আবু হেনা মুক্তি, খুলনা থেকে : খুলনা জেলা বিএনপির সাংগাঠনিক সম্পাদক ও ফুলতলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সরদার আলাউদ্দীন মিঠু ও তার দেহরক্ষি নওশের গাজী ডাবল মার্ডার রহস্যজট খুলতে শুরু করেছে। হত্যার মোটিভ অর্থদাতা কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারী সদস্য সংখ্যা ও পরিকল্পনাকারীদের নামও এখন পুলিশের নোটবুকে। বিএনপি ও আওয়ামীলীগের তিন নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় হত্যাকান্ডের নীল নকশা করা হয়েছে এমনও ইঙ্গিত দিয়েছেন দায়িত্বশীল তদন্তকারীরা।
পুলিশ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মো. রনি মোড়ল (২৯) নামে এক অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেছে। গতকাল রাতে যশোরের বসুন্দিয়া এলাকা থেকে ফুলতলা থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তার কাছ থেকে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত একটি শর্টগান উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে গত রোববার অত্যন্ত গোপনে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমারের খাস কামরায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। নিহত বিএনপি নেতা আলাউদ্দিন মিঠুর অফিস গার্ড শিমুল হাওলাদার ও অপর দেহরক্ষি সাদ্দাম ওরফে রিফাত আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধরার জবানবন্দিতে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের মিঠুর অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহের বিষয়টি স্বীকার করেছে বলে পুলিশের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে। তবে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ বিস্তারিত জানানোর কথা বললেও আজ এ বিষয়ে প্রেসব্রিফিং হতে পারে।
এই মামলার এই মুহুর্তে গুরুত্বপূর্ণ আসামী অস্ত্রসহ আটক রনি মোড়ল পুলিশকে কিলিং মিশনে অংশ নেয়ার কথা স্বীকার করার পাশাপাশি কারা কারা অপারেশনে অংশ নিয়েছিল এবং ডিবি পুলিশের পোশাক পরার পরিকল্পনা কাদের ছিল সেসব বিষয়ে মুখ খুলছে। সূত্রটি আরো জানায়, ডাবল মার্ডারের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসার সাথে সাথে হত্যাকান্ডের মূল বাজেট নির্ধারণ, অর্থ যোগানদাতা, পরিকল্পনকারী ও বাস্তবায়নের নীল নকশা সম্পর্কে বয়ান দিয়েছে। এতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মোট তিন নেতার উদ্দেশ্য হাসিলের স্বার্থে এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত রনি মোড়ল পুলিশের রেকর্ডভুক্ত একজন সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ফুলতলা ও কেএমপির খালিশপুর থানায় হত্যাসহ একাধিক মামলা। সে ফুলতলা উপজেলার দামোদর গ্রামের মো. ওমর আলী মোড়ল ওরফে সুদে মোড়লের ছেলে।
সূত্রে প্রকাশ, দীর্ঘদিন যাবত ফুলতলা উপজেলা বিএনপিতে ‘মিঠু’ ও ‘মার্শাল’ গ্রæপের মধ্যে দ্ব›দ্ব ওপেন সিক্রেট। দামোদর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শিমুল হাওলাদার ‘মার্শাল’ গ্রæপের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সে ৯-১০ বছর যাবত মার্শালের দেহরক্ষি হিসেবেও কর্মরত ছিল। গত দু’ মাস আগে ‘মার্শাল’ কৌশলে মিঠুর তথ্য আদান-প্রদানের জন্য শিমুল হাওলাদারকে মিঠুর কাছে সোর্স হিসেবে পাঠিয়ে দেয়। এই শিমুল হয়ে ওঠে মিঠুর জন্য কাল। সে বিভিন্ন সময়ে মিঠুর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করতে থাকে। এমনকি ঘটনার সময়ও শিমুল চা পানের কথা বলে অপর দেহরক্ষি সাদ্দাম ওরফে রিফাতকে নিয়ে অফিসের বাইরে অবস্থান করে। যে কারণে দেহরক্ষি নওশের গাজী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেও তাদের কিছুই হয়নি। শিমুল হাওলাদারের মোবাইল কললিস্ট পরীক্ষা করেই তার সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয় পুলিশ। তার তথ্যের সূত্র ধরেই আটক করা হয় ফুলতলা থানা বিএনপির সদস্য সচিব হাসনাত রিজভী মার্শাল ভূইয়া এবং উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন কিরনকেও। আওয়ামীলীগ ও বিএনপির দু’ জন প্রভাবশালী নেতার মধ্যস্ততা ও অর্থায়নে চরমপন্থি সংগঠন জনযুদ্ধের শীর্ষ নেতা শিমুল ভূইয়ার নেতৃত্বে মিঠুকে হত্যা করা হয় বলেও সূত্রটি জানিয়েছে।
নিহত বিএনপি নেতা সরদার আলাউদ্দিন মিঠুর ভাই সরদার সেলিম জানান, মার্শালের দেহরক্ষি শিমুল হাওলাদার দু’ মাস আগে তার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে মিঠুর কাছে এসে বলে, মার্শাল তাকে মারধর করে বের করে দিয়েছে, একটি কাজ দিতে হবে। তখন বিশ্বাস করে মিঠু তার অফিসের কাজকর্মের জন্য তাকে রেখে দেয়। তবে তিনি মিঠুকে নিষেধ করেছিলেন।
এেিদক খুলনা জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সরদার আলাউদ্দিন মিঠু ও তার সহযোগী নওশের গাজী হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে খুলনা জেলা প্রশাসক ও রেঞ্জ ডিআইজির মাধ্যমে সরকারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে বিএনপি।
গতকাল সকাল ১১ টায় জেলা প্রশাসক আমিন উল আহসান ও দুপুর ১২ টায় রেঞ্জ ডিআইজি মো: দিদার আহম্মেদ এই স্মারকলিপি গ্রহণ করেন। জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট এস এম শফিকুল আলম মনা এবং মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কেসিসির মেয়র মনিরুজ্জামান মনি স্মরাকলিপিতে স্বাক্ষর করেছেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর সভাপতি সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম মঞ্জু, আমীর এজাজ খান, ডাঃ গাজী আব্দুল হক, শেখ মোশারফ হোসেন, মোল্লা মোশারফ হোসেন মফিজ, মহিবুজ্জামান কচি, জি এম কামরুজ্জামান টুকু, ইউসুফ হারুন মজনু, কে এম হুমায়ুন কবির, শামসুজ্জামান চঞ্চল প্রমুখ।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, জেলার জনপ্রিয় নেতা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সরদার আলাউদ্দিন মিঠু ও নওশের গাজীকে ২৫ মে বৃহস্পতিবার রাতে ডিবি পোশাক পরিহিত খুনীরা তার বাসভবনের সামনে অফিসে ঢুকে শত শত রাউন্ড গুলি চালিয়ে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডের নারকীয় ও বিভৎসতায় ফুলতলাবাসী ও বিএনপির নেতাকর্মী জনগন আতঙ্কিত। ভয়ার্ত পরিবশে সৃষ্টি করে প্রকাশ্যে ফিল্মি স্টাইলে তিন মটর সাইকেলে আসা ৯ খুনী হত্যাকান্ড ঘটিয়ে নির্বিঘেœ পালিয়ে যায়। এরআগে এই খুনীরা মিঠুর পিতা সরদার আবুল কাশেম, পরে তার ভাই আবু সাঈদ বাদলকেও গুলি করে হত্যা করে। এই দুই হত্যা মামলার বাদী ছিল সরদার আলাউদ্দিন মিঠু। সরকারি দলের আশ্রয় প্রশ্রয়ে থাকা খুনীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং সর্বশেষ তারা মিঠুসহ দুই জনকে হত্যা করে। ধারবাহিক এই হত্যাকান্ডকে একটি জনপ্রিয় পরিবারকে শেষ করার জন্য ঠান্ডা মাথার পরিকল্পিত হত্যা বলে অভিযোগ করা হয়। স্মারকলিপিতে অবিলম্বে খুনীদের গ্রেফতারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, অস্ত্র উদ্ধার, খুনীদের বিচার ও মিঠুর পরিবারকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়। সেই সাথে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রভাবমুক্ত থেকে নিষ্ঠার সাথে তাদের দায়িত্ব পালনের দাবি জানানো হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন