এ, কে, এম, ফজলুর রহমান মুন্্শী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বিশেষ করে শুহাদাদের সম্পর্কে নির্দেশ এসেছে যে, তারা সবুজ শ্যামল পাখির আকৃতির হবেন এবং আরশে ইলাহির ঝাড়বাতিগুলোই হবে তাদের আস্তানা। অনুরূপভাবে দোজখ এবং জান্নাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যে সত্য স্বপ্ন উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, এতে যে সকল দৈহিক আকৃতির মাঝে গোনাহগারদের শাস্তি ও কষ্টের চিত্র দেখানো হয়েছে এর সব কটিই মিছালী বা রূপক। এ কথা সুস্পষ্ট যে, সৌভাগ্যবান মুমিনদের এবং শহীদদের সেই রূপক চিত্র এবং গোনাহগারদের এই রূপক দেহ তাদের সেই দেহ এবং শরীর নয়, যা তাদের কবরসমূহে পচেগলে শেষ হয়ে গেছে। কিংবা তা আগুনে জ্বলে ছাই হয়ে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণাসম বাতাসে মিশে গেছে। কিংবা কোনও জানোয়ারের পেটে গিয়ে তার দেহের অংশে রূপান্তরিত হয়েছে।কোনো কোনো হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) হতে “মাটির এই কবরসমূহে আজাবের সাদৃশ্যাত্মক শ্রæত ঘটনাবলির উল্লেখও রয়েছে।” তবে এ কথা সুস্পষ্ট যে, বস্তুভিত্তিক ভাষা ও দৃশ্যাবলীর মাঝে ঐ সকল সম্প্রদায়ের নিকট যারা মৃতকে মাটিতে দাফন করে এই উদ্দেশ্যের স্মরণিকা কিছুই নয় যে, এই দেহটি মাটির ঢেলা বা স্তূপই মাত্র। যার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা যায়। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে এই যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সহীহ তাফসীর থাকা সস্তে¡ও অন্য কোন দলিল প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না।
তবুও সতর্কতামূলখ আরজ এই যে, এই আয়াতে ঈমানদারগণের আখেরাতে কাওরে সাবিত বা মজবুত কথার উপর দৃঢ়পদ রাখার কোশ-খবরী প্রদান করেছেন। তবে কথা সুস্পষ্ট যে, এই ‘আখেরাত দ্বারা কিয়ামত এবং বেহেশত ও দোযখের দিন উদ্দিষ্ট হতে পারে না। কেননা সে দিনটি তো গোপন ভেদ উন্মুহবার দিন। সেদিন অবিশ্বাসী কাফিরও সেই মজবুত কথা হতে প্রত্যাবর্তনের সাহসটুকু খুঁজে পাবে না। তারপর এটা ঈমানদারদের জন্য নির্দিষ্ট কোন শুভ সংবাদও হতে পারে না। এমনকি এটা ইহসান প্রকাশের উপযুক্ত সময়ও হতে পারে না। তবে এই খোশ-খবরী এবং ইহসানের ঘোষণা প্রকাশ আখেরাতের ঐ অংশে হওয়াটাই স্বাভাবিক, যেখানে প্রচ্ছন্ন আবরণের গোপন রহস্যাবলীর নেকাব উন্মোচিত হয় না। আর এটাই হচ্ছে, ‘আলমে বরযখের’ ব্যাপার। তবে এই পবিত্র আয়াতের সহীহ হাদীস প্রসূত তাফসীর দ্বারা এ কথাও সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, আখেরাতের বিস্তৃত পরিমন্ডলের মাঝে ‘আলমে বরযকের’ ময়দান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মূলতঃ আলমে বরযকের এই সওয়াল-জওয়াব কোন নতুন ঘটনা হবে না; বরং প্রতিটি রূহের প্রাথমিক জিন্দেগীর ঈমানী অবস্থার স্বীকৃতি এবং অস্বীকৃতির উদাসীনতা দূরীভূত হবে। কিংবা কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, “আজকের আয়নায় আগামীকারের চিত্র বিকশিত হবে” মোটকতা, স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতির যে অবস্থা ধারণ করে দুনিয়ার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে, হুবহু তারই প্রতিরূপ সওয়াল এবং জওয়াবের সময় পরিস্ফুট হবে।
বরযখ এবং রূহের নিবাসঃ
সর্বশেষ প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, মৃত্যু এবং কিয়ামতের মধ্যবর্তী মঞ্জিলে (বরযখ) মানুষের রূহসমূহের অবস্থান কোথায় হবে? কুরআনুল কারীমে এর উত্তর বিভিন্ন আয়াতে দেয়া হয়েছে। সর্বপ্রথম আয়াতটি হলো উল্লেখিত আয়াতসমূহের পরবর্তী আয়াত। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফেরেশতাগণ যখন অস্বীকারকারীদের সওয়াল-জওয়াব শেষ করবেন, তখন আল্লাহ পাক রূহসমূহকে হুকুম করবেন, তারা যেন স্বীয়-সাথীদের সাথে শাস্তিময় আগুনে প্রবেশ করে। তারপর আল কুরআনে আরও উল্লেখ্য করা হয়েছেঃ “অবশ্যই যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যারোপ করেছে এবংতা মেনে নিতে অহঙ্কার করেছে, তাদের জজন্য আকাশসমূহের দ্বার খোলা হবে না, এমনকি তাদেরকে জান্নাতেও প্রবেশ করানো হবে না, যতক্ষণ না সূচের ছিদ্র পথে উট গমন করতে পারে (অর্থাৎ তা কখনো সম্ভব নয়)”। (সূরা আ’রাফ রুকু-৫) এই আয়াতের দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহর নির্দেশাবলী অস্বীকারকারী এবং মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদের রূহসমূহ মৃত্যুর পর কখনো আসমানী বাদশাহীর সীমানায় কদম রাকতে পারবে না বেং এগুলো জমিনের উপর উন্মুক্ত স্থানে উদাসীনভাবে ঘুরতে থাকবে। কিংবা নিজেদের মাটির দেহের সম্পর্কের কারণে, যেখানে তাকে দাফন করা হয়, সেই মাটির সাথেই সে আবর্তিত হতে থাকবে এবং সেখানে রেখেই তাকে দোযকের চিত্র দেখানো হবে। একানে অবস্তানকালেই সে বেদনার ভার বইতে তাকবে। পক্সান্তরে পবিত্র দেম মু’মিন ব্যক্তি রূহের অবস্তা এই হবে যে, মৃত্যুর সাথে সাথেই রহমতের ফেরেশতা বরং স্বয়ং জবানে রহমত তার কানে এই ধ্বনি উত্থিত হরেনঃ “হে প্রশান্ত রূহ! তুমি স্বীয় প্রতিপালকের কাছে চলে যাও, এমতাবস্থায় যে, তোমার প্রতিপালক তোমার প্রতি সন্তুষ্ট এবং তুমিও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট; সুতরাং তুমি আমার প্রকৃত বান্দাহদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর”। (সূরা ফাজর রুকু-১) এদের থেকেও অগ্রবর্তী অবস্থানে ঐ সকল পবিত্র রূহ অবস্থান করবে, যারা নিজেদের মাটির দেহসমূহ ধ্বংসশীল জীবনকাল, উপাদান ভিত্তিক আমোদ-স্ফুর্তি এবং ক্ষয়িষ্ণু সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবান করেছে। তাই তাদেরকে আল্লাহ পাকের তরফ হতে একটি সাদৃশ্যমূলক দেহ, অভঙ্গুর জিন্দেগী এবং রূহানী সুখ-স্বচ্ছন্দ্য ও চিরস্থায়ী দৌলত সে সময়ই প্রদান করা হয়। ইরশাদ হচ্ছেঃ “যারা আল্লাহর পথে মারা যায়, তাদেরকে তোমরা মৃত বলে সম্বোধন করো না, তারা জীবিত , কিন্তু তোমরা তাদের অবস্থা অনুধাবন করতে পার না।” (সূরা বাকারাহঃ রুকু-১৯) এই আনন্দপূর্ণ ও সুখময় জিন্দেগী কি ধরনের হবে, এর বিস্তৃত বিবরণও অন্য সূরায় এভাবে বিবৃত হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছেঃ “তুমি আল্লাহর পথে নিহতদেরকে মৃত বলো না; বরং তারা স্বীয় প্রতিপালকের নিকট জীবিত এবং তাদেরকে আহার্য প্রদান করা হয়। আল্লাহ পাক স্বীয় মেহেরবানী হতে যা কিছু তাদেরকে প্রদান করেছেন, তাতেই তারা সন্তুষ্ট এবং যা কিছু তাদের পেছন দিক হতে এখনো তাদের নিকটে পৌঁছেনি তার প্রতিও তারা সন্তুষ্ট। তাদের জন্য কোন ভয়-ভাবনা নেই এবং তারা চিন্তান্বিতও হবে না।
তারা আল্লাহর দয়া ও অনুকম্পায় সার্বিকভাবে সন্তুষ্ট। অবশ্যই আল্লাহ পাক ঈমানদারদের মজদুরী বিন্ষ্ট করেন না।” (সূরা আলে ইমরানঃ রুকু-১৭) এই আনন্দঘন জিন্দেগী শহীদগণ লাভ করবেন। এই জিন্দেগীর মাকাম আল্লাহর সন্নিকটে বলা হযেছে। সহীহ হাদীসসমূহে এসেছে যে, “এই জিন্দা শহীদগণের রূহ দৈহিক পরিবেষ্টনী হতে মুক্ত হয়ে যখন উড়তে থাকে, তখন তারা সবুজ পাখীর আকারে জান্নাতে পরিভ্রমণ করতে থাকে এবং আরশে ইলাহীর ঝাড় বাতিগুলোতে তারা বাসা বাঁধতে থাকে।” এরপর অবশ্যই প্রত্যেক সঠিক বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি স্বীকার করবেন যে, আম্বিয়ায়ে কেয়ামের রূহানী পদমর্যাদা ও ফযলীত,শহীদগণের চেয়ে অকেকাংশে বেশী হবে। এজন্য তাদের মাকামও সে পবিত্র পরিসীমার মাঝেই হবে। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ)মি’রাজ ভ্রমণ প্রাক্কালে এবং স্বীয় সত্য স্বপ্নের মাঝে কোন কোন পয়গাম্বরকে আসমান এবং জান্নাতের বিভিন্ন অধিষ্ঠানে অবলোকন করেছিলেন। তাছাড়া আরও এমন কিছু সৌভাগ্যবান রূহ রয়েছে, যারা দেপঞ্জির পরিত্যাগ করে ফেরেশতাদের দলে মিশে যায়। যেমন হযরত জাপর তাইয়্যার (রাঃ) সম্পর্কে হাদীস শরীফে এসেছে যে, তিনি শাহাদত বরনের পর স্বীয় দু’বাহ সঞ্চালন করে আলমে মালাকুতে ফেরেশতাদের সাথে পরিভ্রমণ করছিলেন। আলমে বরযখে এই সঞ্চালনকারী বাহু মূলতঃ তার সেই শারীরিক বাহু নিচয়ের সাদৃশ্যাত্মক উপমা মাত্র। যা এই যুদ্ধে তার দেহ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি এর পরেও অবশিষ্ট বাহুর দ্বারা ইসলামের ঝান্ডাকে গর্দানের সাহায্যে উড্ডীন রেখেছিলেন। তবে এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই যে, আল কুরআনের এই আয়াত এই শ্রেণীর লোকদের মাঝেই হয়ত নাজিল হয়েছিল। ইরশাদ হচ্ছেঃ “অবশ্যই যারা স্বীকার করেছে যে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ।
তারপর এতেই দৃঢ়পদ তাকে তাদের কাছে ফেরেশতাগণ এই খোশ-খবরী শ্রবণ কর, যার অঙ্গীকার তোমাদের সাথে করা হয়েছিল। আমি দুনিয়ার জীবনেও তোমাদের বন্ধু এবং আখেরাতের জীবনেও।” (সূরা হা-মীম আস সাজদাহঃ রুকু-৪) এই খোশ-খবরীর আওয়াজ এবং ফেরেশতাদের বন্ধুত্ব প্রকৃতপক্ষে আলমে বরযকের চিত্তাকর্ষক অবস্থানেই প্রতিফলিত হয়। একটি সহিহ হাদিসে সেই পুণ্যবান লোকটির উল্লেখ আছে, যে আল্লাহর ভয়ে এই অসিয়ত করেছিল যে, মরার পর যেন তার দেহটি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং আল্লাহর দরবারে হাজির করা সম্ভব না হয়। কিন্তু পরম কৌশলী আল্লাহপাক তাকে দেহাকৃতি দান করে উত্থিত করেছিলেন এবং তার যাবতীয় অপরাধ ক্ষমা করে তাকে বিভিন্ন পুরস্কারে পুরস্কৃত করেছিলেন। (সহিহ বুখারী : ২ খ: ৫৫৯ পৃ.)
সওয়াল এবং জওয়াব :
সহিহ হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে, “মরণের পর কবরে দুজন ফেরেশতা আগমন করেন এবং তারা তাওহীদ ও রিসালাত সম্পর্কে মৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।” এই কথার সত্যতা এই আয়াতের দ্বারাও প্রতিপন্ন করা যায়। ইরশাদ হচ্ছে : “যাদেরকে ফেরেশতা (গোনাহ হতে) পাক-সাফ অবস্থায় জান কবজ করেন, তখন বলেন, তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, তোমরা কোন বিশ্বাসের ওপর ছিলে? তারা উত্তর করেছিল : আমরা দেশে বন্ধুহীন ও সহায়তাকারিহীন অবস্থায় ছিলাম। ফেরেশতাগণ বলবেন, “তবে কি আল্লাহর জমিন প্রশস্ত ছিল না? যেমন তোমরা হিজরত করে অন্যত্র গমন করতে পার। সুতরাং তাদের ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম।” (সূরা নিসা : রুকু-১৪)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন