স্টালিন সরকার : ‘স্যার টিভির খবর দেখেছেন’? ভাড়া নিতে বাসের কন্ডাক্টর জিজ্ঞেস করল। কেন? প্রশ্ন করতেই বললো, ‘ভারতের সঙ্গে নাকি প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছে? স্যার আমরা যুদ্ধ করবো কার সাথে? ওবায়দুল কাদের তো আজও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী দেশবিরোধী কোনো চুক্তি করবেন না’। জবাব দেয়ার আগেই পাশের সিটের যাত্রী মোবাইলে অনলাইনের পত্রিকা খুলে পড়তে শুরু করলেন ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দমোদর দাস মোদির বৈঠক শেষেই দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা, ঋণ, তথ্য-প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ বিভিন্ন বিষয়ে ২২টি চুক্তি ও ৪টি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা’। আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার মতোই খেঁকিয়ে উঠলেন দুই সিট পিছনে বসা ত্রিশোর্ধ যাত্রী। কর্কশ গলায় বললেন ‘প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়নি প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে’। তিনি বাস কন্টাক্টরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘রাজনীতি করোস! ভাড়া কাট?’ শনির আখড়া থেকে বাসে উঠেই দেখি আলোচনা শুরু। যাত্রাবাড়ী অতিক্রমের পর প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে রীতিমতো তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। সবাই উত্তেজিত। ‘আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল’ ‘বিএনপি পাকিস্তানের এজেন্ট’ ইত্যাদি কটূক্তিও কানে আসছে। দু’জন যাত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের সমর্থনে ‘এ সরকার দেশবিরোধী কোনো চুক্তি করেনি’র পক্ষে অবস্থান নিলেও অধিকাংশ যাত্রী ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির তীব্র সমালোচনা করছেন। চীনের সাবমেরিন কেনার পর দিল্লির ঘুম হারাম এবং তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলেন, তিস্তা চুক্তি হলে বাংলাদেশের উপকার হতো। তিস্তার মুলা ঝুলিয়ে রেখে মোদি সবকিছু করে নিলেন। যে ২২ চুক্তি ও ৪ সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে সবগুলো ভারতের স্বার্থে। বাস যাত্রীদের মধ্যকার এ বিতর্কে বিরক্ত হয়ে এক বৃদ্ধা খেঁকিয়ে বললেন, ‘আপনারা এসব নিয়ে ঝগড়া করছেন কেন? দেশবিরোধী চুক্তি হলে তো বিরোধী দল বিএনপি প্রতিবাদ করবে, মাঠে নামবে। বিএনপি কী করে সেটা দেখেই বোঝা যাবে যে চুক্তি হয়েছে তা দেশের স্বার্থে নাকি দেশবিরোধী।’ আওয়ামী লীগকে ৫ জানুয়ারি যারা ক্ষমতায় এনেছে তাদের পক্ষে দলটি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। আর বিএনপি যদি মাঠের কর্মসূচি না দিয়ে শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি ও অফিসের ভিতরে স্টাফ অফিসারের মতো সংবাদ সম্মেলন করে দায় সারে তাহলে বুঝবেন ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’।
শুধু বাসে নয় সর্বত্রই আলোচনার বিষয়বস্তু এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফর। অফিস-আদালত, ট্রেন-বাস, লঞ্চ-স্টিমার হাটে-মাঠ সর্বত্রই ভারত বাংলাদেশের মধ্যকার চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তর্ক-বিতর্ক চলছে। ইলেক্টোনিক্স মিডিয়া ও অনলাইন মিডিয়াগুলোতে এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। টিভির টকশোগুলোতে মূলত প্রধান বিষয় ভারত-বাংলাদেশের চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, বøগ, টুইটার, পাঠক মতামতে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। কেউ তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিস্তার পাড়ের কৃষকের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে পানির জন্য সরকারকে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। কেউ সামরিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের বিরোধিতা করে শ্রীলংকার ও নেপালের সঙ্গে ভারতের এক সময়ের সামরিক চুক্তির ভয়াবহতা তুলে ধরছেন। কেউ প্রশ্ন তুলেছেন ভারত যদি বন্ধু রাষ্ট্র হয় তাহলে কার সঙ্গে যুদ্ধের আশঙ্কা থেকে প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে হলো? কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, চীন বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী। এ চুক্তির পর চীন যদি বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্প পদ্মা ব্রিজসহ অন্যান্য প্রকল্প থেকে দূরে সরে যায় তাহলে কি হবে? কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বাসিয়েছিল দিল্লি। এখন প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারকে সই করে তার প্রতিদান দেয়া হলো। দেশ এখন সিকিমের পথে এগিয়ে যাবে। কেউ প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খানের ‘বাংলাদেশ যেতে চাইলেও ভারত নেবে না; তবে এভাবেই শোষণ করবে’ মন্তব্য তুলে ধরেন। রিফাত নামের একজন লিখেছেন ‘সম্পর্ক একতরফা হয় না’। নিয়াজ লিখেছেন ‘সম্পর্ক বন্ধুত্বের হলে ভারত দাদাগিরি করছে কেন?’ আকাশ আহমেদ লিখেছেন ‘সার্বভৌমত্ববিরোধী কোনো চুক্তি দেশবাসী মানবে না’। সোহেল লিখেছেন, ‘৪৫ বছরেও ভারত বন্ধুত্বের প্রমাণ দিতে পারেনি’। অধিকাংশ মতামত হলোÑ শেখ হাসিনাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে দিল্লিতে এতগুলো চুক্তি করে নেয়ার পর বিএনপি কী করে তা দেখার জন্য অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। বিএনপি যদি শুধুই বিবৃতির মধ্যে দায়-দায়িত্ব শেষ করে তাহলে বুঝতে হবে তারাও ক্ষমতার লোভে দিল্লি তোষণ নীতিতে রয়েছে। শুধু লোক দেখানো ‘বিরোধিতা’ করছে। আর যদি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করে মাঠের কর্মসূচি দেয় তাহলে বুঝবো ওরা প্রকৃত অর্থেই দেশপ্রেমী জাতীয়তাবাদী দল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা, লাইক দেয়া এবং মন্তব্য করার ক্ষেত্রে অধিকাংশেরই মতামত হলো দেশের মানুষকে না জানিয়ে এ ধরনের চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা নতজানু মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। তাদের বক্তব্য বন্ধুত্ব অর্থ এই নয় যে ভারত যা করার নির্দেশ দেবে তাই বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হবে? গতকালই বাম দল, ইসলামী ধারার কিছু রাজনৈতিক দল ও ছোট ছোট কয়েকটি দল ঢাকা-দিল্লির এসব চুক্তি ও সমঝোতা ভারতের স্বার্থে হয়েছে মন্তব্য করে এগুলো দেশবাসী মানবে না দাবি করে বিবৃতি দিয়েছেন। টিভির টকশোতেও আওয়ামী লীগের অনুগত কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবী দাবি করছেন ২২ চুক্তি ও ৪ সমঝোতা স্মারকের প্রায় সবগুলোই ভারতের স্বার্থে। শুধু তিস্তা পানি ছিল বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা। সে চুক্তির মুলো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বহুমুখী সম্পর্ক। অনেকগুলো চুক্তি হবে; তিস্তা চুক্তি না হলে তাতে কিছু আসে যায় না’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর এমন মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, এরাই আমাদের জনপ্রতিনিধি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্য নিয়ে বিবিসিতে তীব্র বিতর্কের কথাও উল্লেখ করেন একজন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে ২২ চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে সরকার বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। জনগণকে অন্ধকারে রেখে প্রতিরক্ষা চুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে অনির্বাচিত শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতাকে পোক্ত করা’। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তিস্তার পানিসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়, সীমান্ত হত্যা বন্ধ এবং বাণিজ্য বাধা অপসারণ। এগুলোর সমাধান না হলে প্রতিরক্ষা চুক্তি/সমঝোতা কোনোটাই গ্রহণযোগ্য হবে না।’ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সমালোচনার জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুল মাঝে মাঝে অন্ধকারে ঢিল ছোড়েন। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে গোপন করার কিছু নেই। ভারতের সঙ্গে চুক্তি হবে বাংলাদেশের জনগণের জন্যই। জনগণের জন্য চুক্তি করে গোপন রাখার কাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করবেন না’। বিএনপির কঠোর সমালোচনা করে একজন লিখেছেন, ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। বিশুদ্ধ পানিতে টলোমলো মেঘের পুঞ্জকে ভাবে আগুনের গোলা। বিএনপি একে তো ক্ষমতার বাইরে আছে দশ বছর। দেশীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক কূটনীতি সবখানেই বল্গাহীন সাফল্য আওয়ামী লীগের। প্রধানমন্ত্রী দিল্লি গিয়ে যা নিয়ে এলেন তাতে দুই দেশের সম্পর্ক আরো উঁচুতে উঠেছে। শূন্য পকেট হাতড়াতে থাকা বিএনপি তাই কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। কিছু দিন আগেও তারা তেলের হাঁড়ি নিয়ে দিল্লি দৌড়াতে ব্যস্ত ছিল; বিজেপি নেতা অমিত শাহের পায়ে তেল মেখেছে সেই দলই এখন নিজেদের অবস্থান ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে ভারতবিরোধী লাগামহীন গীবত গাইতে শুরু করেছে’। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক ব্যক্তিরা বিএনপিকে এরকম যতই দোষারোপ এবং তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক না কেন; সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দেখতে চায় ঢাকা-দিল্লির এই চুক্তিকে দেশবিরোধী হিসেবে অবিহিত করলেও বিএনপি আসলে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কারণ জাতীয় স্বার্থ এবং দেশের সার্বভৌমত্বকে গুরুত্ব দিয়ে রাজনীতি করা এবং শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল হিসেবে মুখে দেশপ্রেমের থুবড়ি ফোটানো এক জিনিস নয়। বামধারা কয়েকটি দল ও ইসলামী ধারার একাধিক দলের নেতার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বললে তারা বলেন, আমরা ছোট দল। আমরা যাই বলি পত্রিকা ছাপে না প্রতিক্রিয়া হয় না। বিএনপি যদি এ চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তাহলে মিডিয়াগুলো সে খবর প্রচার করবে; দেশের মানুষ প্রতিবাদী হবে। আমরাও তখন ঘরে বসে থাকতে পারব না। বিএনপি কী করে আমরা সেটা দেখার অপেক্ষায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন