শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সদরঘাটে মগের মুল্লুক

নূরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ঈদ ফেরত যাত্রীরা ভাড়া ডাকাতির শিকার : সদরঘাট থেকে গুলিস্তানের বাস ভাড়া ১শ’ টাকা, হিউম্যান হলার ৫০ টাকা সিএনজি ৫শ’ টাকা
এ যেনো মগের মুল্লুক। সদরঘাট থেকে গুলিস্তান বাসের ভাড়া ১শ’ টাকা, হিউম্যান হলারের ভাড়া ৫০ টাকা। সিএনজি অটোরিকশায় উঠলেই ৫শ’ টাকা। ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে গত ১২ দিন ধরে এই অবস্থা চলছে। নৌপথে সদরঘাট দিয়ে আসা যাত্রীদেরকে অনেকটা জিম্মি করেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১ হাজার গুণ বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি মতে, স্থানীয় ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই), পেট্রল ইন্সপেক্টর (পিআই), জগন্নাথ পুলিশ বক্সের কতিপয় অসাধু পুলিশ ও কিছু অসাধু পরিবহন মালিক ও চালকদের নিয়ে গঠিত একটি ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট ভাড়া ডাকাতি করছে। সদরঘাট ট্রাফিট পুলিশের ইন্সপেক্টর কাজী আমিনুল ইসলাম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, ঈদে ঢাকায় ফেরা যাত্রীদের কাছে থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে এটা কিছুটা সত্য। তবে এর সাথে কোনো ট্রাফিক পুলিশ জড়িত নয় বলে তিনি দাবি করেন। ট্রাফিক ইন্সপেক্টর বলেন, সদরঘাটে ভোর থেকে হাজার হাজার যাত্রী নামে। সেই সব যাত্রীদেরকে নিয়ে বহু বাস এক সাথে ছাড়ে। আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না সবগুলো বাসে উঠে যাত্রীদের ভাড়ার খোঁজখবর নেয়া। তিনি বলেন, গত শনিবারও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের জন্য আমি নিজে ১৭টি বাসের দুই হাজার টাকা করে জরিমানা করেছি।
জানা গেছে, রাজধানীর সদরঘাট এলাকায় নৌপথে আসা যাত্রীদেরকে জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে ২০১০ সালে। সে সময় লঞ্চে আসা যাত্রীদেরকে যে কোনো গন্তব্যের জন্য বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বাবদ ২০ টাকা করে আদায় করা হতো। ভোর থেকে শুরু করে সকাল ৯টা-১০টা পর্যন্ত চলতো এভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়। সে সময় বাসের চালক, হেলপার ও কন্ডাক্টরের সাথে যাত্রীদের বাত-বিতন্ডা এমনকি হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। ২০১৫ সালের ঈদুল ফিতরে একই সিন্ডিকেট ২০ টাকা ভাড়া ৩০ টাকা বাড়িয়ে ৫০ টাকা করে। একই বছর ঈদুল আজহায় আরো ১০ টাকা বৃদ্ধি করে ৬০ টাকা করা হয়। গত বছর একই ভাড়া বহাল থাকার পর সিটিং সার্ভিসের বর্ধিত ভাড়া নিয়ে সরকার পিছু হটলে সিন্ডিকেট আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে গত ১২দিন যাবত একই সিন্ডিকেট তৎপর হয়ে যাত্রীদেরকে জিম্মি করে বাস ও মিনিবাস ভাড়া সর্বনিম্ন ১শ’ টাকা এবং হিউম্যান হলারে ভাড়া ৫০ টাকা করে আদায় করছে। একই সাথে সিএনজি অটোরিকশায় উঠলেই ন্যূনতম ভাড়া ৫শ’ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগি যাত্রীরা জানায়, সদরঘাটে ভোর থেকে দক্ষিণাঞ্চল থেকে আগত লঞ্চগুলো আসা শুরু করে। সে সময় যাত্রীরা বাসের সন্ধানে এক সাথে সদরঘাট টার্মিনাল থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে বাস বা হিউম্যান হলারের হেলপারদের হাঁক-ডাক শুনতে পায়। গন্তব্যের কথা জানিয়ে যাত্রীরা তাড়াহুড়া করে গাড়িতে ওঠে পড়ে। এরপরই যাত্রীদেরকে জানিয়ে দেয়া হয় অতিরিক্ত ভাড়ার কথা। তখন যাত্রীদের কেউ কেউ নেমে যেতে চাইলেও তাদেরকে নামতে দেয়া হয় না। জোর করে তাদেরকে গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়া হয়। বরিশাল থেকে আগত বেসরকারি চাকরিজীবকী বোরহান উদ্দিন বলেন, সদরঘাট টার্মিনালে নামলেই কুলিদের অত্যাচার। সেখানে কুলিরা জোর করে হাত থেকে ব্যাগ বস্তা ছিনিয়ে নেয়। এরপর টার্মিনালের বাইরে এসে দেড়শ-দুশ’ টাকা দাবি করে। এরপর বাসে বা সিএনজি অটোরিকশাতে উঠলেও জোর করে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আদায় করে। তিনি বলেন, আমি স্বপরিবারে ঈদ উদযাপন করে বরিশাল থেকে ঢাকায় ফিরেছি। সদরঘাট থেকে যাত্রাবাড়ী এসেছি সিএনজিতে ৬শ’ টাকা ভাড়া দিয়ে। আমার কাছে মনে হয়েছে কোনো মগের মুল্লুকে বাস করছি আমরা। আরেক যাত্রী বলেন, সদরঘাট থেকে গুলিস্তানের বাস ভাড়া ৫ থেকে ৭ টাকা। অথচ আমার কাছে ১শ’ টাকা নেয়া হয়েছে। রাতজেগে অতিকষ্টে এসেছি। আমার মতো বেশিরভাগ যাত্রীই ক্লান্ত ছিল। তাদের কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু বাসের হেলপার, কন্ডাক্টরদের সামনে যাত্রীরা অসহায়। আবার ফুলবাড়ীয়া টার্মিনালে নিয়ে ‘সাইজ’ করার ভয়ও দেখানো হয়েছে কোনো কোনো যাত্রীকে। জানা গেছে, সদরঘাট থেকে মিরপুর, রামপুরা, গাজীপুর, গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, চিটাগাং রোডসহ সবগুলো রুটের বাসেই গত ১২ দিন ধরে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এসব রুটে যে সব পরিবহনের বাস চলাচল করে সেগুলো হলো, সু-প্রভাত স্পেশাল সার্ভিস, মিরপুর ইউনাইটেড সার্ভিস লিঃ, তানজিল পরিবহন, বিহঙ্গ পরিবহন, ইটিসিএল, ভিক্টর ক্লাসিক, স্বজন পরিবহন লিঃ, ওয়েলকাম পরিবহন লিঃ, ৭ নং রুটের বাস, বিআরটিসি বাস, আজমেরী পরিবহন, আজমেরী গেøারী পরিবহন। প্রতিটি বাস ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আওতাভুক্ত। সমিতির কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কায় করছে না এসব বাস। সদরঘাট থেকে বাড্ডার দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। ভাড়া ১৭ টাকা। সেখানে বাসগুলোতে আদায় করা হচ্ছে ১৫০ টাকা। যা নির্ধারিত ভাড়ার ৭৮২ গুণ বেশি। একইভাবে সদরঘাট থেকে মিরপুর ১০ নং সেকশনের দূরত্ব ১৪ দশমিক ৬ কিলোমিটার। ভাড়া ২৫ টাকা। বাসগুলোতে আদায় করা হচ্ছে ২০০টাকা। সদরঘাট থেকে উত্তরা আব্দুল্লাহপুরে দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। ভাড়া ৪০ টাকা। অথচ সেই ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২শ টাকা। একইভাবে হিউম্যান হলারে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সদরঘাট থেকে চিটাগাং রোডের ভাড়া ২০ টাকা। আদায় করা হচ্ছে ৬০ টাকা। সদরঘাট থেকে গুলিস্তানের ৫ টাকা ভাড়া হলেও আদায় করা হচ্ছে ৫০ টাকা। যা নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে শতকরা ৯শ ভাগ বেশি।
অন্যদিকে, সিএনজি অটোরিকশাতেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রমান পাওয়া গেছে। সদরঘাট থেকে যাত্রাবাড়ীর দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। এতে অটোরিকশার ভাড়া ৭৪ টাকা বা যানজট থাকলে তার কিছু বেশি আসার কথা। সেখানে যাত্রীদের কাছে থেকে ৬০০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। সদরঘাট থেকে উত্তরা আব্দুল্লাপুরের ভাড়া ৩১৫ টাকা বা কিছু বেশি হওয়ার কথা। সেখানে এক ভাড়া ১৫শ’ টাকা আদায় করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আমিসহ ৫ সদস্যের একটি পর্যবেক্ষক টিম গতকাল রোববার ভোর থেকে সদরঘাটে যাত্রী দুর্ভোগ পরিস্থিতির সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে যে চিত্র দেখেছি তা সত্যিই দুঃখজনক। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি সদরঘাট টার্মিনাল এলাকায় শত শত বাস, হিউম্যান হলার অবৈধভাবে প্রবেশ করে যাত্রী উঠানোর জন্য হাক-ডাক করছে। এসব পরিবহনে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার ৪ থেকে ২০ গুণ অতিরিক্ত ভাড়ায় যাত্রীদের উঠাতে গিয়ে ২০ থেকে ৩০ মিনিট সময় ক্ষেপন করছে। এতে পেছনে যানজট ও সামনে জনজট সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, এহেন ভাড়া নৈরাজ্যের অব্যাহত জুলুম চলতে থাকলে দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনিয়ম দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি বৃদ্ধি পাবে, সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন