজ আদায়ের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য। বাহ্যত তেজারত এবং ব্যবসাকে দুনিয়াদারির একটি কাজ বলে মনে হয়। এ জন্য ইসলাম আগমনের পর কোনো কোনো সাহাবি নিজেদের এই খাস ধর্মীয় সফরে তেজারত করাকে অর্থাৎ দুনিয়াদারির উদ্দেশ্য শামিল করাকে পছন্দ করতেন না। তখনই এই আয়াত নাজিল হয় যে, “মানুষের কাছে ভিক্ষা করে হজ করা ভালো নয়। কেননা এটা তাকওয়া ও পরহেজগারীর খেলাপ; বরং ব্যবসা করতে করতে অগ্রসর হও। এটাই উত্তম পন্থা।” ইরশাদ হচ্ছে : “তোমরা পথ খরচ নিয়ে চল। পথ চলার উত্তম সম্পদ হচ্ছে তাকওয়া (ভিক্ষা না চাওয়া)। এবং হে জ্ঞানবানগণ! তোমরা আমাকেই ভয় কর; তোমাদের ওপর কোনোই গোনাহ হবে না, যদি তোমরা স্বীয় প্রতিপালকের ফজল তালাশ করে চলতে থাক (অর্থাৎ ব্যবসা করতে করতে)।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৫)
এই ধারণা যে, “ব্যবসা হচ্ছে দুনিয়ার কাজ, যা দীনের সফরে জায়েজ নয়।” এটা মোটেই ঠিক নয়। প্রথমত, হালাল পন্থায় রিজিক তলব করা ইসলামের দৃষ্টিতে ইবাদত এবং পুণ্যের কাজ। এই পুণ্য থেকে দূরে থাকা মোটেই ঠিক নয়। দ্বিতীয়ত, হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর দোয়া অনুসারে ব্যবসা ও হজের উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ত। হজ আদায়কারী অথবা এর সহায়তা দানকারীদের মাঝে অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে ব্যবসায়িক মনোভাব বিদ্যমান থাকে। তাই মক্কা নগরীর অধিবাসীদের উন্নতি, আবাদি এবং স্থিতিশীলতা ব্যবসা ছাড়া মোটেই সম্ভব নয়। অর্থাৎ হজের একটি উদ্দেশ্য এই যে, খানায়ে কা’বার হেফাজত এবং খেদমতের জন্য এই শহরের বাসিন্দাদের আবাদি ও সৌন্দর্য কায়েম থাকতে হবে। এর বড় উপায় হচ্ছে তেজারত ও ব্যবসা। মূলত এই স্থানটি যেন মুসলমানদের বিশ্বজনীন তেজারত ও কায়-কারবারের প্রাণকেন্দ্র এবং মুসলিম বিশ্বের শিল্পসমূহের বাৎসরিক প্রদর্শনী কেন্দ্র। যার অতীত নমুনা আজও অবিকল অভঙ্গুর রয়েছে। এমন কোনো মুসলিম দেশ রয়েছে কি? যার শিল্পকর্ম পবিত্র মক্কায় দেখতে পাওয়া যায় না? কিন্তু বড়ই আফসোসের বিষয়, বর্তমানকালের মুসলমানগণ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির কথা যেন বেমালুম ভুলে গেছে। যার ফলে কিছু সংখ্যক অমুসলিম দেশের ব্যবসায়িক ক‚ট-কৌশলের ফাঁদে মুসলিম ব্যবসায়ীরা আটকা পড়ে গেছেন বলেই অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়। এরই ফলশ্রæতিতে পরিণাম এই দাঁড়িয়েছে যে, একদিন মক্কা ছিল মুসলিম শিল্পের শ্রেষ্ঠকেন্দ্র এবং সর্বোৎকৃষ্ট প্রদর্শনী, তাই আজ ইউরোপের শিল্পের বাজারে পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই অবস্থার আরও অবনতি হতে চলেছে।
হজের রূহানিয়াত : রূহানিয়াত বলতে ওই সকল প্রভাব-প্রতিক্রিয়া ও অবস্থার কথা বুঝায়, যা এসব স্থান জিয়ারত এবং আরকানে হজ আদায় করার দরুন অন্তর প্রদেশে পয়দা হয়। এর একটি অবস্থা হচ্ছে দেশীয়, দ্বিতীয়টি ঐতিহাসিক এবং তৃতীয়টি হচ্ছে খালেস রূহানী। দেশীয় কথার মর্ম হলো, যদিও মুসলমান দুনিয়ার প্রতিটি দেশেই বসবাস করে, প্রত্যেক ভাষায় কথা বলে এবং হরেক রকম পোশাক পরিধান করে, তবুও তাদের মাঝে এই অনুভূতি বাকি থাকে যে, সে শারীরিকভাবে কোথায় অবস্থান করছে। কিন্তু সবকিছুর সারকথা হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক মুসলমানের আসল নিবাস হলো আরব ভূমি। এখানেই মিল্লাতে ইব্রাহীমির অধিষ্ঠান এবং ইসলামের জন্মভূমি। তাছাড়া কোরআন অবতরণের প্রাণকেন্দ্রও এখানে। এ জন্য দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে, উৎসাহ-উদ্দীপনা ও প্রাণবন্ত ভালোবাসার তাগিদে মানুষ যখন এখানে উপস্থিত হয়, তখন এখানকার পর্বতশঙ্কুল অবস্থা, ধূসর মরুভূমি প্রত্যক্ষ করে ভালোবাসার আবর্তে নিজেকে সমর্পণ করে এবং তাদের অন্তরে ইসলামের জন্মভূমি এবং কোরআনের অবতরণ স্থল পুণ্যভূমির প্রত্যক্ষ দর্শনে এক অভিনব অবস্থার সৃষ্টি হয়। মুসলমানগণ যে যেখানেই থাকুন না কেন তারা দেখা স্থানকে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র ও উৎপত্তিস্থল বলে দেখতে পান না। সকল স্থানেই তারা নিজেদের সাথে অন্যান্য জাতির লোকদেরকেও দেখতে পান। তাদের ধর্মীয় মতাদর্শের পাশাপাশি অন্যান্য মাজহাবের লোকদেরও দেখতে পান। নিজেদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে অন্যদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি অবলোকন করেন। কিন্তু হজের সময় ইসলামকে একই রঙ্গে বিরঞ্জিত দেখা যায়। আগে-পিছে, ডানে-বামে সকল দিকেই ইসলাম একই আকৃতিতে পরিদৃষ্ট হয় এবং সে সময় হেজাজ ভূমি এবং দুনিয়ার সকল দেশের সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিতে এমন মনে হয়, যেমন মাতৃভমিতে নতুন আবাদি গঠনকারীদের মাঝে দেখা যায়। বর্তমানে ইংরেজরা ভারত, ইরাক, মিসর, ফিলিস্তিন, সাইপ্রাস, জিব্রাল্টার, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, উগান্ডা, ট্রান্সওয়াল, জাঞ্জিবার এবং আফ্রিকা ও কানাডার বিভিন্ন অঞ্চলে যদিও বসবাস করছে, তবুও ইংল্যান্ডের ছোট দ্বীপটিই তাদের দৃষ্টিতে এই বিশাল বিস্তৃত শাসিত ও অধ্যুষিত সা¤্রাজ্য, যার মাঝে সূর্যাস্ত যায় না; নিজেদের কেন্দ্র বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। ইংল্যান্ডই তাদের আদি নিবাস, জন্মভূমি ও বাসস্থান। তারা শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, চরিত্র, সাহিত্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের পৈতৃক নিবাস ইংল্যান্ডের অনুসরণ করে। যখনই তাদের দৃষ্টিশক্তি মাতৃভূমি ইংল্যান্ডকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করে, তখন নিজের নির্দিষ্ট এবং নির্মল সভ্যতা, চরিত্র, সংস্কৃতির দেশকে অবলোকন করে আনন্দে, উত্তেজনায় ও খুশিতে উদ্বেল হয়ে ওঠে। তারা এখানকার প্রতিটি গৃহ ও গৃহদ্বারকে ইজ্জত ও সম্মানের চোখে দেখে। এখন তাদের অন্তরে এই অনুভূতির সৃষ্টি হয়, যা অন্যান্য দেশের শ্রেণির, জাতির এবং সভ্যতার মাঝে বসবাস করার কারণে তাদের বিক্ষিপ্ত ও স্তিমিত আত্মিক চিন্তা-গবেষণা ও অকার্যকরী শক্তির উদ্ভাবনের বিপরীতে নতুন উদ্যমে ও নতুন প্রেরণায় সহায়ক শক্তি উদ্ভাবন করে। তাই তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে এখানে আগমন করে নিজেদের খালেস সভ্যতা, সংস্কৃতির পাক-সাফ জীবন প্র¯্রবণে অবগাহন করে পুনরায় সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে একই ধরনের অবস্থা এবং পরিস্থিতি মুসলমানদের মাঝেও পরিদৃষ্ট হয়। তারা তাদেরকে নিজেদের জন্য, নিজেদের মাজাহাবের জন্য, নিজেদের জাতির জন্য, নিজেদের সভ্যতার জন্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও বিদ্যা-বৃদ্ধিতে জন্মভূমি ও অধিষ্ঠান বলে মনে করেন। এদের যখনই কোন ব্যক্তি আরব দেশে গমনের সৌভাগ্য অর্জন করে এবং জিয়ারত করতে সক্ষম হয়, তখন সেখানকার প্রতিটি বালুকণা জিয়ারতকারীদের সাথে মিশে যায় এবং এমনভাবে গ্রথিত হয়ে যায় যে, তারা চিৎকার করে বলে ওঠে, “আমার প্রতিটি পদক্ষেপের কোনো স্থানেও আমি কোনো রকম পার্থক্য নির্ধারণ করতে পারছি না। আমার অন্তরের মণিকোঠায় যে আবেগ প্রবণতা ও অনুকম্পন উত্থিত হচ্ছে, এতে বলা হয়েছে যে, স্থানটিই আমার প্রিয় এবং প্রাণকেন্দ্র।” এই দর্শন ও লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখেই রাসূলুল্লাহ (সা.) এই অসিয়ত করেছেন যে, “আরব দেশে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো মাজহাব, কা’বা ছাড়া আল্লাহর ইবাদতের অন্য কোনও বিকল্প কা’বা-কিবলা এবং আল কোরআন ছাড়া অন্য কোনও সহীফা থাকতে দেয়া যাবে না।” একই সাথে কোরআনুল কারীমে এই ঘোষণা জারি করা হয়েছে যে : “কোনও মুশরিক, কাফির এই মর্যাদাপূর্ণ গৃহের সন্নিকটে যেন আসতে না পারে।” যাতে করে ইসলামের এই উৎস ধারা সকল প্রকার অপবিত্রতা হতে পবিত্র থাকে এবং কুফর ও শিরকের সকল প্রকার নাপাকী হতে মাহফুজ থাকে। যাতে করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে মুসলমানগণ এখানে আগমন করে পবিত্রতা অর্জন করতে পারে এবং ঈমানের প্রাণ বন্যাকে সমুজ্জ্বল করে তুলতে পারে। কোরআনুল কারীম মক্কা মুয়াজ্জমাকে উম্মুল করা অর্থাৎ আবাদিসমূহের মাতা, আসল মানদন্ড, প্রত্যাবর্তন স্থল, শান্তি লাভের স্থল ও আশ্রয়লাভের স্থল রূপে উল্লেখ করেছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন