মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে মানুষের জীবন সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়েই তার রয়েছে সুন্দর, সুস্পষ্ট, যথার্থ ও বিজ্ঞনসম্মত দিক নির্দেশনা। ইসলামে ভেজাল একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। তাই ভেজাল বলতে কেবল পণ্য সামগ্রীতে বর্জ্যপদার্থ, ভিনজাতীয় পদার্থ বা বিষ মিশানোকেই বুঝায় না। বরং ব্যবসায়িক লেন-দেন তথা ক্রয়-বিক্রয়ে বস্তুর দোষ-ক্রটি গোপন করা, ওজনে কম দেয়া, মিথ্যা তথ্য দেয়া, ধোঁকা দেয়া, আসল কথার বিপরীত করা, ভালো মানের পণ্যতে নিম্নমানের পণ্য মিশ্রণ দেয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করা ইত্যাদি ভেজালের অন্তর্ভুক্ত। আর খাদ্যসামগ্রী ও পণ্য সামগ্রীতে এ ধরনের ভেজাল দেয়া ইসলামে হারাম বা নিষেদ্ধ। ভালো কোন কিছুর সাথে মন্দ কোন কিছু মেশানোকে মহান আল্লাহ্ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর বাণী- হে আহলে কিতাবগণ! ‘মূলত তাওরাত এবং ইঞ্জিল কিতাবের অনুসারী তথা মূসা এবং ঈসা আ. এর অনুসারীগণকে আহলে কিতাব বলা হয়’। কেন তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে সংমিশ্রিত করছো এবং সত্যকে গোপন করছো, অথচ তোমরা তা জান। ইসলাম পূত-পবিত্র পণ্যসামগ্রী ও খাদ্যসামগ্রী এবং মানুষের জন্য যা কল্যাণকর তা হালাল বা বৈধ করেছে। আর যেসব খাবার অকল্যাণকর তা হারাম বা অবৈধ ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ্র ঘোষণা- হে মানব জাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা হতে তোমরা আহার কর এবং শয়তানের অনুসরণ করোনা। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রæ। আল্লাহ তোমাদেরকে যে হালাল ও উৎকৃষ্ট জীবিকা দিয়েছেন তা হতে ভক্ষণ কর এবং ভয় কর আল্লাহকে, যাঁর প্রতি তোমরা মু’মিন। হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু হতে আহার কর ও সৎকর্ম কর; তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত। তিনি তাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল ঘোষণা করেছেন এবং যাবতীয় অপবিত্র বস্তু হারাম করেছেন।
আল-কুরআনের উপরিউক্ত আয়াতগুলোতে জীবিকা তথা ভোগের ব্যাপারে ‘হালাল’ ও ‘তায়্যিব’ বা পবিত্র এ দু’টি নীতি উল্লেখ করা হয়েছে। ভোগের ক্ষেত্রে খাদ্যদ্রব্য পবিত্র হতে হবে। পবিত্র ও সুস্বাদু খাদ্য যেমন স্বাস্থ্যেও জন্য উপকারী, অনুরূপ অপবিত্র ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্য তেমনি স্বাস্থ্যেও জন্য ক্ষতিকর। তাই পবিত্র ও পরিচন্ন খাদ্যসমগ্রী ভোগ করতে হবে। রসূলুল্লাহ স. বলেন, “পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক”।
পবিত্র ও স্বাস্থ্যকর খাবারের সাথে ভেজাল মিশিয়ে অপবিত্র ও অস্বাস্থ্যকর খাবার তৈরী করা, বিভিন্ন বর্জ্যপদার্থ এমনকি রোগাক্রান্ত হওয়ার মত দূষিত উপকরণ মিশিয়ে খাদ্য ও পণ্য সামগ্রী তৈরী করা অপরাধমূলক কর্মকাÐের অন্তর্ভূক্ত। যারা এসকল কাজ করে তারা দেশ ও জাতির বড় মত্রæ। ইসলামের দৃষ্টিতে এরা মস্তবড় পাপী ও অপরাধী। কেননা এটি একটি হারাম কাজ। এভাবে ধোঁকা ও প্রতারণার মাধ্যমে হালাল পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল মিশিয়ে তা হারাম করার সকল পন্থা ইসলামে নিষিদ্ধ। তা ক্রয়-বিক্রয় হোক কিংবা অন্যান্য মনবীয় ব্যাপারেই হোক, কোন ক্রমেই জয়িয নয়। ইসলামের দাবী হচ্ছে, সব ব্যাপারেই মুসলিম সততা ও ন্যায় পরায়ণতা অবলম্বন করবে।
খাদ্য ও পণ্য সামগ্রী নষ্ট করা, হালাল খাবারে হারাম উপাদান মিশিয়ে তা হারাম করা, ব্যবসায় মিথ্য বলা, ওজনে কম দেয়া, অত্যধিক প্রশংসা বা কসম করে পণ্য বিক্রি করা ইত্যাদি ইসলামের বাণিজ্যনীতি পরিপন্থি। যারা বিভিন্ন কৌশলে খাদ্য ও পণ্য সামগ্রীতে ভেজাল মিশিয়ে ব্যবসা করে তার গুরুতর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়। এ কারণে ইসলাম তাদেও এহেন অপরাধের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে বিভিন্ন রকমের শাস্তির বিধান ঘোষণা করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, তারা আল্লাহ এবং বিশ্বাসীদেরকে ধোঁকা দেয়। অথচ তারা নিজেদেরকেই ধোঁকা দেয়, কিন্তু তারা তা অনুভব করতে পারেনা।
এতদ সম্পর্কিত একটি হাদীস থেকে জানা যায়, “একদিন রসূলুল্লাহ স. এক স্তুপ খাদ্যের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় স্তুপের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলেন এবং খাদ্যে আর্দ্রতা অনুভব করলেন। অতঃপর বললেন, হে শস্যের মালিক! এমনটি কেন? মালিক বলল, বৃষ্টির পানিতে এমন হয়েছে। এরপর রসূলূল্লাহ স. বললেন, যে ব্যাক্তি প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নয়”। এভাবে প্রতারণা করে কিংবা ধোঁকা দিয়ে পণ্য সামগ্রী বিক্রি করা ভেজালের নামন্তর। কেননা উভয় ক্ষেত্রেই পণ্যের আসল রূপ গোপন রাখা হয়।
ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বস্তুর দোষ-ত্রæটি গোপন করার অপরাধ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ স. বলেন, যখন কোন দু’ব্যাক্তি স্বচ্ছতা ও সততার মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় করল, তখন তাদের এ বেচাকেনার মধ্যে কল্যাণ দান করা হয়। আর যদি তারা বিক্রিত বস্তুর দোষ-ত্রæটি গোপন করে এবং মিথ্যা কথা বলে তবে তাদের সে ক্রয়-বিক্রয়ের কল্যাণ (বরকত) উঠিয়ে নেয়া হয়। যারা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার খাদ্য ও পণ্য সামগ্রীতে ভেজাল মেশায়, মিথ্যা তথ্য দিয়ে পণ্য বিক্রি করে, ওজনে কম দেয়, প্রতারণা করে তারা ইসলামের দৃষ্টিতে পাপী, জঘন্য অপরাধী, আর পার্থিব জীবনে তারা দেশ ও জাতির শত্রæ। এ ধরনের ব্যবাসায়ীদের সম্পর্কে রসূলুল্লাহ স. বলেন, কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহাপাপী রূপে উত্থিত হবে। তবে সে সব ব্যবসায়ী নয়, যারা আল্লাহকে ভয় করবে, সৎভাবে লেনদেন করবে, সততার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করবে। ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন। হাকিম এটিকে সনদের দিক থেকে সহীহ বলেছেন, যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন। মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী সনদটিকে হাসান বলেছেন; অন্য একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, “নিঃসন্দেহে ব্যবসায়ীরা পাপিষ্ঠ। তখন সাহাবা কিরাম রা. জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহ কি ব্যবসাকে হালাল করেননি?” রসূলাল্লাহ স. জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু তারা কথায় কথায় মিথ্যা বলে এবং শপথ করে গুনাহে লিপ্ত হয়।
মহান আল্লাহ মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত করে সৃষ্টি করে কল্যাণকর কাজ করতে এবং অকল্যাণকর কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অন্যতম উপাদান হল খাদ্য ও পণ্যসামগ্রী। ইসলাম মানুষের জন্য পূত-পবিত্র, হালাল খাদ্য ও পণ্যসামগ্রী গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, হে মানব জাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পাবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা হতে তোমরা আহার কর এবং শয়তানের পাদাঙ্ক অনুসরণ করোনা। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রæ। পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল দিয়ে মানুষকে ঠকিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা নিঃসন্দেহে অপরাধ ও পাপের কাজ। এহেন কর্মকাÐ পরিহারের নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। যে কেউই শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, তাকে তো শয়তান নির্লজ্জতা ও মন্দ কাজেরই আদেশ করবে। আমি কত জনপদকে ধ্বংস করেছি, যার অধিবাসীরা ছিল পাপী এবং তাদের পর সৃষ্টি করেছি অন্য জাতি। মানবসমাজে সৃষ্ট বা প্রচলিত অন্যায়, অপরাধ, দুর্নীতি গুটিকয়েক লোক করে থাকে। আর এর ফলভোগ করে সমাজর সকলেই। তাই এহেন কর্মকাÐ প্রতিরোধ করা সমাজের সকলেরই দায়িত্ব। পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল দেয়া একটি জঘন্য সামাজিক অপরাধ। সমাজের মানুষ যদি তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা না করে তাহলে সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ বিষয়ে রসূলুল্লাহ স. বলেন, সেই মহান সত্তার কসম, যার হতের মুঠোয় আমার জীবন, তোমরা অবশ্যই ন্যায়ের আদেশ করবে এবং অন্যায় দুস্কৃতিতে বাধা দিবে। যদি তা না কর, তবে অচিরেই আল্লাহ তাআলা তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদেও প্রতি আযাব নাযিল করবেন। তারপর তোমরা তাঁকে ডাকবে, কিন্তু তোমাদের ডাকে সাড়া দেয়া হবেনা। ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
বাংলাদেশে পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল প্রতিরোধ করার জন্য মানুষের বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের মানসিকতা পরিবর্তন অত্যান্ত জরুরী। কেননা মুনাফার অতিমাত্রায় লোভ তাদের অন্তরকে কলুষিত করে তুলেছে। তাদের অন্তঃকরণ ঈমানের আলোকে আলোকিত করে পূত-পবিত্র করা দরকার। এ বিষয়ে রসূলুল্লাহ স. বলেন, সাবধান! তোমাদের দেহের মধ্যে এক টুকরো মাংস রয়েছে। যখন তা বিশুদ্ধ হয় তখন সমস্ত দেহটাই বিশুদ্ধ হয়, আর যখন তা কলুষিত হয় তখন সমস্ত দেহটাই কলুষিত হয়। আর তা হচ্ছে অন্তঃকরণ।
পণ্যে ভেজাল দেয়া ধোঁকা বা প্রতারণার অন্তর্ভূক্ত। তাই যেসব লেনদেনে ধোঁকা বা প্রতারণা নিহিত রয়েছে রসূলুল্লাহ স. সেসব প্রতারণামূলক লেনদেন নিষিদ্ধ করেছেন। যেমন, পাথরের টুকরো মিশিয়ে বস্তু বা পণ্য কেনা-বেচা করা। পণ্যে ভেজাল দিয়ে ধোঁকা বা প্রতারণার মাধ্যমে কেনা-বেচা করা ইসলামে নিষিদ্ধ। এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ স. -এর ঘোষণা, “যে ধোঁকা দেয় ও প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”
সমাজকে অন্যায়, অপরাধ ও দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য ইসলাম পার্থিব শাস্তিকে যথেষ্ট মনে করেনি। তাই মানুষের মন-মানসিকতা পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে ইসলামী বিধি-বিধানের আলোকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসমাজে ইসলামের উন্নত ও মহান চারিত্রিক গুণাবলীর বিকাশ সাধনে সর্বতœক নির্দেশনা দিয়েছে। ইসলাম মানুষের হৃদয়ে ঈমানের বীজ বপন করে তাকে কল্যাণমুখী বানিয়ে তার মধ্যে অপরাধ ও দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। আর প্রকৃত ঈমান ও একনিষ্ট দৃঢ় প্রত্যয়ই হচ্ছে সুদৃঢ় দুর্গ, নির্লজ্জতা ও হারাম কাজ অবলম্বনের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ।
উপরন্ত একজন সত্যিকারের মুসলিম জানেন ও বিশ্বাস করেন যে, তিনি যা কিছুই করেন মহান আল্লাহ সে বিষয়ে পুরোপুরি অবহিত। কারও কোন অপরাধ নোকজনের নিকট অজানা থাকলেও আল্লাহর নিকট কোন কিছুই গোপন থাকে না। কেউ যদি অপারাধ করে দুনিয়ার শাস্তি থেকে নিস্তার পেয়েও যায়, তবুও পারলৌকিক শাস্তি থেকে সে কিছুতেই রেহাই পেতে পারে না। একজন মুসলিমের এহেন বিশ্বাস মানবসমাজে অন্যায়, অপরাধ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধক। কাজেই কোন মানুষ যদি ইসলামের সত্যিকারের শিক্ষা গ্রহণ করে, তাহলে তার দ্বারা পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল দেয়া সম্ভব নয়। বর্তমান বিশ্বেও অনুন্নত দেশগুলোতে ভেজাল একটি বড় রকমের সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। যার কবল থেকে আমাদের প্রিয় মাতৃভ’মি বাংলাদেশও মুক্ত নয়। এ দেশে ভেজাল মেশানোর প্রবনতা অসাধু ব্যবসায়ীদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। অসৎ ব্যবসায়ী সর্বদাই স্বল্প পূঁজিতে এবং স্বল্প সময়ে অত্যাধিক মুনাফা অর্জন করতে চায়। এ কারণে তারা নীতি-নৈতিকতা মেনে ব্যবসা-বাণিজ্য করে না।
(চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন