মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পণ্যে ভেজাল মিশিয়ে পরিমাপে ও ওজনে কম দিয়ে, প্রতারণা করে, মজুদদারী করে, নিষিদ্ধ ও হারাম মিশিয়ে বিক্রি করে, অসাধু উপায়ে মানুষকে ঠকিয়ে মুনাফা অর্জন করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। মানুষের অধিকার, জনস্বার্থ, জনস্বাস্থ্য সর্বোপরি মানুষের জীবন তাদের কাছে একেবারেই তুচ্ছ বিষয়। অথচ আমাদের দেশের শতকরা নব্বই জন ব্যবসায়ী মুসলিম। তারা সালাত আদায় করেন, রোযা রাখেন, হজ্জ করেন। অনেকে যাকাতও দেন। যাদের মধ্যে এমন ধর্মীয় চেতনা ও মূল্যবোধ বিরাজমান, তারা কিভাবে ব্যক্তি স্বার্থ চিরতার্থ করার জন্য বিভিন্ন কৌশলে পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল মেশান? নিম্নমানের পণ্যকে ‘এক নম্বর’ বলে চালিয়ে দিয়ে প্রতারণা করেন? খাদ্য-পণ্যে ক্ষতিকর কেমিক্যাল, বিস্ফোরক দ্রব্য, রং ও অরুচিকর উপাদান মেশান? বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক। বাংলাদেশের হাট-বাজার, মার্কেট ও বিপণি বিতানগুলো ভেজাল পণ্যে সয়লাব হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা পরকালের মুক্তি ও সাফল্য লাভের চাইতে দুনিয়ার জীবনের সাফল্য ও ভোগ-বিলাসকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে তাদের ঈমানের ভিত্তি ও শক্তি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় পরিবর্তন অত্যান্ত জরুরী। আর এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক ইসলামী জ্ঞান চর্চা, গণসচেতনতা ও ইসলামের বিধি বিধানগুলোর প্রচারণা। সরকারি-বেসরকারি ও সমম্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এহেন প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব বলে আমরা বিশ্বাস করি।
বাংলাদেশে পণ্যে ভেজাল প্রতিরোধে সরকারকে সর্বাতœক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। জনস্বার্থ রক্ষার্থে সরকারকে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় সংসদের সদিচ্ছাটাই দেশের জনগণের দুর্দশা ঘোচানোর জন্য বড় প্রভাব ফেলতে পারে। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন অত্যন্ত জরুরী। বি.এস.টি.আই-এর কার্যক্রম শক্তিশালী করা ও সারা বছর বাজারে তাদের কার্যকর নজরদারি অব্যহত রাখা। এ ক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য সরকার দু’ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। প্রথমত, খাদ্য ও পণ্য ভেজাল ও বিষাক্রিয়ার চরম ভয়াবহতার দিকগুলো জনসাধারণকে অবহিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভেজাল ও বিষমিশ্রণের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার মতো যথেষ্ট আইন প্রণয়ন এবং তার যথাযথ প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে। ভেজাল ও বিষমিশ্রণকে আইনের দৃষ্টিতে চরম অপরাধমূলক কাজ হিসেবে চিহ্নিত কওে ভোক্তা অধিকার আইন এবং সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিতকরণ যতদিন না আমাদের দেশে হবে, ততদিন পণ্যে ভেজাল চলতেই থাকবে। এ ছাড়া পণ্য ভেজাল প্রতিরোধে ভেজালবিরোধী অভিযান জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে সারা বছর এ অভিযান অব্যহত রাখতে হবে।
বাংলাদেশে পণ্য ও খাদ্যসামগ্রীতে ভেজাল প্রতিরোধের লক্ষ্যে আগ্রাসী, অতি দ্রæত মুনাফাভিত্তিক ব্যবসায়িক ধারার এবং ব্যবসায়িক-রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হওয়া অতি জরুরী। ব্যবসায়ীদের সামাজিক দায়বাদ্ধতার কথা মনে রেখে সৎভাবে মুনাফা অর্জনের সদিচ্ছা করতে হবে। বর্তমান বিশ্বে গণমাধ্যম জনস্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যান্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে থাকে। পণ্য ও খাদ্যে ভেজালের ঘটনাগুলোকে গণমাধ্যম কর্মীরা বিভিন্ন মিডিয়াতে পরিবেশন করতে পারেন। পাশাপাশি মিডিয়াগুলোকে ‘ফলো-আপ রিপোর্ট’ করতে হবে। অর্থাৎ পণ্যে বা খাদ্যে ভেজাল ও বিষমিশ্রণসহ যে কোন অপরাধ সংগটিত হওয়ার পর থেকে শুরু করে তার শেষ পরিণতি পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে লেগে থেকে লাগাতার সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। যেটি আমাদের মিডিয়া জগতের একটি বড় দুর্বলতা। সংঘটিত এ ধরনের অপরাধের ধারাবাহিক সংবাদ যদি পরিবেশন করা যেত, তাহলে দর্শক বা শ্রোতা সরকারের প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ সবাই পুরো ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারতো। এতে একদিকে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেতো, অন্যদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহের দায়িত্বশীল লোকজনের মধ্যে তৎপর থাকার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হতো। এর ফলে নিশ্চিয়ই একটি দীর্ঘমেয়াদী সুফল আমরা পেতাম।
বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতি সচেতন। এদেশে অসংখ্য রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে, যারা তৃণমূল পযৃন্ত সর্বস্তরের জনসাধারণের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। তাই রাজনৈতিক সংগঠনগুলো পণ্যে ভেজালের নানাবিধ ক্ষতিকর দিক জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে পারেন। ভেজাল মিশ্রণ বন্ধে জনগণকে সচেতন করে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে পারেন। সর্বোপরি রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে দেশ শাসন করে। তাই পণ্যে ভেজাল প্রতিরোধে রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা অত্যন্ত জরুরী এবং ফলপ্রসূ হবে বলে আমরা মনে করি। আমরাই প্রতিনিধিত্ব করছি সমাজের, এই দেশের। আমাদেও দেশে অসংখ্য সামাজিক সংগঠন রয়েছে যারা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণে কাজ করে। আমাদের চিন্তা-চেতনা, মননশীলতা দিয়ে সমাজকে ভেজাল ও দুষণমুক্ত করা আমাদেরই দায়িত্ব। তাই সামাজিকভাবে একজন ভেজাল মিশ্রণকারী চোর-ডাকাতের মতো হেয় করলে, তার সঙ্গে পরিবারিক সম্পর্ক স্থাপন না করলে, তাকে বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক এবং পারিবারিক অনুষ্টানে না ডাকলে পরিবর্তন হতে বাধ্য।
জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান হয়েছে। আমাদের ও আমাদের সন্তানদের শরীর-স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যত রক্ষার জন্য পণ্যে ভেজালকারবারীদের বিরুদ্ধে যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ গণপ্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলি, তা অবশ্যই সফল হবে। তাই বাংলাদেশের পণ্যে ভেজাল প্রতিরোধ ব্যক্তিগত পর্যায় হতে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সর্বস্তওে সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এক্ষেত্রে জনসাধারণের করণীয় হলো- ১. খাদ্য এবং পণ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া; ২. পণ্যে ভেজাল রোধে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় পক্ষকে সচেতন করা; ৩. ভোক্তা অধিকার বা ক্রেতার অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হওয়া; ৪. সিটি কর্পোরেশন, মিউনিসিপালিটি, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে সক্রিয় ও নিয়মিতভাবে দায়িত্ব পালন করা; ৫. সাময়িকভাবে নয়; বরং সারা বছর ভেজালবিরোধী অভিযান সৎ ও দক্ষ লোকের (ম্যাজিস্ট্রেট) মাধ্যমে পরিচালনা করা; ৬. বি.এস.টি.আই-এর যথাযথ দয়িত্ব পালন এবং সর্বদা বাজার তদারকি করা; ৭. সকল ব্যবসায়ীকে সৎভাবে ব্যবসা পরিচালনা করা।
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্য শুধু অর্থোপার্জনের একটি মাধ্যম নয়, এটি মানবসেবার অন্যতম একটি মাধ্যম। এ কারণে ব্যবাসা- বাণিজ্য সম্পর্কিত বহুবিধ তথ্য পবিত্র কুরআন ও হাদীসে উপস্থাপিত হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত পদ্ধতিগুলোর শরীআসম্মত নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে, ইসলাম কীভাবে ক্রেতা বিক্রেতা এবং ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেও সর্বাদিক কল্যাণ নিশ্চিত করেছে। সুতরাং আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য পণ্যসামগ্রীতে যেভাবে ভেজাল মিশিয়ে কেনা-বেচা করা হচ্ছে তা জনসাধারণের সাথে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ধরণের ব্যবসায় ইসলামে সর্ব¦স্থায় হারাম। একজন মুমিন-মসলিম ব্যবসায়ী এহেন হারাম ব্যবসা পরিত্যাগ করে হালাল ব্যবসা পরিচালনা করবেন, এটাই আমরা আশা করি। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যদি সৎভাবে ব্যবসা পরিচালনা করেন, ক্রেতাসাধারণ যদি সটিক পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে সচেতনতা অবলম্বন করেন, সর্বোপরি সরকারি ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যদি তাদেও দায়িত্ব-কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেন, তাহলে বাংলাদেশে পণ্যে ভেজাল প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন