\ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান \
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সা:)কে বলতে শুনলেন; কেউ যদি তার স্ত্রীর মুখে এক লোকমা খাবার তুলে দেয়, এটা তার জন্য সাদকার সওয়াব নিয়ে আসে। সাহাবী ঘরে এসে খাবার না পেয়ে এক গøাস পানি তাঁর স্ত্রীকে এগিয়ে দিলেন। স্ত্রী বললেন, কি ব্যাপার, এতো খেদমত শুরু হলো কেনো? সাহাবী বললেন, রাসূল (সা:) এর কাছ থেকে হাদীসটি শুনে আমল করছি।
রাসূলুল্লাহ (সা:) হযরত আয়েশা (রা:) কে আদর করে কখনো ডাকতেন ‘‘আয়েশ’’ সংক্ষিপ্ত করে, আবার কখনো ডাকতেন ‘হোমাইরা’ যার অর্থ লাল বা লালচে। তাই স্ত্রীকে একটি সুন্দর নামে ডাকা, তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করা বা তার ভালোবাসার কথাটুকুন আবেগ সহকারে প্রকাশ করা এমনকি এ বিষয়ে অতিরজ্ঞিত বা বানিয়ে যা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে আরো মধুর ও আবেগময় করে, তা শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিকর নয়। আসমা বিন্তে ইয়াজিত (রা:) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন : “তিন জায়গা ছাড়া মিথ্যা বলা জায়েয নেই। স্বামী-স্ত্রীর মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রে, যুদ্ধের ময়দানে দুশমনকে বিভ্রান্ত করার জন্য এবং দু’ব্যক্তি বা দু’দলের মধ্যে শত্রæতা দূর করে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠানর জন্য’’-(তিরমিযী, আহমদ) হাদীসটির বিস্তারিত ব্যাখ্যার সুযোগ এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়। ইমাম নববী শরহ মুসলিম, ইমাম ইবনে হাযম আল মুহাল্লায় এবং আল খাত্তাবী প্রমুখ মুহাদ্দিসীন ও ফোকাহা স্ত্রীর মনোরঞ্জন ও দাম্পত্য জীবনকে মধুময় করার স্বার্থে অতিরঞ্জিত মহব্বত প্রকাশকে বৈধ বলেছেন। তবে এর উদ্দেশ্য প্রতারণা বা ঠকানো এবং স্ত্রীর সাথে মিথ্যা বলার লাইসেন্স নয়। সমাজের অনেকেরই দেখা যায় স্ত্রীর সাথে এমন মধুর সম্পর্ক স্থাপনের গরয ও সময় তাদের নেই। প্রয়োজনে দৈহিক সম্পর্কটাই মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। বরং তার উল্টো, কথায় কথায় তার অন্তর থেকে হোক বা ঠাট্টাচ্ছলে হোক বলে বসে স্ত্রী তার পছন্দ হয়নি। তার প্রতি সে তেমন আকর্ষণ অনুভব করেনা। উপরন্তু অন্যান্য মহিলার সৌন্দর্য চর্চা করতে বা তার সৌন্দর্য পিপাসা নিবৃত্ত করতে তিনি আরেকটি বিয়ের কথা জোরেসোরে বিবেচনা করছেন। অথচ বাস্তবে হয়তো বা দ্বিতীয় বিয়ে করাটা কোন দিনই হবে না। কিন্তু এই অবাস্তব মুখ চুলকানিটুকু থামাতে না পেরে অযথা দাম্পত্য জীবনে চিড় ধরানোর কাজটুকু করে যাচ্ছেন এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব পয়দা হচ্ছে।
২. পারিবারিক সম্পর্ককে মধুময় করার জন্য স্ত্রীরও রয়েছে অনেকগুলো আদাব। স্বামীর ব্যাপারে অভিযোগ না করে দেখুন সেগুলো আমল করে স্বামীকেও টানতে পারবেন আপনার কাছে, তার সাথে সাথে আল্লাহর কাছ থেকেও পাবেন অফুরন্ত সওয়াব। বাইরে থেকে আপনার স্বামী ঘরে এলে একটু মুচকি হেসে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে কি আপনার অনেক কষ্ট হবে? তার গায়ের কোর্টটি খুলে রাখতে একটু সাহায্য করলে কি আপনার ব্যক্তিত্ব ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যাবে? হযরত আয়েশা (রা:) নিজ হাতে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর চুলগুলো চিরুনী দিয়ে আঁচড়িয়ে দিতেন।
স্বামী ঘরে এলে বলুন না আলহামদুলিল্লাহ! আপনি এসেছেন। আপনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলে চাতকের মতো চেয় থাকি আবার কখন আসবেন। যাওয়ার সময় একটু বলেই দিন তাড়াতাড়ি আসতে হবে কিন্তু! তবে খেয়াল রাখতে হবে, জরুরী প্রয়োজন এবং দ্বীনী দায়িত্ব পালন থেকে যেনো স্বামীকে বিরত না রাখেন। সাধ্যমতো চেষ্টা করুন, স্বামীর রুচি অনুযায়ী কাপড়-চোপড় পরিধান করতে, সেজে-গুজে চলতে, যাতে স্বামী আপনার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন। মন থেকে বিভিন্ন প্রকার দুশ্চিন্তা দূর করে দিন। যে কোন অবস্থায় স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুন। সংসারের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে স্বামীর প্রতি অসন্তোষ ও অভিযোগ দায়ের করা থেকে বিরত থাকুন্ রাসূল (সা:) আমাদেরকে দোয়া শিখিয়েছেন : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযান--অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী থেকে পানাহ চাই-(বুখারী)।
স্বামী-স্ত্রী উভয়ের করণীয় আদব ঃ উভয়েই ইল্ম, শরীয়তের আমল পালন করতে এবং গুনাহ থেকে দূরে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করুন। দ্বীনী দায়িত্ব পালনে একে অপরকে সাহায্য করুন। একে অপরের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে আত্মীয়-স্বজন বা অন্যান্যদের কাছে অপরের দোষত্রæটি আলোচনা না করে ভালো দিকগুলো আলোচনা করুন।
নিজেদের মধ্যে কখনো ভুল বুঝাবুঝি হয়ে গেলে তা দূর করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে ক্রোধের মাথায় সমাধান না করে পরবর্তীতে স্বাভাবিক পরিবেশে সমাধানের অপেক্ষা করুন। একে অপরকে মাফ করে দিন। ধৈর্য ও সবরের প্রতিযোগিতা করুন। সন্তান-সন্ততির সামনে একে অপরের সমালোচনা কঠোরভাবে এড়িয়ে চলুন। এতে উভয়েই সন্তানদের কাছে অপমানিত হওয়া থেকে বাঁচা যাবে এবং সন্তানদেরকে আদব শিখানোর যোগ্যতা হারাতে হবে না। নিয়মিত পারিবারিক বৈঠক করুন। স্বামীর উচিত সংসারের এমনকি নিজের ব্যক্তিগত অনেক কিছুই স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে কাজ করা। স্ত্রীরও উচিত স্বামীর অনুমতি নিয়েই যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা। একে অপরের পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনকে সম্মান ও যতেœর ব্যাপারে উদাসীন না হয়ে আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করা।
সন্তান-সন্ততির প্রতি পিতামাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য ঃ আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “আল্লাহ তোমাদেরকে অছিয়ত করছেন, তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে’’-(নিসা : ১১)। রাসূল (সা:) এরশাদ করেছেন, “তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে-ইমাম (নেতা/শাসক) তার অধীনস্থ জনগণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, সে ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে। পুরুষ তার পরিবার-পরিজনের কর্তা, তার কর্তৃত্বের ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে। মহিলা হচ্ছেন তার স^ামীর গৃহের কর্তৃত্বকারিণী। তাকেও তার অধীনস্থদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে--’’-(বুখারী)।
কাজেই সন্তান-সন্ততি মা-বাবার প্রতি আল্লাহর এক বিরাট আমানত। এ আমানত সংরক্ষণ করা পিতা-মাতার একটা জরুরী ফরয কাজ।
(চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন