এম.এম.এইচ.খান :পবিত্র কুরআন এবং হাদীস শরীফে ইহসানের উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে : আল্লাহ তায়ালা ইহসানকারীদেরকে অত্যন্ত পছন্দ করেন। তিনি তাদেরই সাথে আছেন। তিনি ইহসানকারীদেরকে অনেক বড় পুরস্কার দান করেন, এবং আরও অতিরিক্ত দিয়ে ধন্য করেন।এবারে আসুন ইহ্সান বিষয়টা কি ,আমরা বুঝার চেষ্টা করি। ইহ্সান শব্দটি ‘হাসান’ থেকে উদ্ভুত হয়েছে। ‘হাসান’ অর্থ : ভাল, উত্তম, সুন্দর ইত্যাদি।আর ‘ইহ্সান’ অর্থ: ভালভাবে কোন কাজ সম্পন্ন করা, উত্তম রুপে আদায় করা, ভাল আচরণ করা ইত্যাদি। কুরআন ও হাদীসে আমরা ইহসানের তিনটি রুপ দেখতে পাই প্রথমত : আল্লাহ ও বান্দার মাঝে ইহ্সান, দ্বিতীয়ত: বান্দাহও অন্যান্যদের মাঝে ইহ্সান, তৃতীয়ত : বান্দার প্রতিটি কর্মের মাঝে ইহ্সান, আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে ইহ্সান হচ্ছে দ্বীনের সর্বোচ্চ মান। যে বিষয়টি হাদীসে জিবরাইলে প্রিয় নবীজী (সাঃ) ইরশাদ করেছেন: “ইহ্সান” তুমি এমনভাবে (ভক্তি, শ্রদ্ধা ও মনোযোগ সহকারে) আল্লাহর ইবাদত করবে যেন, তুমি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ। তা যদি ভাবতে না পার, তবে এতটুকুন অবশ্যই নিশ্চিত মনে করবে যে আল্লাহ তোমাকে দেখতে পাচেছন”-(মুসলিম)। আল্লাহর ব্যাপারে এমন অনুভ‚তিকে খুশু খুযু হিসেবে ও বলা হয়েছে। বান্দার ও আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে ইহ্সানের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে।কোন কোন ইহ্সান বান্দার অবশ্য করনীয় কর্তব্য হয়ে যায়, যা লংঘন করলে কবীরা গুনাহ হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন : “তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, আর তার সাথে কিছুই শরীক কর না। সদয় আচরণ কর মাতা পিতার প্রতি, আত্মীয়-সজ্বন, ইয়াতিম, বিত্তহীন, আত্মীয় প্রতিবেশী ও অনাআত্মীয় প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবও সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের মালিকানাধীন ক্রীত দাস-দাসীদের প্রতি। (নিসা : ৩৬) মাতাপিতা ও অন্যান্যদের প্রতি ইহ্সান (সদয় আচরণ) করা উক্ত আয়াতে মু‘মিনদের প্রতি অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া অনাথ অসহায় ও আর্তপীড়িতের প্রতি সাহায্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে ইহ্সান করার জন্য কুরআন হাদীসে মু‘মিনদেরকে বিশেষ ভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। এমনকি মানুষের সঙ্গে কথোপকথনের সময় ও সুন্দর ও শালীন ভাষায় সম্বোধনের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : “তোমরা মানুষের উদ্দেশ্যে সুন্দরভাবে কথা বল”-(বাকারা : ৮৩)। এ বিষয়ে প্রিয় নবীজী (সাঃ) ইরশাদ করেছেন : “তোমরা ভাই’র সাথে সাক্ষাতে মুচকি হাসি দেয়াও তোমার জন্য সাদাকার সওয়াব নিশ্চিত করে”-(বুখারী/মুসলিম)। প্রতিটি কাজেকর্মে ইহ্সান প্রসঙ্গে প্রিয় নবীজী (সাঃ) ইরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রতিটি কর্মে ইহ্সান অবলম্বন করা লিপিবদ্ধ (ফরজ) করে দিয়েছেন। তোমরা (বিধান মোতাবেক) করো মৃত্যুদন্ড কার্যকরি করতে হলে সেখানেও ইহ্সান অবলম্বন করতে হবে। কোন প্রাণী জবাই করতে গেলে ইহ্সানের সাথে জবাই করতে হবে। তোমরা তোমাদের ছুরিটাকে অবশ্যই ধারালো করে নেবে, যাতে জবাইকৃত প্রাণীর কষ্ট কম হয়।”-(মুসলিম)।
এ হাদীসে ইহ্সান সম্পর্কিত অনেকগুলো শিক্ষা রয়েছে। প্রথমত কাজ ও কর্মকে সুচারুরুপে সম্পন্ন করার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। আন্তরিকতার পাশাপাশি দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিপূর্ণ বিকাশ ও প্রয়োগের মাধ্যমে পেশাগত মান নিশ্চিত করা। যেটাকে আধুনিক পরিভাষায়‘প্রফেশনালিজম’বলা হয়। যা ইচ্ছে তাই বা গা সারা গোছের, অথবা কোন রকমের দায়িত্ব পালনের কোন সুযোগ ইসলামে নেই। প্রতিটি ব্যক্তি তার কর্ম, পেশা এবং দায়িত্বের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসিত হবেন। শরীয়তে এমন গুরুত্ব থাকার পরও অনেক মুসলমান পেশাগত মান নিশ্চিত করার ব্যাপারে যথেষ্ট গাফলতি করে থাকেন। কর্তব্যে অবহেলা, কাজের ফাঁকি ও অমনোযোগকে আদৌ কোন অপরাধই মনে করে না।
হদীসে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের প্রতিও ইহ্সান করতে বলা হয়েছে। যত দ্রæত সম্ভব এবং কম কষ্ট দিয়ে তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকরী করার চেষ্টা অবলম্বন করতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শুধু মানুষ নয়, এমন কি প্রয়োজনের কারণে যখন পশু কুরবানী বা জবাই করতে হয়, তখনও তাদের প্রতি সদয় হতে বলা হয়েছে। কষ্ট দিয়ে দিয়ে সময় ক্ষেপণ করে ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে কোন পশু বধ করা শরীয়তে অনেক বড় গুনাহ\ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর(রাঃ) দেখতে পেলেন কিছু লোক একটি মুরগিকে হাত সই করার উদ্দেশ্যে বেঁধে রেখে পাথর নিক্ষেপ করছে। তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন : এমন অপকর্ম কে করেছে? আল্লাহর রাসূল(সাঃ) এমন কাজ যারা করে,তাদের প্রতি লা‘নত(অভিশাপ) ঘোষণা করেছেন।”-(বুখারী) হাদীসে আরও এসেছে বনি ইসরাঈলের একজন মহিলা কোন কারণে একটি বিড়ালকে শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে বন্দী করে রেখেছিলো। তাকে কোন খাবার ও পানীয় খেতে দেয়নি। আর বেঁধে রাখার কারণে যমীনে পড়ে থাকা কোন খাদ্য খুঁজেও খেতে পারেনি। ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত অবস্থায় ছঁফট করতে করতে অবশেষে বিড়ালটির মৃত্যু হয়। একটি জানোয়ারের প্রতি এমন নির্দয় আচরণ করার কারণে আল্লাহ তায়ালা সে মহিলাকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করার ফায়সালা করে দিলেন।-(বুখারী/মুসলিম)। অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এরশাদ করেছেন :এক ব্যক্তি মরুভুমির তপ্ত পথ পাড়ি দিতে গিয়ে ভীষণভাবে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লেন। একটি কুপে এসে বালতি না পেয়ে কুপে নেমে পানি পান করলেন। কুপের উপর উঠে এসে দেখতে পেলেন একটি কুকুর তৃষ্ণার্ত হয়ে অবশেষে মাটি চুষে তৃষ্ণা নিবারণের ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে। এ অবস্থা দেখে লোকটি কুপে নেমে নিজের পা থেকে চামড়ার মুজা খুলে পানি ভর্তি করে নিয়ে এসে কুকুরকে পান করালেন। লোকটির কর্মে আল্লাহ খুশি হয়ে তাকে মাফ করে দিলেন এবং জান্নাতে ফায়সালা করে দিলেন।”-(মুসলিম)। এমনকি বিনা কারণে গাছের একটি ডাল বা পাতাও ছিঁড়া ঠিক নয়। কারণ সেটাও আল্লাহর যিকর করে। এভাবে পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি ইহ্সান করার জন্যও মুসলমানরা নির্দেশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন