\ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান \
আল্লাহ তায়ালা তার অপার অনুগ্রহে বান্দাকে তার ইবাদতকর্মে সহযোগিতার জন্য বেশকিছু বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছেন। একদিকে তিনি সাওম পালন করা ফরজ করে দিয়েছেন, অপরদিকে যারা তা করতে অপারগ হবে তাদের জন্য পথ বের করে দিয়েছেন। আজ আমাদের আলোচনা তাদের নিয়ে, যারা সাওম ফরজ ছিল কিন্তু কোনো কারণে তা পালন করতে অক্ষম হয়ে গেছেন।
প্রথমত, সাওম পালনে এমন অক্ষম ব্যক্তি, যার অক্ষমতা দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই- যেমন অতিশয় বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি বা এমন রোগী (ক্যান্সার বা অনুরূপ রোগ) যার আরোগ্য হওয়ার আর আশা নেই। অতএব এমন ব্যক্তির জন্য সিয়াম পালন ফরজ নয়। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেছেন, ‘আল্লাহ সাধ্যের বাইরে কাউকে দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না।’ (সুরা আল বাকারা : ২৮৬)। তবে ওই অক্ষম ব্যক্তির জন্য প্রতি সাওমের বদলে রোজ একজন মিসকিনকে খাওয়ানো আবশ্যক। আর খাবার খাওয়ানোর ব্যাপারে দুইটির যে কোনোটি গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে- ১. প্রত্যেক মিসকিনকে আলাদাভাবে খাদ্য ভাগ করে দেয়া, যার পরিমাণ ‘আধা কিলো ও ১০ গ্রাম’ ভারি ভালো গম বা চাল। ২. আবার খাবারের আয়োজন চূড়ান্ত করে সব মিসকিনকে দাওয়াত দিয়ে নির্ধারিত দিনের হিসাব অনুযায়ী খাওয়ানো যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, মুসাফির ব্যক্তি, যিনি সাওম ভাঙার কৌশল হিসেবে সফরের সংকল্প করেননি- এমন ব্যক্তি সাওম পালন বা সাওম ভঙ্গ করার এখতিয়ার পাবে। তার সফরের সময়সীমা দীর্ঘ হোক বা সংক্ষিপ্ত; হোক তার সফর কোনো উদ্দেশ্য আকস্মিক কিংবা ধারাবাহিক। যেমন পাইলট বা ভাড়া গাড়ির ড্রাইভার। গাড়ির ড্রাইভার ভাড়ায় গাড়ি চালান এবং তাকে এ কাজ সারাক্ষণই করতে হয়। রমজান মাসে সফর অবস্থায় তীব্র গরমের কারণে যদি তার সাওম পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে, তাহলে তিনি যখন আবহাওয়া ঠান্ডা হবে এবং তার জন্য সাওম পালন করা সহজ হবে, এমন সময় তিনি সাওম (কাজা হিসেবে) পালন করতে পারবেন। তবে মুসাফিরের জন্য সর্বোত্তম হলো সাওম পালন বা ভাঙার মধ্যে যেটা তুলনামূলক সহজ হয়, তা-ই করা। যদি দুই-ই সমান হয়, তাহলে সাওম পালনই শ্রেয়। কারণ এটা তাড়াতাড়ি জিম্মামুক্ত হতে সহায়ক এবং অন্যদের সঙ্গে হওয়ার কারণে উৎসাহ ব্যঞ্জকও বটে। তাছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলও এমন। যদি সিয়াম পালনকারী দিনের মধ্যভাগে সফর করে এবং সিয়াম পূর্ণ করা তার জন্য কষ্টকর হয়, তাহলে নিজ শহর থেকে বের হওয়ার পর তার জন্য সিয়াম ভঙ্গ করা জায়েজ। আর যদি মুসাফির রমজান মাসে স্বীয় শহরে দিনের বেলায় সিয়াম পরিত্যাগ অবস্থায় আগমন করে, ওই দিন তার জন্য বাকি সময়ের সিয়াম রাখা সহিহ হবে না। কেননা সে দিনের প্রথম ভাগে সিয়াম ভঙ্গকারী ছিল। আর ফরজ সিয়াম সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার সময় থেকেই কেবল সহিহ হয়।
তৃতীয়ত, এমন রোগী, যার রোগমুক্তির আশা করা যায় : এর তিনটি অবস্থা- ১. যদি এমন হয় সাওম তার জন্য কষ্টকর নয় আবার তার ক্ষতিও করবে না, তাহলে তার জন্য সাওম ফরজ হবে। কারণ তার কোনো শরয়ি ওজর নেই, যা সাওম ভাঙাকে বৈধ করবে। ২. যদি এমন হয় সাওম তার জন্য কষ্টকর, তবে তার ক্ষতি করবে না। এমন অবস্থায় সে সাওম ভঙ্গ করবে। এ অবস্থায় তার জন্য কষ্টকর হলে সাওম পালন মাকরুহ হবে। কারণ সে আল্লাহর দেয়া সুযোগ থেকে বের হয়ে নিজেকে শাস্তি দিল। ৩. যদি এমন হয় সাওম তার ক্ষতি করবে, তাহলে তার জন্য সাওম ভাঙা ওয়াজিব এবং সাওম পালন বৈধ নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান।’ (সুরা আন নিসা : ২৯)।
আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্য বিভিন্ন ধরনের ইবাদত প্রবর্তন করেছেন। এতে করে তারা যেমন বহুমুখী ইবাদত করে বেশি বেশি পুণ্য অর্জন করবে, তেমনি এক ধরনের ইবাদতে একঘেয়েমি লাগলে অন্য ধরনের ইবাদতে সাগ্রহে মনোনিবেশ করতে পারবে। এসব ইবাদতের মধ্যে কিছু রয়েছে ফরজ, যাতে কোনো ধরনের কমতি বা ত্রুটি করা যাবে না। আবার কিছু রয়েছে সুন্নত-নফল, যা ফরজে পরিপূর্ণতা ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সহায়ক।
এসব ইবাদতের মধ্যে অন্যতম হলো নামাজ। আল্লাহ বান্দার ওপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন, যা কার্যত পাঁচ হলেও মিজানের পাল্লায় ৫০। আল্লাহ সুন্নত-নফল নামাজকে ফরজ নামাজের ক্ষতিপূরণ এবং তার নৈকট্য লাভের মাধ্যম হিসেবে স্থির করেছেন। এসব সুন্নত-নফলের মধ্যে রয়েছে- কিছু সুন্নত নামাজ, যা ফরজ নামাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন- ফজরের ফরজ নামাজের আগে দুই রাকাত, জোহরের ফরজের আগে চার রাকাত ও পরে দুই রাকাত। মাগরিবের ফরজের পর দুই রাকাত ও এশার ফরজের পর দুই রাকাত। আর নফল নামাজের অন্যতম হলো কিয়ামুল লাইল (রাতের নামাজ বা তাহাজ্জুদ)। তাহাজ্জুদ আদায়কারীদের প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা তাদের রবের জন্য সিজদারত ও দন্ডায়মান হয়ে রাত যাপন করে।’ (সুরা ফুরকান : ৬৩)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে আলাদা হয়। তারা ভয় ও আশা নিয়ে তাদের রবকে ডাকে। আর আমি তাদের যে রিজিক দান করেছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে। অতঃপর কোনো ব্যক্তি জানে না তাদের জন্য চোখজুড়ানো কী জিনিস লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তারা যা করত, তার বিনিময়স্বরূপ।’ (সুরা সিজদা : ১৬-১৭)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ফরজ নামাজের পর অধিক ফজিলতপূর্ণ হলো রাতের নামাজ।’ (মুসলিম : ১১৬৫)। অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘হে লোকসব! সালামের প্রসার ঘটাও, গরিব-দুঃখীদের খাদ্য দান কর, আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখ, রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে, তখন নামাজ আদায় কর, তাহলে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (তিরমিজি : ২৪৫৮)। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার ইচ্ছা বা আগ্রহ প্রায় সব মোমিনের হৃদয়েই সুপ্ত থাকে। কর্মব্যস্ত জীবনে শেষ রাতে ঘুম থেকে ওঠার সুযোগ হয় না বলে তা পড়তে পারেন না। রমজানে সাহরির জন্য সবাইকে যেহেতু শেষ রাতে জাগতেই হয়, তাই রমজান মাস তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য সুবর্ণ সুযোগ। প্রতি দিন সাহরির কয়েক মিনিট আগে উঠে অজু করে মাত্র দুই রাকাত নামাজ পড়েও আমরা তাহাজ্জুদের অশেষ সওয়াব পেতে পারি।
(চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন