বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সীতাকুন্ডে পাহাড় ধসে ৩ শিশুসহ একই পরিবারের ৫ জন নিহত

মাটিচাপা থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয় ৫ জনকে

| প্রকাশের সময় : ২২ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম


চট্টগ্রাম ব্যুরো ও সীতাকুন্ড সংবাদদাতা : টানা বৃষ্টির পর চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে পাহাড় ধসে একই পরিবারের ৩ শিশুসহ ৫ জন নিহত হয়েছে। গতকাল (শুক্রবার) ভোরে জঙ্গল সলিমপুরে এই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। আরও ৫ জনকে মাটিচাপা থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। মর্মান্তিক এই পাহাড় ধসে নিহতরা হলেন- স্থানীয় অটোরিকশা চালক রফিকুল ইসলামের স্ত্রী বিবি ফাতেমা (৩৫) ও তার ছেলে মো. ইউনূস (১০), রফিকের বোন রাবেয়া (৩৬) এবং তার দুই মেয়ে সামিয়া (৭) ও লামিয়া (০২)। এছাড়া রফিকুল ইসলাম, তার ছোটভাই গিয়াস উদ্দিন, রফিকের মেয়ে জান্নাত (১৪) ও সালমাকে (১১) মাটি সরিয়ে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেছেন স্থানীয়রা। সীতাকুন্ড থানার এএসআই তাজুল ইসলাম জানান, রাতভর টানা বর্ষণের পর ভোরে সীতাকুন্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় পাহাড় ধসের এ ঘটনা ঘটে।
এর আগে ১১, ১২ ও ১৩ জুন মওসুমি নিন্মচাপের প্রভাবে ভারি বর্ষণে পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খগড়াছড়ি ও কক্সবাজারে অন্তত পৌনে দুইশ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সীতাকুÐে পাহাড় ধসে প্রাণহানীর পর পর চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার কয়েকটি উপজেলায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূণ্যভাবে বসবাসকারীদের সরে যেতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী সকালেই এই নির্দেশনা দেন। সীকুÐের জঙ্গল সলিমপুরসহ আরও কয়েকটি এলাকায় এখনও শত শত মানুষ পাহাড় মৃত্যুঝঁকিতে রয়েছে।
সীতাকুÐের পাহাড় ধস প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম ভূইয়া জানান, সলিমপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর সলিমপুর ওয়ার্ডের বিরি হাট এলাকায় পাহাড়ের খাস জমিতে বেশ কিছু বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। এসব বসতিকে স্থানীয়ভাবে আলাদা আলাদা ‘সমাজ’ নামে ভাগ করা হয়েছে। মূলত দরিদ্র বিভিন্ন পারিবার সেখানে থাকেন, যাদের একটি অংশ বিভিন্ন পোশাক কারখানায় কাজ করেন। ওই এলাকার তিন নম্বর সমাজের লক্ষণ সাহা শাখায় ভোরে পাহাড় ধসের এ ঘটনা ঘটে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের এক আত্মীয় জানান, ভোরের আগে আগে পাহাড় ধসে ঘরের ওপর পড়লে ভেতরে সবাই চাপা পড়েন।
এর মধ্যে একজন ঘরের বেড়া ভেঙে বেরিয়ে এসে স্থানীয়দের খবর দিলে তারা উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। স্থানীয় প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আসার আগেই মাটি সরিয়ে পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করেন তারা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (ট্রেনিং) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোশাররফ হোসেন ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, পাহাড়টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। এর মধ্যে খাড়া ঢালে টিনের ঘর বানানো হয়েছিল। পাহাড় ধসে ঢাল দিয়ে নামা মাটি সরাসরি ঘরের ওপর পড়েছে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল এলাকায় অন্তত ৬০ ফুট উঁচু একটি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় টিলায় রফিকের টিনের চালার ঘরটি নির্মাণ করা হয়েছিলো। দুই কক্ষের ছোট এই ঘরটির পেছনেই ছিলো একটি উঁচু পাহাড়। এই পাহাড়টির চারপাশ থেকে কেটে ঘর নির্মাণের কারণে এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়েছিলো। সমতল ভুমি থেকে ঐ ঘরে যাতায়াত করাও কঠিন। বৃহস্পতিবার বৃষ্টি শুরু হলে উঁচু কাটা পাহাড়টির একটি বিশাল অংশের মাটি খসে পড়ে। এতে ঐ ঘরটি ভেঙে দুমড়ে গেলে ভেতরে থাকা সবাই হতাহত হন।
প্রত্যক্ষদর্শী রফিকের প্রতিবেশি মোঃ বাচ্চু ও মোঃ রতন বলেন, যখন পাহাড়টি রফিকের ঘরের উপর ধসে পড়ে তখন তাদের চিৎকার শুনলেও প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে আমরা পাহাড়ে উঠে তাদেরকে সাহায্য করতে পারছিলাম না। বৃষ্টি থামতে থামতে ভোর ৪টা বেজে যায়। পরে আমরা অনেকে সেখানে গিয়ে মাটি সরানোর কাজ শুরু করি। পাহাড় ধসে ভেঙে পড়া ঘরের মালিক মোঃ রফিক বলেন, এখানে সবাই এভাবেই বসবাস করছে। আমিও তাদের মতই ঘর নির্মাণ করে বাস করছিলাম। আমি স্ত্রী, ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে থাকি। দেড় মাস আগে নোয়াখালী থেকে আমার বোন রাবেয়া বেগম তার দুই মেয়ে নিয়ে বেড়াতে আসে। ঘরে ছিলো আমার ভাই গিয়াস উদ্দিনও।
অন্যদিনের মত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে আমরা খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ি। বাইরে তখন প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। ভোররাতে হটাৎ বিকট শব্ধে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি ঘর আমাদের উপর চাপা পড়েছে। আহত অবস্থায় বহু কষ্টে আমি, আমার ভাই হাফেজ গিয়াস উদ্দিন, মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস ও সালমা কোনক্রমে বের হলেও অন্যরা সবাই মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকে। এসময় আমরা চিৎকার শুরু করলে ও প্রবল বৃষ্টির কারণে কেউ এই পাহাড়ে উঠতে পারছিলো না। ভোর ৪টার দিকে বৃষ্টি কমে আসলে এলাকাবাসী পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ ও এলাকার মানুষ আমার স্ত্রী, ছেলে, বোন ও দুই ভাগনির লাশ উদ্ধার করে।
ঘর চাপায় অপর আহত ব্যক্তি রফিকের ভাই হাফেজ গিয়াস বলেন, সেই মহূতের কথা মনে পড়লে শিউরে উঠছি। হটাৎ ঘুম ভেঙে দেখি সব অন্ধকার। শরীরের উপর চাপা পড়েছে ঘর। কোনক্রমে অন্ধকারে হাতরে পথ খুঁজতে গিয়ে দেখি বড় ভাই চিৎকার করে কাঁদছে। পরে কোনক্রমে বের হয়ে আসি আমরা। শেষে পুলিশ ও গ্রামের মানুষ পাহাড়ের মাটি সরিয়ে ভেতর থেকে সবার লাশ উদ্ধার করে। উদ্ধার তৎপরতায় যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসও। সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে বুধবার রাত থেকে সীতাকুন্ডে চলছিল ভারি বর্ষণ।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৩৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়, যা ১১ জুন রাঙামাটির রেকর্ডের চেয়েও বেশি। ওই দিন রাঙামাটিতে ৩৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। টানা ভারী বর্ষণে রাঙামাটিসহ চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচ জেলায় পাহাড় ধসে পৌনে দুইশ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রতিবছর প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রাম অঞ্চলে একদিনে ১২৯ জনের মৃত্যু হয়। এর পরের বছর ১৮ আগস্ট নগরীর এ কে খান এলাকায় পাহাড় ধসে ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুন নগরীর বাটালি হিলে পাহাড় ধসে মারা যায় ১৭ জন। ২০১৩ সালের ২৫-২৬ জুন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-বান্দরবান-রাঙ্গামাটি ও সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যায় ৯৪ জন। ২০১৫ সালের ২৬ ও ২৭ জুন কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসে প্রাণ হারায় আরও ১৯ জন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
সবুজ ২২ জুলাই, ২০১৭, ৩:০৭ এএম says : 0
হে আল্লাহ পাহাড়ে এবং এর আশেপাশে বসবাসকারী মানুষদের তুমি রক্ষা করো।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন