শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

দিক দর্শন : সামাজিক ন্যায়-বিচারে রাসূলুল্লাহ স.-এর শিক্ষা

প্রকাশের সময় : ৩ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এভাবে পরামর্শের ভিত্তিতে বিভিন্ন কাজের সিদ্ধান্ত নেয়া তাঁর কর্মের একটি মূলনীতি ছিল।
তবে যে সব কাজ ওহী দ্বারা পরিচালিত হত তা তিনি ওহীর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালনা করতেন।
মুসলিম রাষ্ট্রে রাসূলুল্লাহ স.-এর শাসনাধীনে অমুসলিমরা করলেও তাদের সাথে তিনি কখনো অন্যায় করেননি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজে অমুসলিমরা পূর্ণ অধিকার ভোগ করতো। তিনি নিজে যেমন সাথে ন্যায়বিচার করতেন তেমনি অন্যদেরও তাদের সাথে ন্যায় আচরণের নির্দেশ দিতেন। বিচারের ক্ষেত্রে তিনি তাদের ধর্মীয় মতাদর্শ, ব্যক্তি মর্যাদা বা বংশ মর্যাদা কোনটার দিকে ভ্রƒক্ষেপ করতেন না। যদিও হকের অধিকারী অমুসলিম ব্যক্তিটি মুসলিমদের নির্যাতন করে থাকুক। তিনি আল-কুরআনের নিন্মোক্ত আয়াতের দিকে লক্ষ্য রাখতেন, আর যদি বিচার কর তবে তাদের মধ্যে সুবিচার করা। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন। অমুসলিম বা যাদের সাথে কোন বিষয়ে চুক্তিবন্ধ, তাদের হক আদায়ের ব্যাপারে তিনি তাঁর সাহাবীদের খুব তাগিদ দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে প্রায় ত্রিশটির বেশি হাদীস পাওয়া যায়। যেমন রাসূলুল্লাহ বলেন-সাবধান! যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তির ওপর, জুলুম করবে বা তার হক কম দিবে অথবা তার সামর্থ্যরে বাইরে বোঝা চাপিয়ে দিবে কিংবা অন্যায়ভাবে তার সামান্যতম হক নিয়ে নিবে, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য বিবাদ করবো। এছাড়া তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোন চুক্তিবদ্ধ হত্যা করবে আল্লাহ তার ওপর জান্নাত হারাম করে দিবেন। মক্কা বিজয়ের পর রাসূল ও তাঁর সাহাবীরা হুনাইনের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ছাফওয়ান ইবন উমাইয়্যাহ তখনো মুশরিক ছিলেন। তিনি ছিলেন মক্কার বড় অস্ত্র ব্যবসায়ী। তাঁর কাছে অনেক অস্ত্র ছিল। যুদ্ধের জন্য রাসূল-এর কিছু ঢালের প্রয়োজন হলো। তিনি ছাফওয়ানকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কাছে কোন অস্ত্র আছে? ছাফওয়ান বললেন, না বরং কর্জ নেব। অতঃপর ছাফওয়ান রাসূলুল্লাহ স. কে ৩০-৪০ টি ঢাল ধার দিলেন। রাসূল স. যুদ্ধ করলেন। মুশরিকরা পরাজিত হলো।
এরপর ছাফওয়ানের ঢালগুলো একত্রিত করা হলো। এর মধ্যে কয়েকটি ঢাল হারিয়ে গেল রাসূল স. তাঁকে বললেন, আমরা তোমার কয়েকটি ঢাল হারিয়ে ফেলেছি। আমরা কি তোমাকে জরিমানা দিবো? তিনি বললেন, না ইয়া রাসূলুল্লাহ। কেননা আজকে আমার অন্তরে এমন জিনিস আছে, যা সেদিন ছিল না। নিজের বিজয় করা এলাকার একজন মুশরিকের কাছ থেকে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জোর করে একটি অস্ত্রও নিলেন না। এমনকি তা থেকে কয়েকটি হারিয়ে গেলে নিজ থেকেই জরিমানা দিতে চাইলেন। অথচ আজকে আমরা দেখতে পাই, ক্ষমতার জোরে মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নেয়া হচ্ছে। সবকিছু হারিয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছে। আব্দুর রহমান ইবন আবি বকর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমরা রাসূলুল্লাহ স.-এর সাথে ১৩০ জন লোক ছিলাম। (সবাই খুব ক্ষুধার্ত ছিল)। রাসূল স. বললেন, তোমাদের কারো নিকট কোন খাবার আছে? একজনের কাছে এক ‘ছা’ পরিমাণ খাবার ছিল। সেটা মেশানো হলো।
অতঃপর একজন মুশরিক একদল বকরী হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। রাসূল স. তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটি বিক্রির জন্য নাকি দানের মুশরিক বললম না বরং এটি বিক্রির জন্য। অতঃপর তিনি তার থেকে একটি বকরী ক্রয় করলেন। অতঃপর সেটি প্রস্তুত করা হলো। প্রচ- ক্ষুধাসহ ১৩০ জন সাহাবী নিয়ে তিনি একজন মুশরিককে একাকী পেয়েও তার সম্পদ জোর করে কেড়ে নিলেন না। এভাবে ইসলামের বিজয়ের দিনেও তিনি সংখ্যালঘুদের সাথে সামান্যতম অন্যায় আচরণ করেননি। তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে কোন কার্পণ্য ও অন্যায় হস্তক্ষেপ করেননি। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমরা নিম্নের ঘটনা থেকে জানতে পারি,
জাবির ইবনু ‘আবদিল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, তাঁর পিতা একজন ইহুদীর কাছ থেকে নেয়া ত্রিশ ওয়াসাক খেজুর ঋণ রেখে ইন্তিকাল করেন। ঋণ পরিশোধের দিন আসল। কিন্তু জাবির রা, তখন ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম ছিলেন না। এ জন্য তিনি ইহুদির কাছে সময় চাইলেন। কিন্তু সে সময় দিতে অস্বীকার করলো এবং তাকে নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে চাপ দিলো। তখন রাসূলুল্লাহ স. তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করলেন। তিনি ইহুদীকে অনেক কথা বলে দেয়ার জন্য সুপারিশ করলেন। কিন্তু সে একবারেই অস্বীকার করল এবং বলল : ‘হে আবুল কাসেম’ আমি তাকে সময় দেবো না। রাসূলুল্লাহ স. তখন ইহুদীর মদীনায় বসবাসের অবস্থার দিকে তাকালেন না, তিনি মুসলিমদের সাথে ইহুদীদের শক্রতার বিষয়েও নজর দিলেন না। বরং তিনি দেখলেন যে, হক ইহুদীর এবং সেটাকে আদায় করা ওয়াজিব। তিনি ইহুদীর সাথে ন্যায়বিচার করলেন। তাকে তার ঋণ পরিশোধ করে দিলেন। এই সম্মানিত সাহাবীর সাথে রাসূলের স. যে ঘনিষ্ঠতা ছিল সে দিকে রাসূলুল্লাহ স. ভ্রুক্ষেপ করলেন না। বরং তিনি শরীয়তের বিধানের দিকে খেয়াল রাখলেন। আল-কুরআনের এই আয়াতের বিধানের দিকে লক্ষ্য রাখলেন, ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো! তোমাদের নিজেদের কিংবা পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের বিপক্ষে গেলেও তোমরা আল্লাহর (পক্ষে) সাক্ষী হিসেবে ন্যায়ের উপর অটল থাকবে। (সাক্ষ্য যার বিরুদ্ধে যাবে) সে ধনী হোক কিংবা গরিব হোক আল্লাহ্ই উভয়ের ভাল রক্ষক। অতএব তোমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, পাচ্ছে (ন্যায় থেকে) বিচ্যুত হও। আর যদি তোমরা (সাক্ষ্য) ঘুরিয়ে দাও কিংবা এড়িয়ে যাও তাহলে (জেনে রাখবে) তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তা অবগত আছেন। এটাই ছিল রাসূলুল্লাহ স.-এর ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত। কিন্তু আজকের পৃথিবীর দিকে তাকালে আমরা ঠিক এর ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। দখলদার বাহিনী একের পর এক দেশ ধ্বংস করছে। তাদের জান-মাল নষ্ট করছে। যমিনে ফিতœা-ফাসাদ সৃষ্টি করছে। কোন ন্যায়-অন্যায় বিচার করছে না। একই দেশের মধ্যে ক্ষমতাশালীরা ভিন্ন মতাবলম্বীদের উপর একই ধরনের অত্যাচার করছে। অন্যায়ভাবে বিরোধীদের সম্পদ দখল করে নিচ্ছে। তাদের জান-মালের ক্ষতি সাধন করছে। সামাজিক ন্যায়বিচার বলতে তেমন কিছু যেন অবশিষ্ট নেই। ক্ষমতা থাকলে সবকিছু করা বৈধ মনে করা। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রাসূলুল্লাহ স. শরীয়তের বিধান বাস্তবায়নের পাশাপাশি সকলকে পরকালীন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেন এবং পরকালীন জবাবদিহিতার ব্যাপারে সতর্ক করতেন। পরকালীন পুরস্কারের ঘোষণার সাথে সাথে কঠিন আযাবের ভয় দেখাতেন। যাতে মানুষের পরকালের কল্যাণের আশায় দুনিয়ার ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে পারে। যেমন তিনি বলেছেন-তোমরা প্রত্যেক দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককে তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে।
ইমাম দায়িত্বশীল এবং তাকে তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে, ব্যক্তি তার পরিবারের দায়িত্বশীল এবং তার দায়িত্বশীল ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে, স্ত্রী তার স্বামীর সংসারের দায়িত্বশীল এবং তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে, খাদেম তার মনিবের মালের দায়িত্বশীল এবং তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে এবং তোমরা প্রত্যেক দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককে তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। এছাড়া তিনি আরো বলেন, আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিলে সে যদি এমন অবস্থায় মারা যায় যে, সে তার দায়িত্বের খেয়ানতকারী, তাহলে তার ওপর আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিবেন। পরকালীন চেতনা বেশি করে জাগ্রত করতে এবং সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ স. জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। বিশেষ করে সমাজের দুর্বল শ্রেণির ওপর ক্ষমতাবানদের জুলুমের ব্যাপারে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তাই সেটা গরিবদের ওপর ধনীদের জুলুম হোক, অথবা শাসিতের ওপর শাসকশ্রেণির জুলুম হোক। অত্যাচারিত ব্যক্তি যত বেশি দুর্বল হবে অত্যাচারীর অপরাধ ততই বড় হিসেবে গণ্য হবে।
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন-হে আমার বান্দা! আমি জুলুম করাকে নিজের উপর হারাম করেছি এবং এটাকে তোমাদের মধ্যেও হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পর জুলুম করো না। রাসূলুল্লাহ স. একবার মু‘আয় রা. কে বললেন, তুমি মাজলুমের ফরিয়াদ থেকে বেঁচে থাকো। কারণ তার ও আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা থাকে না। তিনি জুলুমকারীর প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন- নিশ্চয় মহান আল্লাহ তাদের শাস্তি দিবেন যারা দুনিয়ার মানুষদের শাস্তি দিবে। তিনি আরো বলেন-তিন ব্যক্তির দু’আ ফিরিয়ে দেয়া হয় না। ন্যায়পরায়ণ নেতা, আর রোযাদার যখন ইফতার করে এবং মাজলুমের দু’আ।
আল্লাহ এটাকে মেঘের উপর উঠিয়ে নেন এবং এর জন্য আসমানের দরজা খুলে দেন। আর প্রভু ঘোষণা করেন, আমার উজ্জতের কসম! আমি অবশ্যই অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব, যদিও তা পরে হয়। এর পাশাপাশি তিনি ন্যায়বিচারকের মর্যাদা সম্পর্কে বলেছেন-দুনিয়ার সুবিচারকারীরা তাদের সুবিচারের কারণে কিয়ামতের দিন মহান দয়াময়ের ডান পার্শ্বে নূরের মিম্বারে অবস্থান করবে।
উপযুক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ স. -এ দাওয়াতী জীবনের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল, আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে এমন এক ইনসাফপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণ করা, যেখানে প্রত্যেক নিজ নিজ অধিকার ভোগ করবে সাথে সাথে অপরের অধিকার আদায়ে অগ্রগামী হবে। কোন রকম জুলুম-নির্যাতনের আশ্রয় নেবে না। আর এ কাজে তিনি মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি যেমন শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তেমনি সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্যও সংগ্রাম করেছেন। আর এটা সম্ভব করেছিলেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এক সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে। তিনি শরীয়তের বিধান পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করেছিলেন এবং এ ক্ষেত্রে কোন রকম পক্ষপাতিত্ব করেননি। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, সম্পদের সুষম বণ্টনব্যবস্থা, জীবন সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, সকলের স্বাভাবিক স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তিনি সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা আনয়ন করেন। সর্বোপরি তিনি সকলকে পরকালীন চেতনায় জাগ্রত করেন। আখিরাতের কঠিন আযাবের ব্যাপারে সতর্ক করেন এবং চিরস্থায়ী জান্নাতের দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দেন। বিশ্বে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য সকলকে অবশ্যই রাসূলুল্লাহ স.-এর শিক্ষা সমাজের প্রতিটি স্তরে বাস্তবায়ন করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন