বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

জালাল উদ্দীন রূমী [রহ.] : সংক্ষিপ্ত জীবন কথা

ধা রা বা হি ক

| প্রকাশের সময় : ২১ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রুহুল আমিন খান
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দর্শনকাব্য মসনবী শরীফের প্রণেতা হযরত মাওলানা মুহাম্মদ জালালউদ্দীন রূমী (রহ.) সেকালের রোম সাম্রাজ্যের অন্তর্গত, খোরাসান অঞ্চলের বলখ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম তারিখ ৬০৪ হিজরী সনের ৬ই রবিউল আউয়াল। তাঁর পিতার নাম মুহাম্মদ। তিনি বাহাউদ্দীন ওলাদ নামে বিখ্যাত ছিলেন।
মাওলানা রূমীর প্রকৃত নাম মুহম্মদ। উপনাম জালাল উদ্দীন। তিনি ‘খোদাওয়ান্দগার’ অর্থাৎ আল্লাহ ওয়ালা খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন। মাওলানা রূমী হিসাবেই তিনি সু-প্রসিদ্ধ।
পিতার দিক তেকে মাওলানা রূমী ছিলেন ইসলামের ১ম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (র.) এবং মাতার দিক থেকে ৪র্থ খলীফা হযরত আলী (রা.)-এর বংশধর। দুই পবিত্র রক্তধারার তিনি ছিলেন সার্থক উত্তরসূরী।
মাওলানা রূমীর বংশ পরম্পরা
(১) জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ, (২) মুহাম্মদ বাহাউদ্দীন ওলাদ আহমদ হুসাইন, (৩) মাহমুদ, (৪) মাউদুদ, (৫) সাবেত, (৬) মুসাইয়্যেব (৭) হযরত আবু বকর (রা.), মাওলানা রূমীর দাদী ছিলেন খোরাসানের বাদশা আলাউদ্দীনের কন্যা। একদা বাদশা আলাউদ্দীন স্বপ্নযোগে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ প্রাপ্ত হন যে, তুমি তোমার কন্যাকে আহমদ হুসাইনের (রূমীর দাদা) নিকট বিবাহ দাও। আহমদ হোসাইন ছিলেন প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন ও বড় মাপের বোযর্গ। বাদশা অবিলয়ে স্বপ্নে প্রাপ্ত সুসংবাদ আহমাদ হুসাইনকে জানালে তিনি সানন্দে তা গ্রহণ করেন এবং শাহ্যাদীর সাথে তাঁর শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। তাঁরই গর্ভে জন্ম নেন মাওলানা রূমীর পিতা আহমাদ হুসাইন (র.)। মাত্র ১০ বছর বয়সে আহমাদ হুসাইনের পিতৃ বিয়োগ ঘটে। অত্যন্ত মেধাবী আহমাদ হুসাইন দ্বীনী ইলমে পারদর্শিতা অর্জন করে গোটা খোরাসানে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। খোরাসানের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে তাঁর সুনাম ও সুখ্যাতি। অনায়াসেই তিনি প্রদান করতেন জটিল সমস্যাবলীর সমাধান। তাঁর প্রদত্ত ফতোয়া ও ফায়সালা সর্বমহলের বিশেষজ্ঞ উলামায়ে কেরাম সাগ্রহে ও পরম শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করতেন। জীবনীকাররা বর্ণনা করেছেন, মাওলানা বাহাউদ্দীন স্বপ্নযোগে বিশ্বনবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে ‘সুলতানুল ওলামা’ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন।
এই মহান পিতার ঔরষেই জন্ম গ্রহণ করেন সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিককবি মাওলানা জালাল উদ্দীন রূমী।
বলখ থেকে হিজরত
হিজরী ৬১০ সনের দিকে খোরাসান এলাকায় মোঘলদের আক্রমণ শুরু হলে শেখ বাহাউদ্দীন পরিবার-পরিজন নিয়ে বলখ থেকে হিজরত করেন। কোন কোন জীবনীকার খাওয়ারিজম শাহের অনভিপ্রেত আচরণকেও এই হিজরতের অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। সে যাই হোক, বলখ ত্যাগ করে তারা নিশাপুরে উপনীত হন। এখানে তারা প্রখ্যাত ওলীয়েকামিল শেখ ফরীদুদ্দীন আত্তার (র.)-এর দরবারে হাযির হন। শেখ আত্তার বালক মাওলানা রূমীর চেহরায় আধ্যাত্মিকতার আলোচ্ছটা প্রত্যক্ষ করে সস্নেহে তাকে কাছে টেনে নেন এবং বলেন, ‘একদা এই বালক আল্লাহ-প্রেমের দাবালন সৃষ্টি করবে’। তিনি তাঁকে স্বরচিত ‘আসরারনামা’র একটি কপি উপহার দেন। নিশাপুর থেকে তারা ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র বাগদাদে পৌঁছেন। এখানে তাদের সাথে প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন শেখ শেহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর সাক্ষাত হয়। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে তারা পবিত্র মক্কা মোয়াজ্জামায় উপনীত হন এবং হজ্জ্ব পালন করেন। সেখান থেকে আবার তারা সফর শুরু করেন এবং সিরিয়ার ‘লামাতিয়ায়’ উপনীত হন। এই ‘লামাতিয়ায়’ তারা ৪ বছর অবস্থান করেন। পুনঃ সেখান থেকে তারা সেলজুক শাহদের অন্যতম শহর ’লারেন্দ’ পৌছেন এবং ৭ বছর তথায় অবস্থান করেন।
সাদী মোবারক
বাল্যাবধি বিভিন্ন দেশে সফর সত্তে¡ও মাওলানা রূমীর জ্ঞান আহরণে কখনো ছেদ পড়েনি, যোগ্য ও বিজ্ঞ পিতার সাহচর্যে থেকে তিনি কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, ইলমে কালাম ও দর্শন শাস্ত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রগাঢ় পাÐিত্য অর্জন করেন। ইতোমধ্যে তাঁর বয়স ১৮ বছরে উপনীত হয়। পিতার ইচ্ছানুযায়ী তিনি লারেন্দের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা ‘গওহার খাতুনে’র সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। বিবাহের প্রথম বছরেই তাদের ১ম সন্তানের জন্ম হয়। নবজাতক পুত্রের নামকরণ করা হয় দাদার নামের সাথে মিল রেখে ‘বাহাউদ্দীন’। গওহার খাতুনের গর্ভে মাওলানা রূমীর আরও দুটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তাদের নামকরণ করা হয় যথাক্রমে আলাউদ্দীন ও মুযাফ্ফর উদ্দীন।
কৌনিয়ায় বসবাস
সেলজুক বংশের দ্বাদশ শাসক সুলতান আলাউদ্দীন (৬১৬-৬৩৪ হি.) পূর্ব রোম আক্রমণ করলে মাওলানা বাহাউদ্দীন স্বপরিবারে লারেন্দ ত্যাগ করে বর্তমান তুরস্কের ‘কৌনিয়া’ নামক স্থানে এসে স্থায়ী ভাবে বিাস স্থাপন করেন। এখানে দু’বছর অতিবাহিত হলে মাওলানা বাহাউদ্দীন (রহ.) ইন্তেকাল করেন। মাওলানা রূমীর বয়স তখন ২৪ বছর। পিতার ইন্তেকালের পরে তিনি তাঁর স্থলাভিসিক্ত হন এবং পুরো ১ বছর প্রখ্যাত বোযর্গ সৈয়দ বুরহান উদ্দীন মুহাক্কিক তিরমিযীর সংসর্গে কাটান। অতঃপর তাঁর পরামর্শক্রমে দামেশ্ক সফরে যান। দামেস্কে অবস্থানকালে মাওলানা সেখানকার উলামা মাশায়েখদের সাথে মিলিত হয়ে শরীয়ত ও মারিফতের ইলমে পূর্ণতা লাভ করে কৌনিয়ায় ফিরে আসেন। তিনি পিতার অন্তিম ওসিয়ত ও সুলতানের অনুরোধক্রমে কৌনিয়ায় শিক্ষাদান কার্য পরিচালনা করতে থাকেন। কৌনিয়ার সুলতান গহওর তাজ ছিলেন মাওলানার একান্ত গুণমুগ্ধ ভক্ত। তিনি মাওলানার খেতাবী নাম অনুযায়ী ‘খোদান্দেগার মাদরাসা’ নামে এক বিশাল মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তারই হাতে এ মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। মাওরানা রূমী অত্যন্ত দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে সুদীর্ঘ ২৮ বছর ধরে অধ্যাপনা ও মাদরাসা পরিচালনার খিদমত আঞ্জাম দেন। একই সাথে মসজিদে ইমামতী, খানকায় ওয়াজ নসীহত এবং অন্যান্য কাজও চালিয়ে যেতে থাকেন। এ সময়ে আধ্যাত্মিক জগতের এক মহান সাধক হযরত শামসুত্তারীযের সাথে বিস্ময়কর ভাবে পরিচয় ঘটলে মাওলার জীবন সম্পূর্ণ পাল্টে যায় এবং দার্শনিক রূমীর আবির্ভাব ঘটে। ঘটনাটি অত্যন্ত চমৎকার।
মাওলানা রূমীর সাথে শায়খ শামসুত্তাবরীযের মুলাকাত
শায়খ শামসুত্তাবরীয (রহ.) ছিলেন নিভৃতচারী, সংসার বিরাগী এক মহান ওলী। নিজেকে গোপন রাখাই ছিল তাঁর প্রকৃতি। আনুমানিক ৬০০ হিজরীতে তিনি আজারবাইজানের তাবরীয নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ণ নাম মুহাম্মদ শামস। তাবরীযের অধিবাসী বলে তাঁকে তাবরীযী বলা হয়। বাল্যকাল থেকেই তিনি বিভুপ্রেমে বিভোর থাকতেন। তাঁর পিতা শায়খ কামাল খাজান্দীও ছিলেন একজন কামিল বুযর্গ। প্রথমে তিনি তাঁর কামিল পিতার নিকট থেকেই তরিকতের তালীম নেন। পরে প্রখ্যাত ওলী শায়খ আবু বকর তাবরীযী (র.)-এর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। শায়খের সাহচর্যে থেকে তিনি আধ্যাত্মিকতার উচ্চস্তরে পৌঁছেন। অতঃপর দেশ ভ্রমণে বহির্গত হন এবং দামেশ্ক,জর্দান, রূম পরিভ্রমণ করেন। ৬৪২ হিজরীতে তিনি রূমের কৌনিয়ায় উপনীত হন।
কস্তুরী-উত্তাপে কস্তুরীধারী হরিণ যেমন প্রমত্ত দিশেহারা হয়ে পড়ে তেমনি ইশকেইলাহী-কস্তুরীর উত্তাপ ও সুরভীমত্ত দরবেশ শামসুত্তাবরীযও মাতোয়ালা হলেন এই মহার্ঘ্য বৈভবের উপযুক্ত দোসর লাভের তাড়নায়। মাওলানা রূমীকেই মনে মনে স্থির করলেন সেই ইপ্সিত পাত্র এবং স্বয়ং গিয়ে উপস্থিত হলেন তাঁর কুতুবখানায়। মাওলানা রূমী তাঁর বিশাল লাইব্রেরীতে গভীর অধ্যয়নে মশগুল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Abu Rayhan ১৬ জুলাই, ২০১৯, ১:০৭ পিএম says : 0
রুমি (রঃ) এর চেঙ্গিয খানের সাথে যে যুদ্ধ হয়েছালো তা থাকলে ভালো হতো ।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন