বাসায় ডেকে এনে বন্ধুকে গলা কেটে হত্যার পর প্রথমে বাথরুমে লাশ পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা। এরপর লাশ ড্রামে ভরে তাতে চুন আর অ্যাসিড দিয়ে সিমেন্টে ঢালাই। তারপর ওই ড্রাম ফেলে দেওয়া হয় দীঘিতে। একেবারে ঠান্ডা মাথায় এই ভয়ানক খুনটি করেন চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগ নেতা অমিত মুহুরী। এর আগে তিনি আরও বেশ কয়েকটি খুন করেছেন। বাকলিয়ায় এক ছাত্রলীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা করেন তিনি। তার আগে নগরীর সিআরবিতে টেন্ডারবাজিতে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীদের সাথে নিয়ে এক শিশু হাফেজসহ দুইজনকে গুলি করে হত্যা করেন অমিত মুহুরী।
তবে শুধুমাত্র স্ত্রীর সাথে পরকিয়া সম্পর্ক থাকতে পারে এমন সন্দেহে নিজের বন্ধুকে দাওয়াত দিয়ে এনে পাশবিক কায়দায় হত্যা করে লাশ ঘুমের ভয়ঙ্কর চেষ্টায় হতবাক খোদ পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাও। তারা বলছেন এমন ভয়ঙ্কর অপরাধী সমাজে খুব কমই আছে। গতকাল (সোমবার) তাকে গ্রেফতার ও পরবর্তি তদন্তকার্যক্রম নিয়ে প্রেসব্রিফিং করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কর্মকর্তারা। আরও খুনের রহস্য উদঘাটনে তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের কথা জানান তারা।
ওই খুনের পর চুল দাড়ি কামিয়ে ভদ্রবেশে কুমিল্লায় গিয়ে একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে রোগি হয়ে যান অমিত মুহুরী। ‘অপরাধ কখনো চাপা পড়েনা’- চেহারা বদল করলেও হাতে আঁকা উল্কির কারণে পুলিশের জালে আটকে যায় খুনসহ ১৩ মামলার এই ভয়ঙ্কর আসামি। ধরা পড়ার পর পুলিশের কাছে নির্মম এই হত্যাকান্ডের বর্ননাও দেন তিনি। এরপর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে খুনের দায় স্বীকার করেন অমিত মুহুরী। অমিত মুহুরী মহানগর যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের অনুসারী হিসাবে পরিচিত।
গত ১৩ আগস্ট নগরীর কোতোয়ালি থানার এনায়েত বাজার রানীর দিঘী থেকে সিমেন্ট ঢালাই করা ড্রামের ভেতরে থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। তদন্তে নেমে পুলিশ নিশ্চিত হয় ওই লাশ ইমরানুল করিম ইমনের। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানে। ইমনের আরও দুই বন্ধু ইমাম হোসেন মজুমদার ওরফে শিশির ও শফিকুর রহমান শফিকে আটকের পর অমিতকে খুঁজতে শুরু করে পুলিশ। কুমিল্লা থেকে ধরে আনার পর রোববার বিকালে চট্টগ্রামের মহানগর হাকিম মেহনাজ রহমানের আদালতে হাজির করা হলে অমিত হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, হত্যাকান্ড ঘটিয়ে পালিয়ে কুমিল্লায় চলে যান অমিত। সেখানে তিনি একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রেভর্তি হন। চুল দাড়ি কেটে বেশভূষা পাল্টে ফেলেন। পুলিশের কাছে থাকা ছবির সঙ্গে পুরোপুরি মেলানো না গেলেও গলার বাঁ পাশে ও ডান হাতে আঁকা উল্কির কারণে তদন্তকারীরা তাকে ঠিকই চিনে ফেলেন। শনিবার কুমিল্লার আদর মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে গ্রেফতার হন অমিত।
নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অমিত তার জবানবন্দিতে বলেছেন, তার স্ত্রীকে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করতেন ইমন। এ কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় এর আগে গ্রেফতার শিশির ও শফি নামের দুইজন আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছিলেন, গত ৯ আগস্ট নগরীর নন্দনকানন ৩ নম্বর গলির হরিশদত্ত লেইনে বেঙ্গল হোল্ডিংসের ষষ্ঠ তলায় অমিতের বাসায় ইমনকে হত্যা করা হয়। পরে ড্রামে ভরে চুন, এসিড দিয়ে সিমেন্ট ঢালাই করে সেই ড্রাম ফেলে দেওয়া হয় দিঘীর পানিতে।
শিশির ও শফি জানিয়েছে ইমন ছিলেন অমিতের বন্ধু। অমিতের বাসায় ইমন নিয়মিত যাতায়াত করতেন। অমিত তার স্ত্রীর সাথে ইমনের পরকীয়া আছে বলে সন্দেহ করেন। এরপর তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন অমিত। এই লক্ষ্যে ইমনকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে ডেকে আনা হয়। বাসায় আসার পর তাকে আটকে ফেলে অমিত। ইমনকে আটকে রেখে অমিত শিশির ও সফিসহ আরও কয়েকজনকে বাসায় ডেকে আনে। সবার সঙ্গে পরামর্শ করে ৯ আগস্ট ভোরে ইমনকে কুপিয়ে হত্যা করে লাশ বাথরুমে রেখে পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করে। তা না পেরে অমিত ও তার সহযোগীরা বাসায় ড্রাম, বালি, সিমেন্ট নিয়ে আসে। এসিড ও চুন দিয়ে ঢালাই ড্রামটি ১২ আগস্ট রাতে দিঘীতে ফেলে দেওয়া হয়। ইমন নিখোঁজের পর তার ছোট ভাই ইরফানুল করিম গত ২২ আগস্ট রাউজান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেন।
অমিত স্বীকার করে লাশ ড্রামে ভরে তাতে চুন আর অ্যাসিড দিয়ে সিমেন্টে ঢালাই করে দেওয়ার পর তার ধারনা ছিল লাশ দ্রুত পচে যাবে আর ড্রামটি ভাসবে না। কিন্তু ড্রামটি পানিতে ডুবো ডুবো অবস্থায় ভাসছিল। দীঘিতে গোসল করতে দিয়ে এক লোক ড্রামটি দেখে পুলিশে খবর দেয়। পরে পুলিশ ড্রাম উদ্ধার করে তা কেটে লাশটি বের করে। অমিত মুহুরীর বিরুদ্ধে সিআরবির জোড়াখুন ও ইমন খুনসহ মোট ১৩ টি মামলা আছে বলে পুলিশ জানায়। গত ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে ডিসি হিলে পুলিশের ওপর হামলা, বাকলিয়া এলাকায় ছাত্রলীগ নেতাকে গুলি করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে অমিতের বিরুদ্ধে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন