দীর্ঘ ২৫ বছর ছাত্র প্রতিনিধিহীন বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট : ডাকসু বাবদ জমা হয়েছে প্রায় ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ব্যয় হচ্ছে অন্যান্য খাতে : ছাত্র সংগঠনের নেতাদের কারনেই বিলম্বিত হচ্ছে ডাকসু নির্বাচন -ভিসি
এহসান আব্দুল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ তথা ডাকসুর যাত্রা শুরু হয় ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে। ডাকসু প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচন হয় ৩৬ বার। স্বাধীন বাংলাদেশে ডাকসু নির্বাচন হয় ৬ বার। সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদের আমলে। অথচ গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনকারী এ সংগঠনটি স্বৈারাচার পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারের আমলগুলোতে আজ পর্যন্ত দেখেনি কোন নির্বাচনের মুখ। মাঝে মাঝে ফাঁকা বুলির মতো কিছু আশ^াস নিয়েই ‘ডাকসু’ নির্বাচনের স্বপ্ন বারবার হতাশায় মিলিয়ে যাচ্ছে।
সর্বশেষ গত ৪ই মার্চ বিশ^বিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি ও বিশ^বিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর আব্দুল হামিদ তার বক্তব্যে ‘ডাকসু ইলেকশন ইজ মাস্ট’ এভাবে কোট করে বলার পর শুরু হয় কিছু তোড়জোড়। ভিসি সহ বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলো ভাবতে শুরু করে বহুল প্রত্যাশিত এই নির্বাচন নিয়ে। ক্যাম্পাসে একাধিপত্ব কায়েম করা ছাত্রলীগও মাথা ঘামানো শুরু করে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের পরিকল্পনা সাজানোর উদ্যোগ নেয় ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।
ভিসি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বলতে থাকেন ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আমাদেরও চিন্তা ভাবনা ছিল, এখন যেহেতু রাষ্ট্রপতি বলেছেন আমরা এই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে দেখছি।
এর আগে ২০১৫ সালের ১১ই জুন ঢাবি ছাত্রলীগের সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও জানতে চান ডাকসু নির্বাচন বন্ধ কেন? ডাকসু নির্বাচন থাকলে আমরা গত ২৫ বছরে ২৫ জন ভিপি-জিএস পেতাম। সেসময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভয়ের কারন ও জানতে চান।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র আসাদ জামান ইনকিলাবকে বলেন, আমার মনে হয় এটা একটা প্রবঞ্চনা ছাড়া কিছুইনা। আসলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চাননা ডাকসু নির্বাচন হোক। তাই তারা আমাদের মাঝে তাদের স্বভাবসূলভ ভাবেই এসব ফাঁকা বুলি আওড়ান। শিক্ষকরা এখন আর আগের মতো ছাত্রদের অধিকার নিয়ে মাথা ঘামাননা, তারা ব্যস্ত শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে। আর ছাত্র নেতৃবৃন্দও তাদের দখলদারিত্ব হারানোর ভয়ে শুধু উপরেই ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে কথা বলে যান বাস্তবে তারা তা চাননা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী ইনকিলাবকে বলেন, বিশ^বিদ্যালয়ের বাণিজ্যিকীকরণে ডাকসু নেতৃবৃন্দ বাধা প্রদান করতে পারেন বলেই তিনি এই বিষয়ে শুধু আশ^াসই দিয়ে যান কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোন উদ্যোগ হাতে নেননা।
ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ ও সাবেক জিএস মোশতাক হোসাইন এবং বর্তমান ছাত্র জাফরুল হাসান নাদিমের এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মোহাম্মদ সাইফুর রহমানের একটি বেঞ্চ গত ১৯ মার্চ একটি রুল জারি করে। রুলে ‘নির্ধারিত সময়ে কেন ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেয়া হবেনা’ এবং ‘গত ২৬ বছরে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিষ্কৃয়তা কেন বেআইনী ঘোষণা করা হবেনা’ তা জানতে চাওয়া হয়। এবং চার সপ্তাহের মধ্যে বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও রেজিস্ট্রার সহ বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। নির্ধারিত চার সপ্তাহ সময় পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত দেয়া হয়নি সে রুলের জবাব। এরই প্রেক্ষিতে গত ২১ই এপ্রিল ‘ঐক্যবদ্ধ ছাত্র সমাজ’ নামে একটি সংগঠন ডিআরইউ তে এক সংবাদ সম্মেলনে ডাকসু নিয়ে ভিসির কথা না রাখার অভিযোগ তোলে। তারা বলেন ভিসি তার মেয়াদের শুরু থেকেই নানা বিষয়ে কথা দিয়েও তা রাখেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা অধ্যাদেশ-১৯৭৩ এর আর্টিকেল ২০ (১) (এম) অনুযায়ী সিনেটে ছাত্র সংসদের নির্বাচিত পাঁচজন প্রতিনিধি থাকার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় দীর্ঘ ২৫ বছর এ আসনগুলো ফাঁকা পড়ে রয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্তেই থাকেনা ছাত্র-ছাত্রীদের মতামতের কোন প্রতিফলন। ছাত্রদের গণতান্ত্রিক ক্ষুণœ করে একনায়কতন্ত্রে পরিচালিত হচ্ছে বিশ^বিদ্যালয়।
তবে ডাকসু নির্বাচন না হলেও প্রতিবছরই শিক্ষার্থীরা তাদের ভর্তির সময় এই সংগঠনের জন্য নির্ধারিত হারে বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়ন ফি ও হল ইউনিয়ন ফি বাবদ ১২০ টাকা পরিশোধ করে আসছে, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ডাকসু বাবদ আদায় করা হচ্ছে প্রায় ৪২ লাখ টাকা। সে হিসাবে গত ২৫ বছরে ডাকসু ফান্ডে জমা হওয়ার কথা প্রায় ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বিশ^বিদ্যালয়ের বাজেটেও ডাকসু বাবদ রাখা হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ডাকসু’র জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬ লাখ ১৯ হাজার টাকা। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ৭ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। হল ছাত্র সংসদের জন্য ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯টি হল এবং ২টি হোস্টেলে বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
১৯৯০ সালের ৬ই জুন সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ বছর ধরে ডাকসু বন্ধ রয়েছে। নিয়মিত ফি আদায়ে ডাকসু’র ফান্ডে প্রায় ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা জমা থাকার কথা। কারণ নিয়মানুযায়ী ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি ও জিএস এর স্বাক্ষর ছাড়া এ অর্থ উত্তোলন কেউ উত্তোলন করতে পারবেন না।
ডাকসুর এই অর্থের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ^বিদ্যালয়ের হিসাবরক্ষক জনাব আব্দুল কুদ্দুস মোল্লা ইনকিলাবকে বলেন, আসলে আমাদের যা আয় হয় তা শিক্ষার্থীদের পিছনেই ব্যয় হয়ে যায়। বিশ^বিদ্যালয়ের বাজেটে প্রতি বছরই একটি উল্ল্যেখ যোগ্য পরিমাণ ঘাটতি থাকে তা এইসব আয় থেকে ব্যয় করা হয়। তবে টাকা উত্তোলনে ভিপি-জিএস এর স্বাক্ষর প্রয়োজন একথা জানতে চাইলে তিনি বলেন এইসব টাকা কোষাধ্যক্ষ স্যারের স্বাক্ষরে উত্তোলন করা হয়।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, আমরা বার বার ভিসি স্যারের কাছে এ ব্যাপারে আমাদের মতামত জানিয়েছি। আসলে ডাকসু নির্বাচন আমরা সকলেই চাই, ডাকসু থাকলে সেখানে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে হয়তো ভিপি-জিএস থাকতো তাতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারতাম। নির্বাচন প্রদানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদাসীনতা আছে বলে মনে করছেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আসলে উদাসীনতা আছে বলবোনা, এটা আসলে সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
ছাত্র ইউনিয়নের বিশ^বিদ্যালয় সভাপতি তুহিন কান্তি দাস বলেন, ভিসি স্যার চাইলেই নির্বাচন দিতে পারেন কারন বহু প্রতিকুল পরিস্থিতিতে ও আমাদের জাতীয় নির্বাচনগুলো হচ্ছে সেক্ষেত্রে ডাকসু নির্বাচন কোন ব্যাপার না, আসলে তিনি চাননা নির্বাচন হোক তাহলে বিশ^বিদ্যালয়ের যথেচ্ছা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা আর সম্ভব হবেনা। বিশ^বিদ্যালয় কতৃপক্ষ ছাত্রদের কাছে ডাকসু বাবদ ফি আদায় করার মাধ্যমে তাদের কাছে প্রতিশ্রæতি দিচ্ছে তাদের অধিকার রক্ষার কিন্তু তারা ডাকসু সচল না করে সেই প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করছে প্রতিনিয়ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. আখতারুজ্জামান বলেন, আসলে একটি নির্বাচনের পিছনে অনেকগুলো স্টিক হোল্ডার কাজ করে, যেমন ছাত্র, প্রশাসন, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। নির্বাচনের জন্য জরুরী হচ্ছে এগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। এগুলো হচ্ছেনা বলে নির্বাচন সম্ভব হচ্ছেনা। সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে এখানে অনেকগুলো কম্পোনেন্ট আছে তার মাঝে এই কম্পোনেন্ট টি নেই এটা সত্য।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আ আ ম স আরেফিস সিদ্দিক ইনকিলাবকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে আমরা ভাবছি, এখন হাইকোর্টের রুলের জবাব তৈরী করছি। রাষ্ট্রপতি গুরোত্বারোপ করার পরও নির্বাচনের কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছেনা কেন আর নিকট ভবিষ্যতে আদৌ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোন সম্ভাবনা আছে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- আমরা চেষ্টা করছি, খুব দ্রæতই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। নির্বাচন কেন্দ্রীক সীমাবদ্ধতার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন- আসলে অনিয়মিত ছাত্রত্ব ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের কারনেই নির্বাচন বিলম্বিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের উদাসীনতার কথা তুলে ধরা হলে তিনি বলেন, হ্যা কেউ এরকম বলতেই পারে, সবারই বলার স্বাধীনতা আছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন