অধ্যাপক শেখ মো. কামাল উদ্দিন : পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে সমাজ, রাষ্ট্র ও পারিবারিক জীবন পরিচালনার জন্য প্রয়োজন প্রকৃত শিক্ষা। এ উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের ফলে মুসলিম ইতিহাস ঐতিহ্য প্রায় বিলীন হতে চলেছিল। তখন এ শিক্ষা গ্রহণ ছিল অত্যন্ত দুরুহ কাজ। এহেন কালে যে সকল মণীষী অত্যন্ত ত্যাগ স্বীকার করে দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণে আন্তরিক ছিলেন তাঁদেরই অন্যতম হযরত মাওলানা এ কে এম হাশেমের পরিবার। তাঁর জীবনের কিছু দিক এখানে আলোকপাত করা হলো।
আলহাজ্ব মাওলানা মুহাদ্দিস ও মুফতি এ. কে. এম হাশেম কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার ফতেহাবাদ গ্রামে পহেলা সেপ্টেম্বর ১৯৪২ সালে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ণ নাম আবুল কালাম মোহাম্মদ হাশেম। তার পিতার নাম মুন্সী মুহাম্মদ জুনাব আলী। দাদার নাম মুহাম্মদ আবদুল কাদির বক্স। তারা ছিলেন ৪ ভাই ৩ বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন জ্যৈষ্ঠ। দ্বিতীয় ভাই হাজী আবদুল ওয়াহেদ, তৃতীয় ভাই মরহুম মাওলানা আবু তাহের ও ৪র্থ ভাই মরহুম আবু জাহের (প্রবাসে অসুস্থ অবস্থায় ইন্তেকাল করলে দেশের বাড়ীতে তার লাশ দাফন করা হয়)। ৩ বোনের মধ্যে বড় ছিলেন মমতাজ আক্তার, দ্বিতীয় রহিমা আক্তার, তৃতীয় মুর্শিদা আক্তার।
তাঁর নানা ছিলেন উপমহাদেশ বিখ্যাত সোনাকান্দা দরবার শরীফের পীরে কামেল আলহাজ¦ হযরত মাওলানা হাফেজ মুহাম্মদ আবদুর রহমান হানাফী (র.)। মামাগণের মধ্যে প্রথম পীরে কামেল হযরত মাওলানা সামছুল হুদা (র.)। যিনি সোনাকান্দা দরবার শরীফের বর্তমান গদ্দিনেশিন পীর হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাহেবের পিতা। দ্বিতীয় মরহুম হযরত মাওলানা সুলতান আহমেদ (র.), তৃতীয় হযরত মাওলানা আবদুল কুদ্দুছ সাহেব। তিনি সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা মোকাররামায় বসবাস করছেন।
এছাড়াও তাঁর নিকটতম আত্মীয়দের মধ্যে রয়েছেন; আড়াইবাড়ী দরবার শরীফের মরহুম পীরে কামেল আল্লামা হযরত মাওলানা মুহাম্মদ গোলাম হাক্কানী (র.), ধামতী দরবার শরীফের পীর হযরত মাওলানা আবদুল হালীম, হাবিবুর রহমান টেক্সটাইল্স এর স্বত্ত¦াধিকারী আলহাজ¦ হাবিবুর রহমান, ফুরফুরা দরবার শরীফের পীর হযরত মাওলানা মতিউল্লাহ সিদ্দিকী কুরাইশী (র.)।
শিশু হাশেম পিতা মাতার যতেœ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগলেন। তিনি ছিলেন তাদের অত্যন্ত আদরের সন্তান। কিন্তু মহান রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছায় তিন বছর বয়সে তিনি তার মা কম্পনেন্নেসাকে হারান। শিশুপুত্র হাশেমকে নিয়ে বাবা মুন্সী মুহাম্মদ জুনাব আলী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। পরে নতুন সংসার গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিবারের সিদ্ধান্তক্রমে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার পরের মায়ের নাম কাকতালীয়ভাবে মিলে যায় অর্থাৎ তার নামও কম্পনেন্নেসা। নববধূ হিসেবে ঘরসংসার করতে এসে তাকেই নিতে হয়েছে শিশু হাশেমকে মানুষ করার দায়িত্ব।
শৈশবেই বাড়ির মকতবেই শিক্ষা জীবন শুরু হয়। মকতবের উস্তাদ তার চাচা মৌলভী সাঈদুর রহমানের কাছে অতি অল্প সময়ে কুরআন শরীফ ও নামাজের মাসআলা মাসায়েল শিক্ষা গ্রহণ করতে সক্ষম হন। প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা শেষে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য তাঁকে তার নিজ গ্রাম ফতেহাবাদ সুলতানপুর ফাযিল মাদরাসায় প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করেন। ধীরে ধীরে লেখাপড়ায় অগ্রসর হতে থাকে। ছোট বেলা থেকেই তিনি আদব আখলাক সচ্চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। যার ফলে তিনি মুরুব্বীদের ও মাদরাসার সকল উস্তাদের নজরদারীতে মেধার সাক্ষর রেখে উত্তীর্ণ হতে থাকেন। অত্র মাদরাসা থেকে ১৯৫৬ সালে কৃতিত্বের সাথে দাখিল পাশ করেন। তাঁর মেধা ও আদব আখলাক দেখে তাঁর চাচা মৌলভী সাঈদুর রহমান তাকে ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ধামতী ইসলামিয়া আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। মহান রাব্বুল আলামীনের অশেষ মেহেরবানীতে আলিম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ধামতী ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা ১৯২০ সালে ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দীদে জামান শাহসুফি আলহাজ¦ হযরত মাওলানা আবু বকর সিদ্দীক (রাহ:) এর বিশিষ্ট খলিফা আলহাজ্ব আজীমুদ্দীন (রহ:) প্রতিষ্ঠা করেন। কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার ধামতী গ্রামে এটি প্রতিষ্ঠার ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার ছাত্র দ্বীনী ইল্ম শিক্ষার জন্য এখানে ভর্তি হন। মাওলানা এ কে এম হাশেম তাদেরই একজন। এখানে ভর্তি হয়ে তিনি ধামতী দরবার শরীফের পীর হযরত আজীমুদ্দীন (রহ:) এর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি ইলমে তাসাওউফ এর দীক্ষা গ্রহণে ব্রতী হন।
কিছুদিন যেতে না যেতেই তিনি আলহাজ মাওলানা আজীমুদ্দীন (রহ:) এর প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেন। পীর সাহেবের সোহ্বতে থেকে তিনি তাযকিয়াতুন নাফ্স ও ইলমে তাসাওউফে উচ্চতর স্থানে পৌঁছে যান। পীর সাহেবের দোয়ায় ও আপন প্রচেষ্টায় তিনি ১৯৬০ সালে আলিম ও ১৯৬২ সালে ফাযিল পাশ করেন। মেধাবী আদব আখলাক উত্তম চরিত্রের অধিকারী এ কে এম হাশেম’র দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করার বাসনা বহু দিনের। মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ শ্রেণি কামিল ক্লাশে ভর্তি হবেন ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দিদে জামান আলহাজ¦ শাহসুফি হযরত মাওলানা আবু বকর সিদ্দীক (রহ:) এর অন্যতম খলিফা, বাংলাদেশের সফল ইসলাম প্রচারক, আলহাজ¦ হযরত মাওলানা নেছারউদ্দিন (রহ:) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন বরিশাল জেলার ছারছিনা দারুচ্ছুন্নাত বহুমুখি কামিল মাদরাসায়। সেখানে হাদিস বিভাগে ভর্তি হন। ঐতিহাসিক ওই মাদরাসায় যুগশ্রেষ্ঠ আলেম, সুদূর চীন দেশের অধিবাসী, উপমহাদেশ বিখ্যাত হাদীস বিশারদ শায়খুল হাদীস আল্লামা হযরত মাওলানা খুতয়ানী (র.) হাদীসের র্দাস দিয়ে থাকেন। জ্ঞান পিপাসু মাওলানা আবুল হাশেম অতি হৃদয়গ্রাহী হয়ে পাঠ গ্রহণে মুগ্ধ হলেন। অন্তরের খোরাক পেয়ে নিজেকে সার্থক মনে করলেন। অন্যান্য উস্তাদগণ তাঁকে আদর সোহাগ করে হাদীস মোতায়ালা করার জন্য যাবতীয় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দু’বছর অধ্যয়ন করে ১৯৬৪ সালে কৃতিত্বের সহিত হাদিস বিভাগে কামিল পাশ করেন।
জ্ঞানপিপাসু আবুল হাশেমের হাদীস শাস্ত্রে জ্ঞানাহরণের পর ফিক্হ বিভাগে অধ্যয়নের আগ্রহ জাগে। তিনি মনস্থ করলেন, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ সরকারী মাদরাসা-ই আলীয়া, ঢাকায় ভর্তি হবেন। নিজের প্রচেষ্টায় তিনি ধীরে ধীরে একজন বিজ্ঞ আলেম হওয়ার পথ সুগম করে নিলেন। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে চেষ্টা-সাধনা করে উস্তাদগণের দোয়া ও বিশেষ নজরদারীতে কামিল ফিক্হ বিভাগেও পূর্বের ধারা অব্যাহত রেখে অত্যন্ত সুনামের সাথে ১৯৬৬ সালে কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জন করে প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। তিনি এখানে এসে ফোকাহায়ে আজম, মাদরাসা-ই আলীয়ার হেড মাওলানা, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররাম’র গ্র্যান্ড ইমাম ও খতিব, নামায-রোজার চিরস্থায়ী ক্যালেন্ডারের রূপকার, লাখো আলেমের হৃদয়ের স্পন্দন, ইসলামের ইতিহাস ও উসূলে হাদীসসহ আরবী ও উর্দু ভাষায় বহু গ্রন্থ প্রণেতা এবং অনুবাদক আল্লামা হযরত মাওলানা আমীমুল ইহ্সান (র.) এর সান্নিধ্যে নিজেকে গড়ে তোলেন কুরআন সুন্নাহর আদর্শে। তাঁর স্নেহ মায়া মমতায় বিদ্যার্জনে আরো মনোযোগ আকর্ষণ করে। তিনি ছায়ার মত তাঁর অনুসরণ করতে থাকেন। তিনি মাতৃভাষা বাংলার পাশাপাশি আরবি, উর্দু, ফার্সী ভাষা আয়ত্ব করেন।
(চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন