অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান : সুফী সাধকদের শুভাগমনের মাধ্যমে এ উপমহাদেশে পরম করুণমায় আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের মনোনীত ধর্ম ‘দ্বীন ইসলাম’ এর প্রচার প্রসার ঘটেছে। আর এ মহান কর্তব্য পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন নায়েবে রাসূলগণ বিশেষ করে প্রিয় নবীর পূতঃপবিত্র বংশধরগণ অর্থাৎ আওলাদে রাসুলগণ। আমরা জানি যে, গরীবে নেওয়াজ আতা’য়ে রাসুল হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তি রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি উপমহাদেশে প্রথম দ্বীন ইসলাম প্রচার করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আরো শতবর্ষপূর্বে ৪০০ হিজরি সনে হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র বংশধর হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ গীসুদারাজ আওয়াল রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি আফগানিসÍান ও পাকিসÍানের পার্বত্য সীমান্ত এলাকায় ইসলাম প্রচার শুরু করেন এবং এ বিশাল পার্বত্য এলাকাজুড়ে তাঁরই বুজুর্গ আওলাদগণ বসতি স্থাপন করেন। উমাইয়া শাসকদের নির্মম জুলুম-অত্যাচার থেকে নিজেদের এবং পবিত্র দ্বীন-ইসলামের হিফাজত করার ঐতিহাসিক প্রয়োজনে আফগানিসÍান ও পরে পাকিসÍান সীমান্তে এসে বসতি স্থাপন করেন প্রিয় নবীর অনেক বংশধর।
প্রিয় নবীজির ৩৮তম অধঃসÍন পুরুষ উপমহাদেশের প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক সুন্নীয়ত আন্দোলনের কান্ডারী মসলকে আ’লা হযরত-এর প্রচার প্রসারের অন্যতম পথিকৃৎ গাউসে জমান কুতুবুল আকতাব রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরীক্বত হাদ্বীয়ে দ্বীন ও মিল্লাত হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ ছিরিকোটি রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হির ৫৭তম সালানা ওরশ মুবারক ১১ই জিলক্বদ ১৪৩৮ হিজরি আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর ফয়ুজাত হাসিলের উদ্দেশ্যে এ মহাপুরুষের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও কার্যক্রম উল্লেখ করার প্রয়াস।
পাকিসÍানের হাজারা জিলার হরিপুর (শেতালুশরীফ) সিরিকোট’র নবী বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৮৫৭ সালে আওলাদে রাসুল হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ ছদর শাহ’র ঔরসে জন্ম নেন জমানার গাউস হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ, পিতা-মাতা উভয়েই ছিলেন আমাদের প্রাণপ্রিয় নবীয়ে পাক হযরত মুহাম্মদ মোসÍফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়াহি ওয়াসাল্লাম-এর বংশধর। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কুরআনের হিফজ্ সমাপ্ত করে তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন আরবি মাদ্রাসায় ‘ইল্মে মা’কুলাহ’ (বুদ্ধিবৃত্তিক শিক্ষা) ও ‘ইলমে মানকুলাহ্’ (কুরআন হাদিস শিক্ষা) শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১২৯৭ হিজরি মোতাবেক ১৮৮০ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপনান্তে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমান। দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি সেখানে অতিবাহিত করেন। এ সময় একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং দেশে তিনি ‘আফ্রিকাওয়ালা’ নামে অভিহিত হন। ড: ইব্রাহিম মাহ্দি লিখিত দঅ ঝযড়ৎঃ যরংঃড়ৎু ড়ভ গঁংষরসং রহ ংড়ঁঃয অভৎরপধ’ নামক ঐতিহাসিক গ্রন্থে দেখা যায় তিনি সফল ব্যবসায়ীই ছিলেন না, উপরন্তু, সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে একজন সফল ইসলাম প্রচারক ও প্রথম জামে মসজিদ নির্মাণকারী হিসেবেও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এ মহামনীষী। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত জামে মসজিদ ও দ্বীনি মিশনের তত্ত¡াবধানে তাঁর ভাই সৈয়্যদ মুহাম্মদ ইউসুফ শাহ্ ১৯১১ সালে সপরিবারে আফ্রিকায় হিযরত করেন। ক্যাপটাউন, জাঞ্জিবার মোম্বাসা প্রভৃতি শহরে দীর্ঘ ১৬ বছরব্যাপী ইসলাম প্রচার-প্রসারে নিজেকে উৎসর্গ করেন। দেশে ফিরে তিনি কোন কাজে মনস্থির করতে পারছিলেন না। কি এক না পাওয়ার তীব্র বাসনা তাড়া করে ফিরছে। এসময় তাঁর বিদুষী সহধর্মিনী হযরত সৈয়্যদা খাতুনের অনুপ্রেরণায় ও উৎসাহে হরিপুরের বাসিন্দা সেযুগের গাউসে জমান এল্মে লুদুন্নীর প্রস্রবন হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুলাহি আলায়হি’র নিকট যেতে রাজি হলেন। এ সময় এ মহান সাধকের সান্নিধ্য লাভের আশায় হরিপুর গমন করলেন।
হরিপুর বাজারে তিনি একটি কাপড়ের দোকান খুলে ব্যবসা শুরু করেন। এক সময় হযরত চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলায়হির সাক্ষাত লাভের উদ্দেশ্যে যান। আলাপ পরিচয়ের পর তিনি হুযূরের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করলেন। হযরত চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ’র নিকট জানতে চাইলেন তিনি কি করেন? হরিপুর বাজারে একটা কাপড়ের দোকান রয়েছে বলায় হযরত চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেন, আমার লোকদের বলব যে হরিপুর বাজারে আমার একটা দোকান আছে, তোমরা সেখানে কেনা-কাটা করো। একথার মধ্যেই পরবর্তী অধ্যায়ের সূচনা লক্ষ্য করা যায়। কাপড়ের দোকানের মালিক হলেন ছিরিকোটি ছাহেব, আবার চৌহরভী ছাহেব বলছেন তাঁর দোকান। পরবর্তীকালে রেঙ্গুনে অবস্থানরত মুরীদের নিকট শেষ চিঠিতে হযরত চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি একটি ফারসি কবিতার আবৃত্তি করেছিলেন যার বাংলা অর্থ “তুমি আমি হলে, আমি হলাম তুমি, আমি শরীর হলাম আর তুমি হলে প্রাণ’। ‘কেউ আর না বলে যেন তুমি আর আমি পৃথক সত্তা”। যখন সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলায়হি পীরের অবর্তমানে তাঁর অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, ইঞ্জিন থেকে বগি আলাদা হয়ে গেলে বগির অবস্থা কি হবে? এ কথার প্রত্যুত্তরে উপরোক্ত কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন হযরত চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি। পীর মুরীদ সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়ে গেল। ফয়ুজাত পাওয়া শুরু হলো, পীরের মাদ্রাসায় কয়েক বছর পাঠদান করলেন। পীরের ছোহবতে আসার অল্প দিনের মধ্যেই ব্যবসা লাটে উঠলো, পীরের আদেশ হল “লঙ্গরখানার জন্য কাঠ যোগাড় করে আনতে’’। এবার রিয়াজতের পালা। সকলেই কানাঘুষা করতে লাগল এরকম একজন মাওলানা, ব্যবসায়ী, পন্ডিত ব্যক্তিকে হুজুর কেবলা কাঠ সংগ্রহের কাজে লাগালেন। নির্দেশদাতা ও নির্দেশ পালনকারী এর গুঢ় রহস্য বুঝতে পেরেছেন। তাই বিনা বাক্য ব্যয়ে পীরের আদেশে লঙ্গরখানার জন্য কাঠ সংগ্রহের কাজে লেগে গেলেন হুজুর সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ রহ.। দীর্ঘ সময় যাবৎ বহু দূর থেকে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে লঙ্গরখানায় কাঠ সরবরাহ করেছেন এক নাগাড়ে। এভাবে কঠোর সাধনার ফলে পীরের নিকট হতে ‘তাওয়াজ্জুহ’ লাভ করেন। পীর সাহেব চার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনে গিয়ে দ্বীন ইসলাম এর প্রচার করার নির্দেশ দিলেন। যে কথা সে কাজ। কোন অজুহাতে বা কোন রকম সুবিধা অসুবিধা বা পরিবার পরিজনের কথা তাঁর মনে কোন রকম দাগ কাটেনি। বিনা বাক্যব্যয়ে পুনরায় দেশান্তরিত হলেন পীরের ইচ্ছে বাসÍবায়নের উদ্দেশ্যে। ১৯২০ সালে তিনি রেঙ্গুন গমন করে সেখানকার বাঙালি মসজিদ নামে খ্যাত মসজিদে ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব নেন। তাঁর আকর্ষণীয় নূরানী চেহারা শরীয়ত তরীকত হাকীকত মারেফত প্রভৃতি বিষয়ে পান্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান লক্ষ্য করে মুসল্লীরা ক্রমশঃ হুযূর ক্বিবলার সান্নিধ্যে আসা শুরু করলো। তিনি প্রথম কয়েক বৎসর পীর সাহেব ক্বিবলা হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি) শানমান ও অলৌকিক জ্ঞান সম্বন্ধে ওয়াজ নসিহত করতেন। স্থানীয় মুসল্লীরা তাঁকে বাইয়াত করানোর জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে দিলে তিনি তাঁর মুর্শিদের নিকট এর একটা সমাধান চাইলেন। হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী তাঁর নিকট একটি রুমাল পাঠালেন। রুমালে এক প্রান্ত নিজ হাতে রেখে অপরপ্রান্ত মুরিদের হাতে ধরা অবস্থায় বাইয়াত করানোর নির্দেশ প্রদান করা হয়। কিছুকাল পর তাঁকে খেলাফত ও ইজাজত দিয়ে বাইয়াত করানোর অনুমতি দান করা হয়। দলে দলে নবী অলি প্রেমিকরা বাইয়াত হতে থাকল। এ সময় চট্টগ্রামের বহু লোক জীবিকার সন্ধানে রেঙ্গুন তথা সমগ্র বার্মায় অবস্থান করছিল। দৈনিক আজাদী ও কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আবদুল খালেক, সুফী আবদুল গফুর, ডা. মোজাফফরুল ইসলাম, আবদুল মজিদ সওদাগর, মাস্টার আবদুল জলিলসহ চট্টগ্রামের বেশ কিছু লোক হুযূর ক্বিবলার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। গাউসে জমান হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি) একটি অলৌকিক অদ্বিতীয় ৩০ পারা দুরূদ শরীফ সম্বলিত মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) রচনা করেন। বিশ্বে পবিত্র ক্বোরআন মজীদ ও পবিত্র বোখারী শরীফের পর তৃতীয় ৩০ পারার গ্রন্থ হচ্ছে এ অলৌকিক দুরূদ শরীফ। হুযূর খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী শুধু ক্বোরআন পড়তে শিখেছিলেন, লিখতে তিনি পারতেন না। এই দুরূদ শরীফ লিখতে সুদীর্ঘ ১২ বছর ০৮ মাস ২০ দিন সময় লেগেছে। এ অলৌকিক রচনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘প্রিয় নবী রহমাতুল্লিল আলামীন হতে শুনে এ দুরূদ শরীফ লেখেছি। ইহার রচনা শৈলী, বাক্য বিন্যাস করণ অতি উঁচুমানের ও তুলনাহীন। এটা খতমের মাধ্যমে পাঠ করলে যে কোন নেক মাকসুদ বাসÍবায়িত হয়। এই অদ্বিতীয় কিতাবখানা ছাপিয়ে প্রচার করা এবং দারুল উলুম ইসলামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসার জন্য সৈয়্যদ আহমদ শাহ্(রহ.)কে অর্থ সংগ্রহের নির্দেশ দিলেন। আরো বললেন, যতদিন এ কাজ সমাধা না হয় ততদিন রেঙ্গুন ত্যাগ করে কোথাও যাবে না। আপন পীরের নির্দেশ মানা ফরজে আইন এ কথা অনুধাবন ও বিশ্বাস করতেন বলে হুযূর ক্বিবলা সৈয়্যদ আহমদ শাহ রহমাতুল্লাহি আলায়হি দীর্ঘ ১৬ বছর দেশে যাননি। এমনকি তাঁর প্রিয় প্রথম সন্তান সৈয়্যদ মুহাম্মদ সালেহ’র ইন্তেকালের খবর পেয়েও পীরের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে দেশে যাওয়া হয়নি। সোবহানাল্লাহ। চট্টগ্রামের ভাইয়েরা এমনকি ইমামে আহলে সুন্নাত হযরত গাজী শেরে বাংলা আল্লামা আযিযুল হক আল্কাদেরী সাহেব রেঙ্গুন সফরে গেলে হুযূর ক্বিবলার সাথে দেখা করে চট্টগ্রাম আসার অনুরোধ করেন। ১৯২৫ সালে তিনি পীরের নামে আনজুমানে শুরায়ে রহমানিয়া নামক একটি সংগঠন করেন। শরিয়ত-ত্বরীকতের যাবতীয় কার্যাদি এর মাধ্যমেই তখন সম্পন্ন হতো। ১৯৩৬ সালে ১৬ বছর পর তিনি স্বদেশে যান। ইতোমধ্যে হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি) ইন্তেকাল করেন (ইন্না....রাজেউন)।
স্বদেশ যাবার পথে তিনি কিছুদিনের জন্য প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামে অবস্থান করেন ভাইদের অনুরোধে। সে সময় থেকেই চট্টগ্রামের মানুষ হুজুর ক্বিবলার সাথে পরিচিত হয় এবং সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়া ত্বরিকায় হুযূর ক্বিবলার হাতে বাইয়াত গ্রহণ শুরু হয়। ১৯৪১ সালে সুদীর্ঘ ২১ বছর রেঙ্গুনে শরীয়ত ত্বরিক্বতের খেদমত করার পর হুজুর বিদায় নিয়ে স্বদেশে ফিরে যান। প্রতি বছর চট্টগ্রাম সফর শুরু করেন তখন থেকেই। ১৯৫৮ সালে চট্টগ্রাম সফরকালে আনজুমানে শুরায়ে রহমানিয়া’র নাম পরিবর্তন করে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া রাখা হয়। পরে এটা ট্রাস্ট হিসেবে নিবন্ধিত হয়।
(চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন