বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

যমযম কূপ : বেহেশতি ফোয়ারা

| প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুহাম্মাদ মুয়াজ্জম হোসাইন সিদ্দীকী : আল্লাহ তাআলার অসংখ্য নিদর্শনের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ‘যমযম’ ক‚প। আর তার অবারিত নেয়ামতরাজির মধ্যে জমজমের পানি হলো আরো অন্যতম। যে নেয়ামত কখনোই ফুরাবার নয়। পবিত্র মক্কা ও কা’বার সাথে সংশ্লিষ্ট হযরত ইবরাহিম আ. এর স্মৃতিধারণে যতগুলো নিদর্শন আছে যমযম ক‚প তার মধ্যে একটি। এজন্য হজ্জের সময় হাজীদের কৌত‚হলের একটি দৃষ্টিও থাকে এ ক‚পটির প্রতি। সকলেই উৎসুক হন এ কূপটির উৎস ইতিহাস জানতে। সাথে পান করেন তৃপ্তি সহকারে। হাদিয়া হিসেবে নিয়ে আসেন শুভাকাক্সিক্ষদের জন্য।
এ ক‚পটি আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে সৃষ্টি হয়েছিলো। পবিত্র কা’বা থেকে মাত্র ২০মিটার দূরে অবস্থিত ৩০মিটার গভীরের এ ক‚পটির ইতিহাস অনেকেরই অজানা নয়। হযরত ইবরাহিম আ. স্বীয় পুত্র ইসমাইল আ. ও স্ত্রী হাজেরা আ. কে জনমানবহীন এখনকার মক্কা নগরীতে রেখে এসেছিলেন। তাদের সাথে থাকা আহার্য ও পানীয় শেষ হওয়ায় পানির আশায় সাফা মারওয়ায় সাতবার দৌঁড়াদৌঁড়ি করেও মা হাজেরা যখন কোনো পানি পেলেন না, পুত্র ইসমাইলকে বাঁচাতে তখন পেরেশান হয়ে পড়লেন। ঠিক তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত জিবরাইল আ. এর পাখার আঘাত থেকে সৃষ্টি হলো এক অলৌকিক ক‚প। বের হয়ে আসতে লাগলো পানির ¯্রােতধারা।
মা হাজেরা পানির ¯্রােতধারা আটকানোর জন্য চারিদিকে বাঁধ তৈরি করতে লাগলেন। জিবরাইল আ. বললেন, আপনি পানিকে এ অবস্থায় ছেড়ে দিন। কেননা এটিতো কুদরতী-প্রসবণ ¯্রােতধারার পানি। সহীহ বুখারির হাদীসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তাআলা হযরত ইসমাইল আ. এর মায়ের ওপর রহম করুন! তিনি যদি যমযমকে ঐভাবে ছেড়ে রাখতেন তাহলে যমযম ক‚পটি প্রবহমান ঝর্ণায় পরিণত হতো।”(সহীহ বুখারি, হা.নং-৩১৮৪)
জনমানবহীন এলাকায় পানির সন্ধান পেয়ে জুরহুম নামের একটি গোত্রের লোকজন সেখানে বসতি শুরু করে। পরবর্তীতে তাদের সাথে মা হাজেরা ও ইসমাইল আ. এর পারিবারিক সম্পর্ক হয়। যমযম ক‚পের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে ন্যস্ত হয়। এভাবে চলে দীর্ঘদিন। আস্তে আস্তে জুরহুম গোত্রের লোকজন নানা অপরাধে লিপ্ত হওয়ায় আল্লাহ তায়ালার এ মহান নেয়ামত যমযম ক‚প তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে যমযম কূপটি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের কিছুকাল পূর্বে খাজা আব্দুল মোত্তালিব স্বপ্নের মাধ্যমে এ কূপটি আবিষ্কার ও খননের নির্দেশনা পান। অবশেষে পুত্র হারেসকে নিয়ে তিনি ক‚পটি খনন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এ ক‚প খননকে কেন্দ্র করে আব্দুল মোত্তালিব তার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামের আব্বাজান আব্দুল্লাহকে কুরবানি করার মানত করেছিলেন। অবশেষে আব্দুল্লাহর বিনিময়ে ১০০ উট তিনি কুরবানি করেন। সে অনেক লম্বা ঘটনা। আলোচ্য প্রবন্ধে উক্ত ঘটনা বর্ণনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
যমযম কূপটি কা’বাঘরের অতি সন্নিকটে অবস্থিত। বর্তমানে এটি মাতাফের ১.৫৬ মিটার নিচে ঢাকা পড়ে আছে। বায়তুল্লাহর তাওয়াফকারীদের সুবিধার জন্য মাতাফ অঙ্গনকে প্রশস্ত করার কারণে মূলত এর উপরিভাগকে শ্বেত পাথর দ্বারা ঢেকে ফেলা হয়েছে। এটি মাকামে ইবরাহীমের বাম পার্শে মাতাফের মেঝের তলে অবস্থিত। কিছুদিন পূর্বেও যমযম কূপে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো। ক‚প বরাবর সোজা উপরে ‘বী’রে যমযম’ (যমযম ক‚প) লেখা ছিলো। একটি গোলাকার শ্বেত পাথর এটিকে নির্দেশ করার জন্য যমযম ক‚প বরাবর উপরে রাখা ছিলো। বর্তমানে মাতাফে তার কোনো চিহ্ন রাখা হয়নি। তবে মাতাফের শেষ প্রান্তে বেজমেন্টে ক‚পটিতে যাওয়ার পথ রাখা হয়েছে যা কেবল যমযম কর্তৃপক্ষের প্রবেশের জন্যই অনুমোদিত।
যমযম ক‚পের নাম কেন যমযম হলো। এ নিয়ে অনেক বর্ণনা রয়েছে। যমযম শব্দের অর্থ পর্যাপ্ত, প্রচুর। সূচনার পর এর থেকে কত পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হয়েছে, আর কি পরিমাণ পানি মজুদ আছে আজ পর্যন্ত কোনো গবেষক, কোনো বিজ্ঞানী এ তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি। পারবেই বা কেমন করে। এ যে মহান প্রভুর অসীম দান। এ যে জান্নাতের অফুরন্ত নেয়ামতের অংশ জান্নাতী নহরের ¯্রােতধারা। যা কখনোই ফুরাবার নয়। আর এ কারণেই একে যমযম বলা হয়।
যমযম শব্দের আরেক অর্থ থামিয়ে দেয়া। যেহেতু মা হাজেরা আ. এ ক‚পের চারপাশে বাঁধ দিয়ে যমযমের গতিকে থামিয়ে দিয়েছিলেন তাই একে যমযম বলা হয়।
কোনো জিনিসের নাম বেশি হওয়া তার মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে। যমযম নাম ছাড়াও এ বরকতময় নেয়ামত কূপটির আরো অনেক নাম থাকা সে বিষয়টি ইঙ্গিত করে। আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবনে বাররী এ ক‚পের ১২ টি নাম উল্লেখ করেছেন। ‘তাজুল আরুস মিন জাওয়াহিরিল কামুস’ অভিধানের লেখক আল্লামা মুরতাদা আল যাবিদী বিভিন্ন হাদীস ও অভিধানের কিতাব থেকে এ ক‚পের ৫৪ টি নাম উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বারাকা ওয়া মুবারাকাহ (বৃদ্ধি), বাররাহ (কল্যাণ), বুশরা (শুভসংবাদ), হাফেরা (আব্দুল মোত্তালিবের গর্ত), রকদা (জিবরাইল আ. এর পায়ের আঘাত), আর রওয়া (অজ¯্র পানির প্রবাহ), সুকইয়া (তৃষ্ণা নিবারণ), তআ’মুল আবরার (আল্লাহ ওয়ালাদের পানীয়), তুকতাম ওয়া মাকতুম (গোপন), হরমিয়া (হরম এলাকাভুক্ত), যমযম (অজ¯্র বারিধারা), সাবিক (অগ্রগামী), সালেমা (নিরাপদ), সিকায়াতুল হাজ্জ (হাজীদের তৃষ্ণা নিবারণকারী), সাইয়েদা (সর্দার), শাব্বাআ’তুল আইয়াল (পরিবারের তৃপ্তিদানকারী), শরাবুল আবরার (নেককার ব্যক্তিদের পানীয়), শিফাউ সুকমিন (রোগমুক্তি), সাফিয়া (পরিষ্কার), তাহেরাহ (পবিত্র), তআ’মু তু’মিন (ক্ষুধা নিবারণকারী), আশশুবাআ (পরিতৃপ্তিদানকারী), তাইয়েবাহ (জীবানুমুক্ত), জাহিরাহ (প্রকাশ্য উপকারী), আসিমাহ (রক্ষাকারী), আফিয়া (বালামুক্ত), ইসমাহ (বেঁচে যাওয়া), ‘আওনা (সাহায্য), গিয়াস (ফরিয়াদ বা সাহায্য), কাফিয়া (যথেষ্ট), লা তুনযাফ ওয়ালা তুযাম্মু ( অনন্ত প্রবাহ) ইত্যাদি
যমযম হলো পৃথিবীর বুকের সর্বশ্রেষ্ঠ পানীয়। জান্নাতী ঝরণাধারাসমূহের একটি ঝরণা। হযরত ইবরাহিম আ. এর দুআর ফসল। তাই এর বৈশিষ্ট্য ও ফযিলতেরও অন্ত নেই। পবিত্র হাদীসে বর্ণিত এর ফযিলত, বৈশিষ্ট্য, বরকত ও বাহ্যিক কার্যকারিতার কারণে মুসলমান বলতে সবার কাছেই এ পানি অত্যধিক প্রিয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যমীনের বুকে সর্বোত্তম পানি হলো যমযম। এতে রয়েছে ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাবার এবং রোগের চিকিৎসা।”
আল্লামা সায়িদ বাগদাশ তার ‘ফাযায়েলে মায়ে যমযম’ কিতাবে যমযম পানির ২৩টি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন, জান্নাতী ঝরণাসমূহের একটি ঝরণা, ইবরাহিম আ. এর দুআর ফসল, মক্কা মুকাররমার জীবন রক্ষাকারী পানীয় যমযম, হরম শরীফে আল্লাহর অপূর্ব নিদর্শন, এ বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত, পৃথিবীর মধ্যে সর্বোত্তম পানীয়, পানকারীর উদ্দেশ্য সফল হওয়া, জিব্রাঈল আ. এর মাধ্যমে প্রকাশ, জমিনের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র ভ‚মিতে এর অবস্থান, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কলব মোবারকে ব্যবহৃত পানীয়, এমন পানীয় যার মধ্যে প্রিয় নবীর থুতু মোবারকের বরকত রয়েছে, খাদ্যের উপাদান সম্বলিত পানীয়, জ্বর মাথাব্যাথা রোগের উপশম, চোখের জ্যোতি বৃদ্ধিকারক, ঈমানী শক্তিবর্ধক ও মুনাফেকী চরিত্র বিনাশক, নেককার মানুষের পানীয়, যমযম পানির দিকে দৃষ্টি দেয়া ইবাদত, শরিরের শক্তিবর্ধক, স্বর্ণের চেয়েও দামী ইত্যাদি
এছাড়াও যমযমের পানি সম্পর্কে অসংখ্য বৈশিষ্ট্য ও ফযিলত বর্ণিত হয়েছে। সে কারণে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে অদ্যাবধি অনেক ওলামা-সাধারণ এর দ্বারা বরকত লাভ করেছেন। এ প্রসঙ্গে সত্যাসত্য সহীহ দ্বয়ীফ অনেক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়।
তবাকাতে ইবনে সা’দ কিতাবের একটি হাদীসে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু যর গিফারী রা. ইসলাম গ্রহণ করে যখন মক্কায় এসেছিলেন, তখন তিনি শুধু যমযমের পানি পান করে ৩০ দিন কাটিয়েছেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র. যমযমের পানি পান করতেন এবং এর দ্বারা মুক্তি কামনা করতেন। পানি পান শেষে তিনি পানি দু’হাতে এবং চেহারায় মুছতেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে মুসিলম আদ দাইনাওয়ারী র. বলেন, আমি একটি দলের সাথে পবিত্র হজ্জের সফরে ছিলাম। এই দলে একজন পক্ষাঘাতের রোগী ছিলো। আমি মক্কা শরীফে গিয়ে দেখলাম যে, সে সুস্থ হয়ে তাওয়াফ করছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি সুস্থ হলে কিভাবে? লোকটি আমাকে বলল, “আমি যমযম ক‚প থেকে পানি সংগ্রহ করে আমার সাথে থাকা একটি পাত্র ধুয়ে কয়েকটি আয়াত লিখলাম। এবং এ দুআ করলাম যে, হে আল্লাহ! আপনার নবী বলেছেন, “যমযমের পানি যে উদ্দেশে পান করা হবে সে উদ্দেশ্য পূরণ হবে।” আল কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে শিফা হিসেবে এবং মুমিনদের জন্য রহমত হিসেবে। আপনি আমাকে রোগ থেকে মুক্তি দান করুন। আমি আমার পাত্রে উক্ত আয়াতগুলো যমযম পানির সাথে মিশিয়ে পান করেছি। আল্লাহ তায়ালা এর বরকতে কোনো ঔষধ ছাড়াই আমাকে পক্ষাঘাত থেকে মুক্তিদান করেছেন।”
এছাড়াও আহমদ ইবনে আব্দুল্লাহ আশ শরিফী, ইয়েমেনের শীর্ষ আলেম আল্লামা আবু বকর আশ শানিনী, শায়খ আব্দুর রহমান ইবনে মুছলেহ উদ্দীন, ইমাম শা’রানী, শায়খ আব্দুর রশিদ ইবরাহিম আত তাতারী, ডা. শায়খ মুহাম্মাদ মাজহার প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম থেকে যমযমের পানি দ্বারা বরকত ও বিভিন্ন রোগমুক্তির ঘটনা বর্ণিত রয়েছে। এ রকম অসংখ্য ঘটনা রয়েছে জমজমের পানি দ্বারা বরকত ও ফায়দা লাভ করার। যা উল্লেখ করলে লেখনীর কলেবর বৃদ্ধি পাবে।
তবে এখানে প্রশ্ন আসতে পারে যমযমের পানির এতোই ফজীলত ও বরকতপূর্ণ, তবে আমাদের অনেকেই তো যমযমের পানি পান করি কিন্তু আমরা তো আশানুরূপ ফায়দা লাভ করছিনা। সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে আমাদের নিজেদের পরিশুদ্ধতার বিষয়টি, আমাদের নিয়তের বিষয়টি, আমাদের কলবের অবস্থার বিষয়টি। তাহলেই উত্তর পেয়ে যাবো। আর সব বরকত ও ফায়দা যে তাৎক্ষণিক লাভ হয় এমনও নয়। তবে বর্তমান যুগেও এমন অনেক বাস্তব ঘটনার জ্বলন্ত উদাহরণ রয়েছে যমযমের পানি দ্বারা রোগমুক্তি লাভের। তবে তা এখানে উল্লেখ করার ফুরসত নেই।
(চলবে)

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন