জুয়েল মাহমুদ
গত কয়েক বছর আগেও পিজে হার্টস আন্তর্জাতিক হল ছিল বিদেশি শিক্ষার্থীর পদভারে মুখরিত। এখন আর সেই অবস্থা নেই। হাতেগোনা কয়েক জন বিদেশি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে ঢাবিতে। আন্তর্জাতিক হলে বিদেশি শিক্ষার্থীর বদলে স্থান দখল করেছে ঢাবি’র ব্যাচেলর শিক্ষকরা। বিদেশিদের ভর্তির নির্ধারিত কোটা থাকলেও ছাত্র পাচ্ছে না বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আগমন ঘটলেও সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলার কারণে বিদেশি শিক্ষার্থী হারাচ্ছে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বলে মনে করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণ।
স্যার পি জে হার্টজ আন্তর্জাতিক হলের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন বিদেশি শিক্ষার্থীরা। সূত্রে জানা গেছে, ২০০১-০২ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ১৪ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৫০ জন বিদেশি শিক্ষার্থী সিটের আবেদন করেছেন।
দেশের একমাত্র আবাসিক ক্যাম্পাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষ থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত ছয়টি ব্যাচে ১০ হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। এর মধ্যে বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন মাত্র ৬ জন। তারা সবাই নেপালি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কখনোই দুই অঙ্ক অতিক্রম করেনি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক মনে করেন, অধিকাংশ বিভাগে বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা, বিদেশিদের জন্য পৃথক আবাসিক হল না থাকা এবং তাদের ভর্তির সুযোগ-সুবিধা, ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কোনো প্রচার না থাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী কম।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত ১৫ বছরে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৯ জন। তারা সবাই ইনস্টিটিউট অব ‹ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটে অধ্যয়ন করেছেন। কিন্তু এক যুগ ধরে চবিতে ভর্তি হচ্ছে না বিদেশি শিক্ষার্থীরা। এ বছরও শূন্য রয়েছে সংরক্ষিত ৭৮ আসন। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট খুলে দেখা গেছে, একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য এতে নেই। সাইটটি নিয়মিত আপডেটও করা হয় না। ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীরা চবির সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে জানতে পারছে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ৬ জুলাই পূর্ণ করবে প্রতিষ্ঠার ৬০ বছর। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বিদ্যাপীঠে প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত, যেখানে বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছে মাত্র ১ জন। এক সময় উচ্চতর কৃষি অধ্যয়নের জন্য ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা আসত। গত কয়েক বছরে এখানেও বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। জানা গেছে, ২০০৬ সালে পিএইচডিসহ বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল ২১ জন, ২০১৬ সালে তা হয়েছে ৮ জন।
এমন অবস্থা দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। ইউজিসির সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৭টিতে অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৩২ জন। আর বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিদেশি শিক্ষার্থী নেই বলে জানা গেছে। একই বছর ৭৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৮টিতে বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল ১ হাজার ৬৪৩ জন। এর মধ্যে সর্বাধিক ১ হাজার ২৬৫ জন অধ্যয়নরত ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামে (ইউএসটিসি)। মোট ৩০টি দেশের শিক্ষার্থীরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন।
ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার জন্য এদেশে আসা শিক্ষার্থীরা প্রধানত ৩০টি দেশ থেকে আসছে। দেশগুলো হলোÑ কানাডা, চীন, জর্ডান, অস্ট্রেলিয়া, মালি, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, ফিলিস্তান, আরব আমিরাত, আমেরিকা, কোরিয়া, ইরান, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, উগান্ডা, জাম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, লাইবেরিয়া, বৃটেন, ভিয়েতনাম, জাপান ও মালয়েশিয়া। সর্বাধিক বিদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রামে ১২৬৫ জন বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এ তালিকায় দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, গণবিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি। উপরে উল্লেখিত পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নরত বিদেশি ছাত্র সংখ্যা হলো- ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ডেফোডিল ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়।
নেপালি শিক্ষার্থী রনজিত মল্লিকের কাছে জানতে চাইলাম কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী দিন দিন কমছে, জবাবে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের দু’পক্ষের সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মারা যাওয়ার ঘটনায় আমি আতঙ্কিত। তিনি আরও বলেন, নেপাল থেকে পড়তে এসেছি উচ্চশিক্ষা লাভের আশায়। কিন্তু ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির বিভৎসরূপ আমাকে পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে শঙ্কিত করে তুলেছে। এসব নেতিবাচক কর্মকা- বর্তমানে বেশি হওয়ার কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী দিন দিন কমছে বলে তিনি জানান।
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের পরিচালক লুৎফর রহমান বলেন, দিন দিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। কারণ আমাদের শিক্ষার মান, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ এবং বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ফলে বিদেশি শিক্ষার্থী দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামে (ইউএসটিসি) কর্তৃপক্ষ বলেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর প্রতি যেভাবে যতœ নেয়া হয় সেটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় না। এছাড়া, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নানা নোংরা রাজনীতির কারণে মাসের পর মাস বন্ধ থাকে। যে কারণে সেশনজট হয়। এটা বিদেশি শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব ফেলে।
ঢাবি’র আইইআর-এর সহকারী অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, হিংসাত্মক ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি ও আধুনিক বিষয়ের অভাব এবং ভর্তি প্রক্রিয়ার জটিরতার কারণে দিন দিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি প্রফেসর নাসরিন আহমদ বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে অনেক সহজ, তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পাঠদান করানো হয় এবং সঠিকভাবে শিক্ষকরা ক্লাস পরীক্ষা না নেয়ার কারণে তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকছে।
তবে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তেমনভাবে নিজেদের তুলে ধরতে পারছে না তাদের সীমাবদ্ধতার কারণে। একই সাথে শিক্ষার মান ও জটিল ভর্তি প্রক্রিয়ার কারণে বিদেশি শিক্ষার্থী কম ভর্তি হচ্ছে। অন্যদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গণে তাদের পরিচিতি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সেমিনার ও বিদেশি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ক্রেডিট ট্রান্সফার চুক্তির কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদের মতে, প্রথমত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করানো হয় যেটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে করানো হয় না। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিকভাবে চাহিদা আছে সেসব সাবজেক্ট পড়ানো হয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ইউজিসি চেয়ারম্যান আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষামন্ত্রণালয় বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বেশি বৃত্তির ব্যবস্থা করলে এবং এই দেশে লেখাপড়ার জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করলে আরো বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী আসবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন